দেশে চাল ও আলু ছাড়া অন্য সব খাদ্যে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক কম। সরকারের ঘোষণায়, আগামী ২০১৩ সালের মধ্যে দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে দেশ। বর্তমান উৎপাদন ধারাবাহিকতায় চাল ছাড়া অন্য দানাদার শস্য দেশের চাহিদা পূর্ণ করা অনেকটাই অসম্ভব। বরং দানা জাতীয় শস্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিতে গিয়ে অন্য খাদ্যে উৎপাদনের বড় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিহীনতা।
দেশের বর্তমান খাদ্য উৎপাদন চিত্র
চাল : খাদ্য অধিদফতরের হিসেব মতে, জনপ্রতি প্রতিদিন ৪৯০ গ্রাম করে চাল প্রয়োজন হয়। সে হিসেবে বছরে দেশে মোট চালের চাহিদা ২ কোটি ৮৬ লাখ ১৬ হাজার টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেবে , গত বছর ৩ কোটি ৩৫ লাখ টন চাল উত্পাদিত হয়েছে। এ অনুযায়ী, প্রায় ৪৯ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। রান্নার মাধ্যমে ভাত করে খাওয়া ছাড়াও চালের বেশ কিছু ব্যবহার রয়েছে। বীজ একটা অংশ হিসেবে ব্যবহার হয়। এমন কি পোলট্রি ও পশুখাদ্যে চালের ব্যবহার রয়েছে। রয়েছে বেকারি শিল্পে চালের ব্যবহার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মোট চালের প্রায় ১২ শতাংশ এসব কাজে ব্যবহার হয়। এ হিসেবে প্রায় ৩৪ লাখ টন চাল ব্যয় হয়। তারপরও অতিরিক্ত ১৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ গত বছর ১৩ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়েছে।
সবজি : কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) হিসেবে , জনপ্রতি প্রতিদিন ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণের লক্ষ্যে দেশে বর্তমানে সবজির চাহিদা ১ কোটি ২৮ লাখ ৮০ হাজার টন। সবজি উৎপাদনহচ্ছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। ঘাটতি ১৯ লাখ টন।
গম : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও খাদ্য অধিদপ্তরের হিসেব মতে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। ডিএই হিসেবে গত বছর গম উৎ্পাদিত হয়েছে মাত্র ১১ লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে , গত বছর সরকারি ও বেসরকারিভাবে ৪০ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে।
ভুট্টা : ডিএইর হিসেবে, গত বছর ভুট্টা উৎপাদনপ্রায় ১৪ লাখ টন। দেশে ভুট্টা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ তেমন প্রচলন নেই। পশুখাদ্য, মাছ ও পোলট্রি খাদ্য হিসেবে প্রচুর ভুট্টা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
ডাল : বারির হিসেবে , প্রতিদিন জনপ্রতি ৪৫ গ্রাম ধরে মোট চাহিদা ২৫ লাখ টন, উৎপাদন৭ লাখ ৪১ হাজার টন। ঘাটতি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
ভোজ্যতেল : বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দেশে প্রতি মাসে ২ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। দেশে প্রায় ৯ লাখ টন তেলবীজ উত্পাদিত হয়। যা থেকে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার টন তেল উৎপাদনকরা সম্ভব। বাকি ভোজ্যতেল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
চিনি : বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) তথ্য মতে, দেশে বছরে ১৪ লাখ টন চিনির প্রয়োজন হয়। দেশে উৎপাদনহয় মাত্র ৩ লাখ টন। ঘাটতি ১১ লাখ টন।
মসলা : বারির হিসেবে দেশে মসলার চাহিদা ২৫ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন১৭ লাখ ৫০ হাজার টন।
ফল : কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসেব অনুযায়ী দেশে ফল উৎপাদনেরঘাটতি ৩৭ লাখ টন। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৮ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক ৮৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। আমাদের মাথাপিছু প্রতিদিন ফল গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ গ্রাম। জনপ্রতি গড়ে দৈনিক মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ ৮৫ গ্রাম হলে দেশে ফলের প্রয়োজন ৬৫ লাখ টন।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যা বলে
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থা গত ২০১১ সালের ২ সেপ্টেম্বরে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সূচক (এফএসআরআই) খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকির উচ্চ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৯৬টি দেশ অন্তর্ভুক্ত এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২৭, পাকিস্তানের ২২ ও ভারতের স্থান ৫১তম। চীন ১২৫তম দেশ হিসেবে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ দেশে।
বছর শেষে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) কর্তৃক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাঙ্গার ইনডেক্স-২০১১’-এ বলা হয়, ১৯৯০ সালের তুলনায় ১৫টি দেশে অনেকটা উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯টি দেশে সতর্ক ও অধিক সতর্কের তালিকায় রয়েছে। সতর্ক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব মতে
বিশ্বব্যাংক ২০০৫ সালে বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদা ও উৎপাদনের এক হিসেব দেয়। তাতে দেখা যায়, ধানের চাহিদা ৩ কোটি ৪৮ লাখ, উৎপাদন ৩ কোটি টন। ঘাটতি ৪৮ লাখ টন। ফলের চাহিদা ৮৬ লাখ, উৎপাদন৩০ লাখ টন। সবজি চাহিদা ৬৫ লাখ, উৎপাদন ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। আলুর চাহিদা ৬১ লাখ ৫০ হাজার, উৎপাদন ৮০ লাখ টন। মসলার চাহিদা ৭০ লাখ, উৎপাদন ৫৮ লাখ টন। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০২৫ সালে দেশের চালের চাহিদা দাঁড়াবে বর্তমান উৎপাদন ৩০ শতাংশ বেশি। দেশে মোট আবাদযোগ্য ভূমির মাত্র ৪ শতাংশ অনাবাদি রয়েছে। প্রতি বছর অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য অকৃষি কাজে প্রায় ১ শতাংশ হারে কৃষিভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।
খাদ্য উৎপাদন যেভাবে বাড়ানোর উপায়
দেশের অর্ধেক জমিতে এখন জৈব উপাদানের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এতে ফসল উৎপাদনের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কৃষির অপরিকল্পিত নিবিড়করণ, অপরিকল্পিত শস্য আবর্তন ছাড়াও নানা উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাটিতে জৈব উপাদানের এ ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালের পর থেকে ১২ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে গেছে। ১৯৭৩ সালের জরিপে দেশের শতকরা পঁচিশ ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। এসআরডিআইর বিজ্ঞানীদের মতে, গত এক দশক ধরে মাটিতে জৈব উপাদান ছাড়াও ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, জিংক, বোরন ও অন্যান্য উপাদানের পরিমাণ বিপজ্জনক হারে কমে যাচ্ছে। ১৯৯৮ সালের পর বোরন ও জিংক ঘাটতির জমি বেড়েছে শতকরা ৪০ ও ১৮ ভাগ। উপরন্তু সালফার, পটাশিয়াম ও ফসফরাস ঘাটতির জমি বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ৫০, ৪৫ ও ১৭ ভাগ। দেশে সারের ব্যবহার বৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিলে এ ঘাটতির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে কৃষি জমি বৃদ্ধি না পেয়ে, বরং এক শতাংশ হারে কমতে থাকলেও নানা রকম রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়েছে দ্বিগুণ।
এ প্রসঙ্গে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের মতে, গত এক দশকে দেশের কৃষি জমিতে ৪০ শতাংশ জৈব উপাদান কমে গেছে। ফসল উৎপাদন ঠিক রাখতে মাটির জৈব উপাদান শতকরা সাড়ে তিন শতাংশ থাকার কথা থাকলেও দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের জমিতে এ উপাদান এক বা এর নিচে। ফলে মাটি উর্বর রাখতে যে অণুজীব কাজ করে তা ঠিক মতো কাজ করতে পারছে না। মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে জৈব সারের গুণগত মান ঠিক রেখে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করে জৈব সারের গুণগতমান নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষির অপরিকল্পিত নিবিড়করণের ফলে প্রচলিত শষ্য আবর্তনগুলো যেমন, ধান-শিম-ধান, ধান-ডাল-ধান ইত্যাদি ভেঙে পড়াই মূলত মাটিতে জৈব উপাদানসহ নানা পুষ্টি-উপাদানের ঘাটতি তৈরি করছে। তাছাড়া, উচ্চ ফলনশীল জাতের শস্যের আবাদ বেড়ে যাওয়াকেও অন্যতম কারণ হিসেবে শনাক্ত করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ জৈব সার জমির উন্নত মাটির গঠন নিশ্চিত করে, মাটিতে বায়ু চলাচলের পরিমাণ বৃদ্ধি, পানির ধারণক্ষমতার বৃদ্ধি ও সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখে। জৈব সার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন পাশাপাশি কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের উচিত কৃষক পর্যায়ে জৈব সার উৎপাদনও ব্যবহার বাড়াতে উৎসাহিত করা ।
আগে দু’বার ধান চাষের মাঝখানে শিম বা নানাজাতের ডাল চাষ করা হতো। কারণ প্রাকৃতিক উপায়েই শিম বা ডাল ফসল মাটিতে জৈব উপাদান যোগ করে। অর্থাৎ্ ধান চাষে যার ঘাটতি হয়, এ ফসলগুলো তা পুষিয়ে দেয় মাটিকে। অন্যদিকে উফশী ফসলের উৎপাদন বেশি হলেও, চিন্তার বিষয় যে তা মাটি থেকে প্রচুর পুষ্টি উপাদান টেনে নেয়। অন্যদিকে,মাটিতে গাছের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গাছ কর্তৃক অপসারিত হয় সেই হারে মাটিতে যোগ হয় না। আমাদের দেশের কৃষকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুমান নির্ভর সার প্রয়োগ করে থাকেন। ফলে দিনদিন মাটির স্বাস্থ্য তথা মাটির র্উবরতা কমে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে,মাটি পরীক্ষা করে ফসলের চাহিদা অনুযায়ী সুষম মাত্রায় জৈব ও রাসয়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। এতে এক দিকে যেমন মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে,তেমনি ক্ষয়িষ্ঞু জমি থেকেও খাদ্য ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত অনুমান নির্ভর সার ব্যবহারের পরির্বতে মাটি পরীক্ষা করে ফসলের চাহিদা অনুযায়ী সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। আর এ জন্য প্রয়োজন সরকারি- বেসরকারি মহল থেকে কৃষক সচেতনতা বৃদ্ধি করে সারা দেশব্যাপি মাটি পরীক্ষা ভিত্তিক সার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম