Site icon

খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা

ড. নূরুল হুদা আল মামুন

টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাঃ মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, তথা রায় উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে খাদ্যের নিরাপত্তা জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। পৃথিবীতে মাথাপিছু ক্যালোরির এক বিরাট অংশ আসে মাটিতে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকারের শস্য থেকে। অনেক আমিষজাতীয় খাবারের উৎস (গরু, ভেড়া, ছাগল) পরোক্ষভাবে মাটির ওপরই নির্ভরশীল। হিসাব করে দেখা গেছে, মাথাপিছু ক্যালোরির প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মাটি থেকে আসে। 

এ কারণে মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিষয়টা মায়ের সঙ্গে শিশুর সম্পর্কের মতো। মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কিন্তু প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ মাটিরূপী মায়ের স্বাস্থ্য দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কারণ ১০ সেমি মাটির উন্নয়ন করতে প্রায় ২০০০ বছর সময় লাগে। প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস লিখেছে, ‘পৃথিবীতে খুব দ্রুত মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ার সংবাদ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ। পুষ্টিকর ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ভালো ও সুস্থ মাটি।’ বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩৮ শতাংশ ভূপৃষ্ঠ কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতিসংঘের মৃত্তিকা সম্পদ পর্যবেক্ষণসংক্রান্ত প্রতিবেদন (২০১৫) অনুযায়ী মাটি নষ্ট হওয়াকে পরিবেশ ও কৃষির জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে অভিহিত করা হয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে ইতিমধ্যে বিশ্বের ৩৩ শতাংশ মাটি অবক্ষয় সাধিত বা ডিগ্রেডেড হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। 

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন। আগামী ২০ বছরে ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি করতে হবে। দেশে নিট ফসলি জমি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর, যা আগামী দিনের খাদ্য উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে শস্যের একরপ্রতি উৎপাদন অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া নতুন ঘরবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট তৈরি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কাজে আবাদযোগ্য জমি বছরে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর কমে যাচ্ছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে ক্রমাগত ফসল ফলানোর কারণে এবং মাটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার না করায় উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের পুষ্টিকর অংশ তুলে নেওয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে ফসলের পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা সম্পদ এখন হুমকির মুখে রয়েছে। 

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে—দেশে সব ধরনের বিশেষ করে আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ফসফরাস ঘাটতিযুক্ত এলাকার পরিমাণ ৬৬ লাখ হেক্টর, যা মোট জমির প্রায় ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৭০ হাজার বা ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশে। সালফারের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বা ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ এলাকায়। এর বাইরে বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫১ লাখ ১০ হাজার হেক্টরে (মোট জমির ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ)। জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা মোট জমির প্রায় ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশে। এছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাব। 

উদ্ভিদের বেঁচে থাকা এবং জীবনচক্র সম্পূর্ণ করতে ১৭টি পুষ্টি উপাদান অবশ্যই প্রয়োজন। এসব পুষ্টি উপাদান হলো :কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, কপার, মলিবডেনাম, বোরন, ক্লোরিন ও কোবাল্ট। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন আলোর উপস্থিতিতে গাছ বায়ু  থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড সংগ্রহ করে পানির সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। বাকিগুলো শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। ক্রমাগত হারে ফসল চাষ করার ফলে মাটি  থেকে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আস্তে আস্তে কমে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ফসলের খাবার জোগান দেওয়ার জন্য জমিতে কৃত্রিম উপায়ে সার হিসেবে খাবার দেওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে সারের ব্যবহার একেবারেই সুষম নয়। বেশিরভাগ কৃষক জৈবসার কম ব্যবহার করে থাকেন, যার ফলে মাটি রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে, পরবর্তী সময়ে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগে ফসলের বৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত হয় না। উদ্ভিদের রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, ফসলের দানা পুষ্ট হচ্ছে না, শীত-খরায় সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। 

মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করতে এবং ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম সার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করা অতীব প্রয়োজন। মাটি পরীক্ষা করে সুপারিশভিত্তিক সারের মাধ্যমে চাষাবাদ করলে একদিকে মাটির স্বাস্থ্য যেমন রক্ষা করা যায়, তেমনি ২০-২৫ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। এজন্য মাটি পরীক্ষা ছাড়াও সারের গুণমান নিশ্চিত করা, ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে তাত্ক্ষণিক বিভিন্ন ফসলের জন্য সুষম সার সুপারিশ প্রদান করা, মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব পদার্থ যোগ করা ও ফসলের চাহিদা অনুযায়ী পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা উচিত। এর পাশাপাশি ভূমিক্ষয় রোধের সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে মাটির অম্লমান বজায় রাখা জরুরি। অম্লমান নিয়ন্ত্রণের জন্য অধিক অম্লীয় মাটিতে ডলোচুন প্রয়োগ করা দরকার। মাটিতে জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা থাকলে পানি নিষ্কাশন করতে হবে। অধিক লবণযুক্ত মাটিতে লবণমুক্ত পানি দ্বারা সেচ প্রদান করতে হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে অধিক উৎপাদন করা সম্ভব হবে। 

লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক গবেষণাগার, ফরিদপুর

Exit mobile version