কালিবাউস মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন-২য় পর্ব

কালিবাউস মাছের কৃত্রিম প্রজনন

কালিবাউস মাছের কৃত্রিম প্রজনন

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ড. মো: শাহাআলী ও মো: আব্দুর রব মন্ডল

কালিবাউস মাছের কৃত্রিম প্রজনন

ওভোলেশন ও নিষিক্তকরণ (স্ট্রিপিং পদ্ধতিতে প্রজনন)ঃ দ্বিতীয় ইনজেকশনের পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছগুলোকে আলাদা আলাদা ট্যাংকে রাখা হয়। দ্বিতীয় ইনজেকশনের ৫-৬ ঘন্টার মধ্যে স্ত্রী মাছের ওভোলেশন (স্ত্রী মাছের ডিম ডিম্বাশয়ের ভিতরে আলাদা আলাদা হয়ে পেট নরম হওয়া এবং চাপ দেয়ার পর তরল ফ্লুইডের সাথে ডিম জননছিদ্র দিয়ে সহজেই বের হওয়ার অবস্থাকে ওভোলেশন বলা হয়) শুরু হয়। দ্বিতীয় ইনজেকশনের ৪ ঘন্টা পর থেকে স্ত্রী মাছ স্ট্রিপিং এর জন্য প্রস্তুত হয়েছে কিনা পর্যবেক্ষণ করা হয়। ঠিকমতো ওভোলেশন হলে ডান হাত দিয়ে সামনে থেকে পিছন দিকে চেপে ডিম বের করে প্ল্যাস্টিকের গামলায় নেয়া হয়। একইভাবে পুরুষ মাছ থেকেও দ্রুততার সাথে কয়েক ফোঁটা শুক্র বের করে নিয়ে ডিমের উপর ছড়িয়ে দিয়ে পাখির পালক দিয়ে নাড়াচাড়া করে ডিম ও শুক্রানু প্রায় ১ মিনিট সময় ধরে ভালভাবে মিশানো হয়। ১০-৬০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যেই ডিম ও শুক্রানু মিলিত হয়ে ডিম নিষিক্ত হয়। নিষিক্ত ডিমের সাথে পানি মিশিয়ে কয়েকবার পানি পরিবর্তন করা হয়। ফলে মিশ্রিত রক্ত, ফু¬ইড, ডিম্বাশয়ের মেমব্রেন এবং অতিরিক্ত শুক্রানু পানির সাথে চলে যায়। অতঃপর গামলার নিষিক্ত ডিমগুলো ইনকিউবেশনের জন্য ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংকে অথবা হ্যাচিং জারে দেয়া হয়। সেখানে ডিমগুলো পানির সংস্পর্শে এসে স্ফীত হয়ে নির্দিষ্ট আকার আকৃতির পরিবর্তন করে ৪০ গুণ পর্যন্তÍ বৃদ্ধি পেয়ে পানি শক্ত হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পরে ফুটে মাছের রেণু বের হয়। নিষিক্ত ডিম ফুটানোর জন্য হ্যাচিং জার ও ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংক ব্যবহৃত হয়।

হ্যাচিং জারে ডিম ফুটানোর কৌশলঃ নিষিক্ত ডিম ফুটানোর জন্য হ্যাচিং জারে অনবরত পানির প্রবাহ রাখতে হবে। হ্যাচিং জারে নিষিক্ত ডিম দেয়ার প্রথম ১-২ ঘন্টা প্রতি মিনিটে যাতে ১২-১৫ লিটার পানি নির্গমন পথ দিয়ে বের হয় এমনভাবে পানির প্রবাহ রাখতে হবে। অধিক পানি প্রবাহে ডিমের সাথে সমস্ত ময়লা, রক্ত, ফলিকল ধুয়ে মুছে চলে যাবে অথবা ফিল্টারে আটকা পড়বে। এরপর ২৭-৩০০ সে. তাপমাত্রায় নিষিক্ত হওয়ার ১৬-২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেণু বের হয়। ডিম ফুটে পোনা বের হওয়া শুরু করলে পানির প্রবাহ বাড়িয়ে প্রতি মিনিটে আবার ১২-১৫ লিটার করতে হবে। কারণ পোনা বের হওয়া শুরু করলে ডিমের খোসা ও কিছু এনজাইমের সৃষ্টি হয় যা পানির গুণাগুণ নষ্ট করে গন্ধ বের হতে পারে। পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করার ফলে সহজেই তা ধুইয়ে বাইরে চলে যায় অথবা কাপড়ের ফিল্টারে আটকা পড়ে, যার মাঝে মাঝে ফিল্টার পরিস্কার করে দিতে হবে। ডিম ফুটে রেণু বের হওয়া শেষ হলে আবারও পানির প্রবাহ মিনিটে ৮-১০ লিটার রেখে পোনাগুলোকে সেখানেই ৩০-৪৮ ঘন্টা সময় রাখতে হবে। তারপর হাপায় নামিয়ে প্রথম ফিডিং দিতে হবে।

ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংকে ডিম ফুটানোর কৌশলঃ নিষিক্ত ডিম ফুটানোর জন্য সার্কুলার ট্যাংক ব্যবহার করা হলে তলার হাঁসকলগুলোর মাধ্যমে পানির প্রবাহ এমনভাবে নির্দিষ্ট করে রাখতে হবে, যাতে ট্যাংকের তলায় কোথাও ডিম না জমে থাকে। ডিম ফুটা শুরু হলে পানির প্রবাহ সামান্য বাড়িয়ে ডিম পোনার নিচে জমে যাওয়া রোধ করতে হবে। নতুবা নিচে জমে যাওয়া পোনাগুলো বাঁচানো যাবে না। এভাবে কিছু পোনা মরে গিয়ে গন্ধ বের হলে সম্পূর্ণ ট্যাংকের সকল পোনাই আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। এজন্য নিচে জমে যাওয়া রোধ করার ব্যাপারে বিশেষ সর্তক থাকতে হবে। ডিম ফুটে বের হওয়ার ৪০-৫০ ঘন্টা পর উপরের ঝর্ণাগুলো চালাতে হবে। অতঃপর ফিডিং এবং বিক্রি এই ট্যাংক থেকেই করতে হবে। বড় বড় হ্যাচারিতে বেশি পরিমাণ রেণু উৎপাদনের জন্য ইনকিউবেশন সার্কুলার ট্যাংকে ডিম ফুটানো হয়। একই জাতের বেশি রেণু উৎপাদনের জন্য সার্কুলার ট্যাংক সুবিধাজনক। এছাড়া একই ট্যাংকের মাধ্যমে প্রজনন, ইনকিউবেশন এবং রেণুর পরিচর্যা করা যায়। ৯ ফুট ব্যাসের একটি সার্কুলার ট্যাংকে ১৫-২০ কেজি রেণু উৎপাদন করা যায়। সার্কুলার ট্যাংকে তুলনামূলকভাবে পানি খরচ বেশি এবং প্রাথমিক বিনিয়োগও বেশি প্রয়োজন।

ডিম পোনার পরিচর্যাঃ ডিম ফুটার পর পোনার পেটে বা উদরে একটি খাদ্য থলি থাকে যা থেকে প্রায় ৬০ -৭২ ঘন্টা পর্যন্তÍ নিজেদের খাদ্যের যোগান পেয়ে থাকে। যতক্ষন পর্যন্ত পোনার খাদ্য থলি থাকে ততক্ষণ পোনার বাইরের খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। এই পর্যায়ের পোনাকে ডিমপোনা বলে। ৬০ -৭২ ঘন্টা পর রেণুর খাদ্য থলির সংরক্ষিত খাদ্য শেষ হওয়ার মাধ্যমে খাদ্য থলির বিলুপ্তি ঘটে। খাদ্য থলি বিলুপ্তির সাথে সাথে বাহির থেকে পোনাকে প্রথম খাদ্য দেয়া হয়। প্রথম খাদ্য হিসাবে সাধারণত সিদ্ধ ডিমের কুসুম তরল করে সরবরাহ করা হয়। এই পর্যায়ের পোনাকে রেণু পোনা বলে। রেণু পোনাকে ৬ ঘন্টা পর পর ১-১.৫ কেজি রেণু পোনার জন্য একটি ডিমের কুসুম সরবরাহ করলেই চলবে। ডিমের কুসুমকে জর্জেটের কাপড়ে ভেঙ্গে নিয়ে একটি গামলায় নীল গুলানোর মতো তরল করে নিতে হবে। অতঃপর উল্লিখিত হিসাবে ডিমের তরল কুসুম ট্যাংকে বা হাপায় ছিটিয়ে ছিটিয়ে রেণুকে খাওয়াতে হবে। ডিম ফুটা শুরু হওয়ার ৬০ ঘন্টা পর প্রথম ফিডিং দিতে হবে। এভাবে ২-৩ টি ফিডিং দিয়ে রেণু পোনা বিক্রি করা বা নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা যায়। রেণু পরিবহনের জন্য প্যাকিং করার কমপক্ষে ৩ ঘন্টা পূর্বে রেণুকে খাবার খাওয়াতে হবে।

প্রজননকারী মাছের পরিচর্যাঃ প্রজননকারী স্ত্রী ও পুরুষ মাছগুলোকে ০.৫- ১.০ পিপিএম পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণে গোসল করিয়ে তারপর ঝঢ়বহঃ ভরংয পুকুরে ছেড়ে দেয়া হয়। স্ট্রিপিং করা মাছগুলোকে আলাদা একটি চৌকোনাকার ট্যাংকে অধিক শাওয়ারে রেখে দেয়া হয়। স্ট্রিপিং করা শেষ হলে বাছাই করে পুরুষ মাছগুলোকে ০.৫-১.০ পিপিএম ঘনত্বের পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণে গোসল করিয়ে এবং স্ত্রী মাছগুলোকে ২-৩ মিগ্রা./কেজি দেহ ওজনে রেনামাইসিন ইনজেকশন দিয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।

লেখকদ্বয়ঃ মাৎস্য বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট

(চলবে)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *