আলু সংরক্ষণই এনে দিতে পারে কৃষকের হাসি

আলু সংরক্ষণই এনে দিতে পারে

আলু সংরক্ষণই এনে দিতে পারে
নাহিদ বিন রফিক

আলু বাংলাদেশের প্রধান সবজি। সেরা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান অষ্টমে। ২ এখন ভরা মৌসুম। দামও একটু কম। কেজিপ্রতি দর ১২ টাকা। যদিও মাসখানিক আগে দাম ছিল ৮-১০ টাকা। যেহেতু অধিকাংশ কৃষক আলু সংগ্রহের পরপরই বাজারে বিক্রি করে দেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাজারমূল্য কম থাকে। ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও আছে। এজন্য দরকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা। দীর্ঘ সময় আলু রাখার জন্য একমাত্র উপায় হিমাগার। এজন্য ব্যয় হবে কম হলেও বস্তাপ্রতি তিনশ’ টাকা। এছাড়া প্রায় সাড়ে তিনশ’ হিমাগারে দেশের মোট আলু রাখার জায়গাও হবে না। তাই সাধ্য না থাকায় কেউ কেউ খাটের নিচে কিংবা ঘরের কোনো স্থানের মেঝেতে আলু স্তূপ করে রাখেন। সঠিক পদ্ধতি না জানার কারণে এসব আলুর শতকরা ২০-৩০ ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। এজন্য খরচও হবে কম। বস্তাপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা। এক বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি ‘অহিমায়িত ঘর’ ব্যবহারের মাধ্যমেও আলু গুদামজাত করা যায়। কৃষি বিপণন অধিদফতরের উদোগে এর উদ্ভাবন। ছায়াযুক্ত স্থানে মাঁচার উপর নির্মিত এ ঘরের ছাওনি হবে টিনের এবং চারদিকে থাকবে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। এক শতাংশ জমিতে বিস্তৃত ঘরের ধারণ ক্ষমতা ১৪-১৬ টন। অবশ্য ঘরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আলুর পরিমাণের ওপর নির্ভর করবে। একা সম্ভব না হলে কয়েকজন মিলেও তৈরি করা যেতে পারে। এভাবে সংরক্ষণ করলে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য বিদায় হবে। কৃষক হবেন লাভবান। মুখে ফুটবে হাসি। ‘পানির দামে আলু, চাষির মাথায় হাত’ এ ধরনের সংবাদ কোনো পত্রিকায় আর শিরোনাম হবে না। এবার জেনে নেয়া দরকার, সংরক্ষণের সেসব সহজ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত।

আলু সংরক্ষণের পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক সময়ে সংগ্রহ। পরিপক্ক হলেই তুলতে হবে। এজন্য ৭-৮ দিন আগে গোড়া থেকে গাছ কেটে ফেলা দরকার। বৃষ্টি কিংবা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আলু তুলতে মানা। প্রখর রোদেও ঠিক নয়। এতে ব্লাকহার্ট রোগ হওয়ার আশংকা থাকে। তাই সকালবেলা উত্তম। লাঙ্গল কিংবা কোদালে আলু কেটে না যায়, সেদিক অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। তোলা শেষে বস্তাভরে দ্রুত বাড়ি নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো কারণে জমিতে রাখতেই যদি হয়; তাহলে ছায়াযুক্ত স্থানে বিছিয়ে শুকনো খড়-কুটা কিংবা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। বস্তায় ঢুকানোর সময় আলু যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, সেজন্য প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা উত্তম। বাড়িতে এনে স্বাভাবিক বাতাস চলাচল করে, এমন শুকনো এবং ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা দরকার। রাখার সময় বেশি উঁচু থেকে ফেলা যাবে না।

আলুর ছাল শক্তকরণের জন্য ঘরের খোলামেলা ঠান্ডা জায়গা নির্বাচন করতে হয়। মেঝেতে চট বিছিয়ে ১ ফুট পরিমাণ উঁচু করে আলুর স্তূপাকারে রাখতে হয়। এর উপরে পাতলা কাগজ দিয়ে ৫-৭ দিন ঢেকে রাখতে হবে। তাহলেই ছাল শক্ত হয়ে যাবে। নাড়াচাড়ায় ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না। পাশাপাশি গায়ে ক্ষত থাকলে তা সেরে যাবে। পোকার আক্রমণ হতেও পাবে রক্ষা। সংরক্ষণের পূর্বে খুব ছোট, আঘাতপ্রাপ্ত, কাটা, ফাটা, ক্ষত, সবুজ বর্ণ এবং রোগপোকায় আক্রান্ত আলুগুলো বাদ দিয়ে ছোট, মাঝারি এবং বড় আকারের আলু নির্বাচন করতে হয়। আগেই ছায়াতে শুকিয়ে দিতে হবে। একটুও ভেজা থাকা চলবে না।

আলুর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বায়ু চলাচল উপযোগী করে ঘর তৈরি করতে হবে। খড়-কুটা, ছন, গোলপাতা এসবের ছাউনি এবং বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার এ ঘরটি মাটি থেকে একটু উঁচুতে মাঁচা তৈরি করে দিতে হয়। এর উপর স্তূপকরে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিস্তূপের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১ মিটার এবং প্রশস্ত হবে ২ মিটার। তাক বানিয়েও আলু রাখা যায়। বাঁশ বা বেতের ঝুড়ি, ডোল এসবেও রাখা যাবে। নিজেদের থাকার ঘরে মাঁচায় বা তাক বানিয়ে, এমনকি চৌকির নিচে শুকনো বালুর উপর আলু রাখা যাবে। পোকার আক্রমণে হতে রক্ষা পেতে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালির শুকনো পাতা গুঁড়া করে স্তূপে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। কোনো কীটনাশক নয়। প্রতি ১৫ দিন পরপর আলুর অবস্থা দেখে নিতে হবে। দুর্গন্ধ বের হলে বুঝতে হবে আলুর পচন ধরেছে। পচা আলু সরিয়ে ফেলতে হবে। এর আশেপাশের ভেজা আলু হালকা রোদে শুকিয়ে পুনরায় গোদামজাত করতে হবে। ইঁদুর কিংবা অন্য কোনো ক্ষতিকর প্রাণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলে, এদের দমন ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। এছাড়া রোগ কিংবা পোকায় আক্রান্ত আলু দেখামাত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। মাঝে মাঝে আলু উপরে-নিচে উল্টেপাল্টে দিতে হয়।

মেধা, অর্থ ও শ্রমের বিনিময়ে কৃষক আলু উৎপাদন করেন। আর তা যদি সংরক্ষণের অভাবে লোকসান গুণতে হয়, তখন তাদেও কষ্টের সীমা থাকে না। তবে আগ্রহ এবং কৌশল জানা থাকলে এনে দিতে পারে এর সঠিক সমাধান। অত্যন্ত সহজ এ পদ্ধতিতে ৪ মাস পর্যন্ত আলু রাখা সম্ভব। বিস্তারিত জানতে পাশে আছেন উপজেলা কৃষি অফিসার, উপসহকারি কৃষি অফিসার। ইচ্ছে করলে আপনিও এর অংশীদার হতে পারেন।


লেখক: টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট,কৃষি তথ্য সার্ভিস ও পরিচালক, কৃষি বিষয়ক আঞ্চলিক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ বেতার, বরিশাল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *