Site icon

খাদ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব ও তার প্রতিকার ২য় পর্ব

খাদ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব

ড. মোঃ আবুল কাসেম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

খাদ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব

ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের পরিবর্তে এই পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করা য়ায়

• মাছ সংরক্ষণের জন্য ফর্মালিন ব্যবহার না করে এক্ষেত্রে বেশী বরফ ব্যবহার করা।
• কলা পাকানোর ক্ষেত্রে ইথিলিন/কার্বাইড ব্যবহার না করে ইট এবং পলিথিন দিয়ে তৈরি তুন্দলের ভিতর কলার ছড়ি রেখে কলা পাকানো। এতে অনেক দ্রুততম সময়ে কলা পাকানো যায়।
• কলা পাকানোর ক্ষেত্রে আরো একটি পদ্ধতি হল মোটা একটি পলিথিনের বস্তার ভিতর কলার ছড়ি রেখে রশি দিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে দেওয়া। এতে বস্তার ভিতরের তাপমাত্র্রা বেড়ে যায় ফলে কলা দ্রুত পেকে যায়।
• আমের fruit fly পোকা দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে Bacto-D-lure জাতীয় ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে (ক) আক্রান্ত আম সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে (খ)“Male/Female attractant and killing” পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে ।
• লিচুর পোকা দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব বালাইনাশক স্পিনোসেড (সাকসেস) স্প্রে করতে হবে (মাত্রা ১০ লিটার পানিতে ৪ মিলিলিটার সাকসেস মিশাতে হবে)।
• করলা, মিষ্টি কুমড়া, শশা, ঝিঙা ইত্যাদি সবজির ক্ষেত্রে Fruit Fly পোকা দমনের জন্য মাঠে বিষ প্রয়োগে না করে এক্ষেত্রে (ক)“কিউ-ফেরো” জাতীয় ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে (খ) বন্ধা পোকা মাঠে ছাড়তে হবে (গ)Male/Female attractant and killing ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে ।
• টমেটোর ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য মাঠে বিষ প্রয়োগের কোন প্রয়োজন নাই। এক্ষেত্রে (ক) হেলিকো-লিউর জাতীয় ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে (খ) জৈব বালাইনাশক HNPV স্প্রে করতে হবে @ ০.২ গ্রা./লি. হিসবে।
• কৃত্রিমভাবে ইথিলিন ব্যবহার করে ফল পাঁকানোর ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে পরিপক্ক ফল পাঁকানো । পরিপক্ক ফল পাঁকাতে একটি বদ্ধ কক্ষে সাধারনত ৫০০ থেকে ২০০০ পিপিএম ইথিলিন ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা ব্যবহার করাই যথেষ্ঠ।
• ফল উৎপাদনকারী কৃষক, ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদের ফল পাকানোর নিরাপদ প্রক্রিয়া শিক্ষা দিতে হবে।
• ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লাভের মন-মানসিকতা ত্যাগ করা।
• বিএসটিআই দুর্নীতিমুক্ত করা ও নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান জোরদার করা।
• অপরাধীদের কঠোর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করা।
• মিডিয়ার মাধ্যমে যেসব পণ্যে ভেজাল হয়, সে সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করতে হবে ও ভেজালযুক্ত খাদ্যদ্রব্য বয়কট করতে হবে।
• বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির ওপর নজরদারি করতে হবে।

ফরমালিন প্রয়োগকৃত দ্রব্যের সনাক্তকরণের উপায়

ফরমালিন প্রয়োগকৃত আমের চামড়া যদিও পাকা রংয়ের বর্ণ ধারণ করে কিন্তু কাটার পর চামড়ার ঠিক নিচে ফলের অংশ কাঁচা পাওয়া যায়। প্রাকৃতিকভাবে পাকা ফলের চামড়া উঠানোর পর এক ফোঁটা আয়োডিন দিলে তা গাঢ় নীল অথবা কালো বর্ণ ধারণ করে। কিন্তু কেমিক্যাল দ্বারা পাকানো ফলে এই আয়োডিনের রং অপরিবর্তিত থাকে। ফরমালিন প্রয়োগকৃত মাছের গায়ে পিচ্ছিলভাব থাকবে না, মাছের গা খসখসে হবে, চোখের মণি উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ না হয়ে ঘোলা আর মলিন দেখাবে, ফুলকা লালের বদলে হালকা বাদামি। রান্নার পর এই মাছে স্বাভাবিক স্বাদ পাওয়া যাবে না, বিশেষ করে মাথা ও পেটের অংশ অত্যন্ত বিস্বাদ ও রাসায়নিক গন্ধযুক্ত হবে। ফরমালিন দেয়া দুধের তৈরি মিষ্টিতে দুধের স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যাবেনা। ফরমালিন দেয়া আঙ্গুরের গায়ে মৌমাছি বসবে না, আঙ্গুর, আপেল নাশপাতির সুগন্ধ থাকবে না। আপেল নাশপাতি দিনের পর দিন একারণেই পচে না। কোনো মাছের বা ফলের দোকানে ক্রেতার চোখ বা নাকে ঝাঁজ লাগলে বুঝতে হবে এখানে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়।

সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিটি বাজার, খাদ্য সরবরাহের উৎস সমূহ, গ্রাম, ব্যবসা কেন্দ্র এবং খাদ্য ব্যবসায় জরীত জনগণের রাসায়নিকের ক্ষতির দিক তুলে ধরে সচেতনতার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা্ করতে হবে। বাংলাদেশে ভেজাল দূর করতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশের বিদ্যমান আইনগুলোকে যুগোপযোগী ও আরো কঠিন শাস্তির বিধান এবং বাস্তবে তা প্রয়োগ নিশ্চিত করা। খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা কঠোর করা। উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্যের পৌঁছানোকে ক্রমাগত পরিদর্শনের আওতায় আনা। অসৎ খাদ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বিএসটিআই (Bangladesh standard and Testing Institution) কর্তৃপক্ষের উচিত পণ্যের মান নিশ্চিত করে অনুমোদন দেওয়া। তাছাড়া বিএসটিআইএর কর্তৃপক্ষের কেউ দুর্নীতিগ্রস্থ হলে তার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা। ভারতে ভোক্তা আন্দোলন বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শক্ত। সেখানে পণ্যে ভেজাল প্রমাণিত হলে ভোক্তা অধিকার কর্মীরা এগিয়ে আসেন। ঐ পণ্য বা সেবা বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। ফল পাওয়া যায় দ্রুতই। কিন্তু বাংলাদেশে এমন আন্দোলন শুধুই স্বপ্ন। ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪’ এর ২৫ (গ) ধারায় খাদ্যে ভেজালের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। অব্যবহৃত আইন ব্যবহার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ফরমালিনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়। কিন্তু সেগুলো কোথায় বিক্রি করা হয় তার সুষ্ঠু হিসাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। এসব রাসায়নিক দ্রব্যসমূহ খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়। আর সেগুলো প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যে। কিন্তু আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। বাংলাদেশে ভেজাল প্রতিরোধে আইনের অভাব নেই। কিন্তু আইনগুলোর অধীনে সামান্য কিছু জরিমানা ও দু-এক মাসের কারাদন্ড ছাড়া বড় কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি। ভেজাল পণ্য উৎপাদন রোধে বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তির বিধান আছে। এ আইন করা হয় ২০০৫ সালে। এর আগে একই নামে একটি অধ্যাদেশ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ আইনে এখন পর্যন্ত কোনো অপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়নি। এছাড়া খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক মেশানো নিয়ে দন্ডবিধি ১৮৬০, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯, বিশুদ্ধ খাদ্য নীতিমালা ১৯৬৭, বিশুদ্ধ খাদ্য আইন (সংশোধিত) ২০০৫, ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ ২০০৯, পয়জনস অ্যাক্ট ১৯১৯, ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ সহ আরো অনেক আইন রয়েছে। বাংলাদেশে ভেজাল প্রতিরোধে বহু আইন আছে। কিন্তু আইনে তেমন প্রয়োগ নেই। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যদি শাস্তি নিশ্চিত করা হয় তাহলে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হবে। সরকারের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক আমদানির উপর পর্যাপ্ত নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে আমদানিকৃত রাসায়নিকের ব্যবহার যাতে সীমিত থাকে সেজন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে সেগুলো প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান জোরদার করতে হবে। ভেজালবিরোধীদের সামান্য জরিমানা করলে কাজ হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)
ময়মনসিংহ
ইমেইলঃ kashembina@gmail

Exit mobile version