নিতাই চন্দ্র রায়
আখের আধুনিক চাষাবাদ
বেশি দাম ও বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকার কারণে সারা দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ।যথাযথ যত্ন সহকারে চাষ করলে অন্য যে কোনো ফসলের তুলনায় চিবিয়ে খাওয়া আখ থেকে অধিক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।বর্তমানে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রায় ২০ হাজার এক জমিতে বিভিন্ন জাতের চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ হচ্ছে।এসব জাতের মধ্যে অর্র্মৃত, সিও-২০৮, মিশ্রিমালা, কাজলা, বনপাড়াগে-ারী, তুরাগগে-ারী ও বিএসআআই আখ-৪২ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ হলেও চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ,বরিশাল, খুলনা, শরিয়তপুর, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জে বেশি পরিমাণ জমিতে চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ করা হয়।ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এক টুকরা চিবিয়ে খাওয়া আখ ৫ থেকে ৬ টাকায় এবং একটি আস্ত আখ ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এক একর জমিতে ১৫ হাজার আখ উৎপন্ন হলে এবং প্রতিটি আখ ২০ টাকা করে বিক্রি করা গেলে এক বছরে আখ বিক্রি করে এক একর জমি থেকে তিন লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে চাষকৃত রংবিলাশ নামের আখটিকে ২০০২ সালে চিবিয়ে খাওয়া জাত হিসেবে নির্বাচন করা হয়।নির্বাচিত জাতটিকে সিও-২০৮ জাতের সাথে তুলনা করার পর ২০১২ সালে চূরান্তভাবে বাছাই এবং ২০১৪ সালে বিএসআরআই আখ-৪২ হিসেবে অবমুক্ত করা হয়।
বৈশিষ্ট্য: বিএসআরআই আখ-৪২ জাতের কা- নরম ,লম্বা, মোটা আকারের। রং আকর্ষণীয় গাঢ় পাটল বর্ণের।মধ্যপর্ব টিউমিসেন্ট আকৃতির।চোখ ডিম্বাকৃতি।কচি পাতা খাড়া তবে অধিকাংশ পুরাতন পাতা হেলে পড়ে।এ জাতের আখে কোনো ফুল হয় না।এটি একটি আগাম পরিপক্ক আখ। গুড়ের গুণগতমান ভাল। জাতটি খরা সহিষ্ণু ক্ষমতা বেশি।
রোপণ কাল: আশ্বিন-কার্তিক মাস হলো এই জাতের আখ রোপণের উপযুক্ত সময়।
উপযোগী মাটি: বাংলাদেশের উঁচু ও মাঝারি প্রায় সব ধরণের মাটিতে এই জাতের আখ আবাদ করা যেতে পারে তবে এঁটেল দোআঁশা থেকে বেলে দোআঁশ মাটিতে বিএআরআই আখ -৪২ জাতের আবাদ ভাল হয়।
বীজের পরিমাণ: সনাতন পদ্ধতিতে ৬.৫ থেকে ৭.০ টন এবং রোপা পদ্ধতিতে ২.০০ থেকে ২.৫০ টন বীজের প্রয়োজন হয়। রোপা পদ্ধতিতে পলিব্যাগ বা বীজতলাতে চারা তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে মূল জমিতে রোপণ করা হয়।
সারের মাত্র ও প্রয়োগ পদ্ধতি: বিএসআরআই-৪২ জাতের আখ চাষের জন্য একর প্রতি ১৪০ কেজি ইউরিয়া, ১১০ কেজি টিএসপি ,১০০ কেজি এমওপি, ৬৬ কেজি জিপসাম ও ৩ কেজি জিংক সালফেট এবং ৮৫ কেজি ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
বেলে দো-আঁশ মাটিতে ইক্ষু রোপণের পূর্বে সম্পূর্ণ টিএসপি, জিপসাম, ম্যাগনেশিয়াম এবং এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও এমপি সার নালায় প্রয়োগ করে কোদাল দ্বারা হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। কুশি উৎপাদনের সময়ে পুনরায় এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বাকি এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া ও এমওপি সার প্রথম দফা উপরি প্রয়োগের এক মাস পর দ্বিতীয় দফায় প্রয়োগ করতে হবে।
এঁটেল মাটিতে আখ রোপণের পূর্বে সম্পূর্ণ টিএসপি, জিপসাম, জিঙ্ক ও ম্যাগনেমিয়াম এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার নালায় প্রয়োগ করে কোদাল দিয়ে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার কুশি উৎপাদন সময়ে অর্থাত আখ রোপণের ১২০ থেকে ১৫০ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
রোপা আখের বেলায় মূল জমিতে আখের চারা রোপণের পূর্বে সম্পূর্ণ টিএসপি, জিপসাম, জিঙ্ক ও ম্যাগনেশিয়াম সার নালায় প্রয়োগ করে কোদাল দ্বারা হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। চারা রোপণের ২০ থেকে ৩০ দিন পর অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার চারার গোড়ার চারদিকে স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার আখের কুশি উৎপাদনের সময় ১২০ থেকে ১৫০ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা বাঞ্চনীয়। সেচের ব্যবস্থা না থাকলে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
জৈবসার প্রয়োগ: জমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং ফলনশীলতা সংরক্ষণের জন্য একর প্রতি ৫টন গোবর বা প্রেসমাড অথবা ২০০ কেজি সরিসার খৈল জৈব সার হিসেবে আখ রোপণের ৪ থেকে ৫ দিন পূর্বে নালায় প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
সেচ: অঙ্কুরোদগমের সময় মাটিতে প্রয়োজনীয় রস না থাকলে সেচ দিতে হবে। এ ছাড়াও স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে খরা মৌসুমে ২ থেকে ৩টি সেচ দিলে শতকরা ৩০ভাগ বেশি ফলন পাওয়া যায়। রোপা আখের ক্ষেত্রে চারা রোপণের পর অবশ্যই একটি জীবনী সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা: সময় মতো আগাছা ও পোকা-মাকড় দমনসহ যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে। অতি বৃষ্টি বা বন্যাজনিত কারণে ক্ষেতে জলাবদ্ধতা দেখা দিলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।গাছের হেলে পড়া রোধ করা জন্য প্রয়োজন মতো আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে আড়আড়িভাবে আখ গাছ বেঁধে দিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে আখের সবুজ পাতাগুলি সঠিকভাবে সূর্যের আলো পায়। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি হতেই এ জাতের আখ মাড়াই করা যেতে পারে।
ফলন: উপযুক্ত যত্ন নিলে বিএসআইরআই-৪২ জাতের আখে একর প্রতি ৬০ থেকে ৭০ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায় ।
লেখকঃ
সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ