Site icon

কৃষির নানা সেক্টরে জড়িয়ে রয়েছে নারীর অনস্বীকার্য অবদান

কৃষির নানা সেক্টরে
ড. মো. দেলোয়ার হোসেন

কৃষি কাজে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। নারীর সাহায্য ছাড়া কৃষি কাজ করা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব। এই দেশে সেই প্রাচীন কাল থেকে কৃষি কাজে নারীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে তার কাজের ফিরিস্তি শুরু হয়। হাত মুখ ধুয়ে নামাজ আদায় করে অথবা মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে প্রথমে ঘর ঝাড়– দিয়ে কাজ শুরু করেন। অতপর: গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুর ঘাসটা দিয়ে আসেন, হাঁস মুরগির ঘরটা খুলে দেন। অতপর: রান্না ঘরে এসে স্বামী, বাচ্চা শ্বশুর শাশুড়ির জন্য নাস্তা প্রস্তুত করা শুরু করেন, তাদের খাইয়ে নিজে খেতে বসেন। খাওয়ার পর হাড়ি পাতিল ধুয়ে ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করেন। অতপর: বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান। তারপর বাড়ির আঙ্গিনায় সবজী অথবা গোয়াল ঘর থেকে গাভীটিকে বাড়ীর পাশের জমিতে ঘাস খাওয়ার জন্য বেঁেধ দিয়ে আসেন। তারপর দুপুরের খাওয়া তৈরীর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন অথবা চাল করার জন্য ধান সিদ্ধ করেন। সেগুলো আবার উঠানের রোদে শুকাতে দেন, নেড়ে ছেড়ে দেন। ধান শুকানোর পর আবার বিকালে গোলায় গুদামজাত করেন। এর ফাঁকে দুপুরের খাওয়া রান্না করেন। কল থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন। এতটুকু কসরত নেই। বাচ্চাকে গোসল করিয়ে নিজে গোসল করেন। অতপর স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের খাইয়ে নিজের দুপুরের খাওয়া সম্পূর্ণ করেন। তারপর ছাটাইতে সম্ভব হলে একটু গড়াগড়ি দেন অথবা কাঁথা সেলাই করতে বসেন। অতপর সন্ধ্যায় মাঠে গিয়ে গাভীটা নিয়ে আসেন। হাঁস-মুরগীকে ঘরে ঢোকান। তারপর রাত্রের খাবার রান্না করেন। বাচ্চাকে পড়াতে বসিয়ে সহপাঠীদের নিয়ে সম্ভব হলে একটু গল্প করেন। রাত্রে স্বামী বাড়ি আসলে তাকে সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের খাইয়ে নিজে খেতে বসেন। তারপর হাড়ি পাতিল গোজগাজ করে রান্না ঘর পরিষ্কার করে সবার শেষে ঘুমাতে যান। আর এভাবে একজন বাঙালী নারী প্রতিনিয়ত তার ব্যস্ততম দিন অতিবাহিত করেন। আর এ হল আবহমান কাল থেকে বাঙালী নারীর চরিত্র। নিজের সুখ আহলাদ ত্যাগ করে পরিবারের সুখের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেন।

 

নারী ও শ্রমের মূল্য
সুতারাং আমরা বলতে পারি কৃষি কাজে নারীর অবদান বলে শেষ করা যাবেনা। আর এটা কখনো টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না। বীজ সংগ্রহ, বপন/রোপন থেকে আরম্ভ করে ফসলের যতœ, ফসল কাঁটা, ফসল সংগ্রহ, ঝাড়াই, মাড়াই, হাসঁ মুরগীর লালন পালন, ফলগাছ রোপন, যতœ নেয়া, সবজী বাগানের যতœ, পানি সেচ, রান্না-বান্না, ঘর-দুয়ার পরিষ্কার-পরিছন্ন করা, কোন কাজে নেই মেয়েরা? নারীরা আজ পুরুষের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করছে। অফিস আদালত থেকে আরম্ভ করে দেশ রক্ষায় তারা পুরুষের সাথে অতন্দ্র প্রহরীর মত কাজ করছে। র্গামেন্টস সেক্টরে শতকরা ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করছে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১৯৯০ এর দশকে যেখানে ৫২ ভাগ পুরুষ এবং ৪৮ ভাগ নারী কৃষি কাজে জড়িত ছিল, সেখানে ২০১০ এর দশকে এ সংখ্যা ৩২ ভাগ পুরুষ এবং ৬৬ ভাগ নারীতে এসে দাড়িয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এত অবদানের পর নারী শ্রমিকদের শ্রম যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছেনা। তাদেরকে পুরুষ শ্রমিক থেকে কম মূল্য দেয়া হয়। যাহা সমাজের তথা রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য অন্যতম অন্তরায়। অথচ উন্নত বিশ্বে নারী এবং পুরুষ শ্রমের সম মূল্য দেয়া হয়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০০৩ সালের রির্পোট অনুযায়ী বাংলাদেশ শতকরা ৫৯ ভাগ নারী কৃষি কাজে জড়িত সেখানে ভারতে ৭৪ ভাগ, পাকিস্তানে ৬৪ ভাগ এবং নেপালে ৮৫ ভাগ।

 

জাতি গঠনে নারীর অবদান
জাতি গঠনে নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন নারী শিক্ষিত হলে তার ছেলে সন্তান শিক্ষিত হবে। এই জন্য জ্ঞানী জনেরা বলেছিলেন আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের কে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব। আশার কথা হল বর্তমানে উচ্চ শিক্ষায় অর্ধেকের বেশী নারী। অফিস আদালত, কলকারখানা, গার্মেন্ট্সে, বিমানের পাইলট, পুলিশ, সেনাবাহিনী, রাজনীতিবিদ-প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে বিরোধী দলের নেত্রী, স্পীকার সহ সবাই নারী। নারী ক্ষমতায়ানে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল ।

উপসংহার :
অতএব জাতিগঠনে, দারিদ্র দূরীকরন ও সমাজের উন্নয়নের জন্য নারীর অবদান অনস্বীকার্য। তবে কৃষি ক্ষেত্রে নারীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত। এই জন্য নারীকে বলা হয় কৃষির জননী। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। তাদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। তাদের অংশিদারিত্ব ও দায়িত্ববোধের জন্য বাংলাদেশ আজ কৃষিক্ষেত্রে অনেক উন্নতি সাধন করেছে। খাদ্য উপাদানে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ৪র্থতম। সব্জী উৎপাদনে ৩য়। আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম এবং মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ। ডিম ও মাংস উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছেছে। সর্বোপরি ফসল উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে দশম স্থানে আধিকার করেছে বাংলাদেশ। আর এতকিছু সম্ভব হয়েছে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীর কৃষি ক্ষেত্রে অবদানের জন্যই। তাই তো কবি কাজী নজরূল ইসলাম বলেন,

এ পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যানকর
অর্ধেকই তার করিয়াছে নারী
অর্ধেক তার নর ।”

লেখকঃ উপ-পরিচালক, জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি
গাজীপুর।

Exit mobile version