কৃষিবিদ নূরুল হুদা আল মামুন, কুয়াকাটা থেকে ফিরে: সাগরকন্যা কুয়াকাটার শুঁটকির সারাদেশে রয়েছে বেশ কদর। এখান কার ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে অন্যতম হল শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ। মৌসুমের শুরুতেই সৈকতের কোলজুড়ে শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। মৌসুমের শুরুতেই কুয়াকাটার শুঁটকি পল্লীগুলোতে শুঁটকি তৈরির ধুম পড়ে যায় । এ সময় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ পরিবারের সবাই ব্যস্ত শুঁটকি তৈরিতে থাকেন ব্যস্ত।
সম্প্রতি কুয়াকাটা পরিদর্শন করতে গিয়ে সমুদ্র সৈকলের মূল পয়েন্ট থেকে মটর সাইকেলে চলে গেলাম শুটকি পল্লীতে। সরজমিনে শুটকি পল্লী খ্যাত পশ্চিমে কাউয়ারচর, খালগোড়াসহ কয়েকটি শুঁটকিপল্লী ঘুরে দেখা গেছে, গোটা শুঁটকি পল্লীতে শুঁটকি তৈরির কাজ সদ্য শেষ হয়েছে। এ সময়ে কথা হয় শুঁটকিপল্লীর শুঁটকি ব্যবসায়ী মন্টু মিয়ার সাথে (৩০)। তিনি জানান,মূলতঃ শুটকির মৌসুম শুরু হয় কার্তিক মাস থেকে আর চলে ফাল্গুন চৈত্র মাস পর্যন্ত। পুরো শুস্ক মৌসুমে সাগর থেকে প্রথমে মাছ ধরার কাজ চলে তারপর জেলেদের কাছ থেকে মহাজনরা ডাকের মাধ্যমে মাছ কিনে আনেন পল্লীতে। প্রথমে বাছাই করেন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তারপর মাছে লবন মেখে স্থানীয় ভাষায় ‘চাং’নামে খ্যাত বাঁশ কাঠের মাচায় ঝুলানো হয়। দুই তিন দিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় শুটকি। এ বছর তারা লইট্টা, ফাইস্যা, ছুরি, লাক্কা, টোনা, তাপসিসহ অন্তত ১০ প্রজাতির মাছ শুঁটকি করেছেন।
মন্টু মিয়া আরো জানান, প্রতি কেজি লইট্টা প্রজাতির কাঁচা মাছ ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে কিনতে হয় জেলেদের কাছ থেকে। ৬ থেকে ৭ কেজি কাঁচা লইট্টা রোদে শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকিতে পরিণত হয়। পরে তা ছোট-বড় আকারের সাইজে আলাদা করা হয়। এরপর শুঁটকির মান অনুযায়ী সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকেন খুচরা দোকানগুলোতে। খুচরা দোকানিরা ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে ক্রেতাদের কাছে। কিন্তু অন্যান্য মাছ লইট্টার মতো খেসারত দিতে হয় না। অন্যান্য কাঁচা মাছ তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি শুকালে এক কেজিতে পরিণত হয়। কিন্তু ক্রেতাদের মাছে লইট্টা শুঁটকির চাহিদাই বেশি। তবে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ট্রাকের মাধ্যমে পাইকারি দামে শুটকি বিক্রি করেন। এ বছর শুঁটকি মৌসুমে তার ঘর থেকে অন্তত প্রায় আড়াই কোটি টাকার শুঁটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়েছে। এভাবে চলতি মৌসুমে কুয়াকাটা শুঁটকি পল্লীর অন্তত ১০টি শুঁটকির আড়ৎ থেকে ঢাকা, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনাসহ একাধিক স্থানে শুঁটকি সরবরাহ করা হয়েছে। তাতে কুয়াকাটা থেকে চলতি শুঁটকি মৌসুমে এ বছর অন্তত ১৫-১৬ কোটি টাকার শুঁটকি বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়েছে।
মন্টু মিয়ার মতে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ব্যবসা ভাল যাচ্ছে। গত বছর রাজনৈতিক বিরূপ প্রভাব ছিল। তাই ব্যবসায় মন্দাভাব ছিল। কিন্তু চলতি মৌসুমে আবহাওয়াসহ সবকিছুই তাদের অনুকূলে থাকায় ব্যবসা ভাল হয়েছে। শুটকি ব্যবসার প্রধান সমস্যা হলো, হরতাল অবরোধ তথা রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়া। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে শুটকি পরিবহনে বিরাট সমস্যা, তখন শুটকির দাম পড়ে যায় । অন্যদিকে ঝড় বৃষ্টির কারণে ঠিকমত শুটকি শুকাতে না পারলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায় বলে মন্টুমিয়া জানান।
কাউয়ারচরের শুঁটকি পল্লীর মন্টু মিয়া জানান, তিনি আগে কৃষি কাজ করতেন। মাত্র কয়েক বছর এই শুঁটকি তৈরির পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। তিনি ফারুক মিয়ার সাথে যৌথভাবে শুটকির ব্যবসা করেন। এ সময়ে চাং এর পাশে ছোট ছোট ঘরে ৭-৮ জন শ্রমিককে দেখা গেল যারা কেউ অলস সময় কাটাচ্ছেন আবার কেউ শুটকি প্যাকেট করছেন।
অন্য একটি চাঙ্গে গিয়ে সোনা মিয়ার সাথে কথা হল। তিনি জানান, প্রতি বছরের মতো এবারো তিনি শুঁটকি তৈরির জন্য মাচা বানিয়েছেন এবং দুই লাখ টাকার হাঙ্গর, ভোল, মেদ, পোয়া, সোনাপাতা, মধু ফাইস্যা, রূপচাঁদা, পোটকা, চাপিলা, ফাইস্যা, লইট্টা, চিংড়ি, ছুরিসহ শুঁটকি উপযোগী নানা প্রজাতির মাছ ক্রয় করেছেন। এবার আবহাওয়া এবং দাম ভাল থাকায় তিনি এ বছর চাহিদানুযায়ী শুঁটকি করতে পেরেছেন। তার মতে, খুব অল্প পূঁজি খাটিয়ে বেশি লাভ পাওয়া যায় না। ভাল ব্যবসা করতে চাইলে চাহিদা মত টাকা থাকতে হবে। তিনি আরো জানান, এখানকার শুটকি মানে ও গুনে অনন্য বলে পর্যটকরা কুয়াকাটার শুটকি না নিয়ে কেউ বাড়ি ফেরেন না। কোন ক্যামিকেল দেওয়া হয় না তাই দেশে বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। আর এ কারনেই অনেকে কুয়াকাটার শুটকি কে কৃষি বাণিজ্যে জন্য আশীর্বাদ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম