Site icon

জেনে নিন খাদ্য নিরাপত্তায় ফল ও সবজীর নানা গুরুত্ব

খাদ্য নিরাপত্তায় ফল

ড. মো. দেলোয়ার হোসেন

আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যমলা মলয়জ শীতলা এক অপরুপ অনিন্দ্য সুন্দর বাংলাদেশ। বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের-রুপসী বাংলা, রুপের যে নাইকো শেষ – বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র ও বুড়িগঙ্গা বিধৌত বাংলার রুপ ও সোন্দের্যে সবই মনোমুগ্ধকর। বাংলাদেশ সবুজের দেশ। ষড়ঋতুতে বাংলাদেশ বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়। ষড়ঋতুতে প্রায় শত রকমারী ফলের সমারোহে সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশ। কবি তাই যর্থাথই বলেছেন- এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।
খাদ্য ও পুষ্টি ঃ
আমাদের খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হল সুস্থ, সবল ও কার্যক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোন খাবার খেয়ে পেট ভরানো যায় কিন্তু তাতে দেহের চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। কাজেই প্রকৃত খাদ্য সম্বন্ধে আমাদের প্রত্যেকেরই ধারনা থাকা দরকার। বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির চেয়ে পুষ্টি সমস্যা অনেক বড় আকারে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গ্রামঞ্চলের মা ও শিশুরাই এর শিকার বেশী। এদেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য দানা জাতীয় (চাল,গম) খাদ্য উৎপাদনও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অথচ এ ধরনের খাবার ছাড়া শাক-সবজি ও ফল-মূল জাতীয় খাবারেরও যে অনেক ঘাটতি রয়েছে এবং এসব অতি জরুরী খাবারের অভাব যে কেবল ভাত দিয়ে পুরণ হয় না, তা আমরা তেমন বিবেচনা করি না। পুষ্টি জ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহনের প্রতি আমরা মোটেই সচেতন নই। তাতে যারা পেট ভরে দু’বেলা খেতে পায় না তারাই যে শুধু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তা নয়, সে সংঙ্গে ধনীরা ও অপুষ্টির শিকার থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত নন। এহেন অবস্থায় পুষ্টি বিষয়ক শিক্ষা, প্রশিক্ষন ও প্রচারণার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশী করে দেখা দিয়েছে।
দেহের ক্ষয় পূরন, পুষ্টি সাধন এবং দেহকে সুস্থ ও নিরোগ রাখার জন্য নানা ধরনের ফল-সব্জি অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য। এগুলো ছাড়া আমাদের সুষম খাদ্যের বিষয় চিন্তা করা যায় না। খাদ্য বিজ্ঞানীরা একজন প্রাপ্ত বয়স্কের জন্য প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফল-সবজি খাবার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে শাক পাতা ১১০ গ্রাম, ফুল-ফল-ডাটা জাতীয় সবজি ৮৫ গ্রাম, মূল জাতীয় ৮৫ গ্রামও ফল ১১০ গ্রাম ধরা হয়েছে। ফল সবজি পুষ্টিতে সমৃদ্ধ হলেও সংরক্ষন, খাবার পরিবেশন ও ত্রুটিপূর্ণ রান্নার কারণে এসব খাবারের প্রকৃত গুণাগুণ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে থাকি। তাজা অবস্থায় ফল সবজি খেলে তাতে বেশী খাদ্য মান পাওয়া যায়। প্রায় সব রকম ফলে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন-সি’ পাওয়া যায়। শাক সবজিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভিটামিন-সি’ থাকে তবে রান্না করার সময় তাপে প্রায় ৮০ % ভিটামিন ’সি’ নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই সালাদ হিসেবে শাক সবজি খেলে ভিটমিন ’সি’ ও আরো কিছু উপাদানের পুরো ফায়দা পাওয়া যায়। তবে যাদের সবজি কাচা খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে তাদের হালকা সিদ্ধ করে খাওয়াই ভালো।
আপেল, নাসপতি, পেয়ারা, শশা ইত্যাদি ধরনের ফলের ছিলকা বা উপরের খোসা আমরা অনেকেই ফেলে দেই। তাতে অনেক খাদ্যমান অপচয় হয়। ফল সবজি উভয় ক্ষেত্রে সম্ভব হলে খোসা না ফেলাই ভালো। বেশী পাকা ফলে খাদ্যমান কমে যায়। যেমন পাকা পেপে থেকে আধাপাকা পেপে বেশী পুষ্টিমান সম্পূর্ণ। তাছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে বেশী নজর দেয়া প্রয়োজন। ফল সবজি আগেই ভালোভাবে ধুয়ে কাটা উচিত। আগে কেটে পরে ধোয়া হলে পানির সাথে অনেক খাদ্য উপাদান/ভিটামিন মিশে বের হয়ে যায়। অনেকে করলার তিতা স্বাদ কমানোর জন্য সিদ্ধ করে পানি ফেলে দেয়। কোন মতেই এটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সবজি কাটার আগে হাত, বাসন ও বটি (কাটাঁর যন্ত্র) ভালভাবে ধুয়ে নেয়া প্রয়োজন। সবজি কুচি কুচি করে কাটলে পুষ্টিমানের অপচয় হয়, তাই তরকারীর টকুরো বড় রাখা প্রয়োজন। অনেকের ধারণা বেশী তেল মসলা দিলেই রান্না ভাল হয়। অথচ কম তেলে-মসলা ও কম সিদ্ধ স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। পাতিলের মুখ খোলা রেখে রান্না করা ঠিক নয় পরিমিত তেল-মসলা দিয়ে একেবারে রান্না চড়িয়ে ভালভাবে ঢেকে রান্না করতে পারলে ভাল। অবশ্য চর্বিজাতীয় খাদ্য ঢেকে রান্না করা ঠিক নয়। রান্নার পর পরই গরম অবস্থায় খাওয়া উত্তম। চাল ডাল সহ নানা রকম শাক-সব্জি দিয়ে খিঁচুড়ি পাক করে খাওয়া স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অতি উত্তম। এতে পুষ্টিমান রক্ষা, সময় উভয়ই বাঁচে অথচ খাবার হিসাবে ও চমৎকার।
ফল আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ, খাদ্য চাহিদা পূরণ, পুষ্টি সরবরাহ, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বহুমাত্রিক অবদানে ফলজ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ফল দেহে আনে বল, ভিটামিনের একমাত্র উৎস। প্রতিদিন একজন লোকের ১৫০-২০০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। আমাদের দেশে বর্তমানে মাথাপিছু ফলের উৎপাদন প্রায় ৭০-৭৫ গ্রাম যা চাহিদার তুলনায় অত্যান্ত অপ্রতুল, সেখানে ভারতে উৎপাদন ১১১ গ্রাম, ফিলিপাইনে উৎপাদন হয় ১২৩ গ্রাম, থাইল্যান্ডে উৎপাদন হয় ২৮৭ গ্রাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রচলিত ফলের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া অপ্রচলিত ফল যেমন -আঁতা, সরিফা, সফেদা, ডেউয়া, গাব, কাউফল, ক্ষুদিজাম, লটকন ইত্যাদি ফলের আবাদ বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ফল ভান্ডার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ প্রকারের ফল জন্মে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, বিগত ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশের প্রধান ফল গুলো যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, আপেল কুল, আনারস, নারিকেল সহ সব ফলের চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ছিল মোট ৭ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর জমি এবং এতে মোট ফলের উৎপাদন প্রায় ১১০ লক্ষ ৩০ হাজার মেঃ টন। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে বছরে প্রায় ৩৩ ভাগ ফল নষ্ট হয়ে যায় (ড. রহিম, আমাদের সময়- মে’২০১৭)। প্রতি জনের দৈনিক ১৫০ গ্রাম হিসেবে বাৎসরিক ফলের চাহিদা প্রায় ৭৮ লাখ মে. টন। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে ফল নষ্ট হওয়াতে প্রতি বছর প্রায় ২০-৩০ লক্ষ টন ফল আমদানি করতে হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি জনের দৈনিক ১৫০ গ্রাম হিসেবে বর্তমানে আমাদের বছরে ৪৮-৫০ কেজি ফল খাওয়া উচিত, কিন্তু খাচ্ছি মাত্র ২৮-৩০ কেজি। তবে ইদানিং আমরা গত তিনবছর ধরে রসালো ফল বিশেষ করে আম ইউরোপ সহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে রপ্তানি করছি (সুত্র: বাংলাদেশ টেলিভিশন’ মে-২০১৭)।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্ত ফল উৎপাদন হয় তার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ উৎপন্ন হয় বছরের ৪-৫ মাসে (এপ্রিল-জুলাই) বাকি শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ বছরের ৭- ৮ মাসে (আগষ্ট – ফেব্রুয়ারি)। আমাদের দেশে ফলের দোকানে বিভিন্ন জাতের বিদেশী ফলের সমাহার সারা বছর দেখা যায়। তবে এসব বিদেশী ফলের ভিড়ে আমাদের চিরচেনা ক্ষুদে জাম, গোলাপজাম, ডেউয়া,গাব, লটকন, আঁতা, কদবেল প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছে। অথচ রং, রুপ-বৈচিত্র্যে, পুষ্টি ও রসনায় এসব দেশীয় ফল অনেক সমৃদ্ধ। এজন্য এসব দেশীয় ফলের চাষ বৃদ্ধির জন্য আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বর্তমানে ফলচাষ সম্প্রসারণের ব্যাপারে গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। সিলেটের কমলা এখন পাহাড়ের তিন জেলায় চাষ হচ্ছে। গ্রীষ্মকালের আনারস এখন প্রায় সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে। থাই পেয়ারা, আপেল কুলের উৎপাদনও যথেষ্ঠ পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই পুষ্টি চাহিদা পুরন ও সুস্থ ভাবে বাচার তাগিদের জন্য দানাজাতীয় শস্যের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ঘটিয়ে পুষ্টিকর ফল প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই সংযোজন করতে হবে।

ভেজাল য্ক্তু খাবারের প্রভাব ঃ
অপরিকল্পিত বালাই নাশক ব্যবহারে ফলে পোকা মাকড়, রোগ-বালাইয়ের প্রাকৃতিক শত্রু বন্ধু পোকা ধ্বংস হচ্ছে। শত্রু পোকার বালাইনাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফসলে যথেচ্ছা কীটনাশক ব্যবহার, ফলে ও মাছে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য (ফর্মালিন, কার্বাইড) মেশানোর ফলস্বরুপ মানবদেহে সৃষ্টি হচ্ছে- ব্লাড ক্যান্সার, ব্রেন ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার ইত্যাদি। খাদ্যে ভেজালের কারণে গ্যাসট্রিক, আলসার, হৃদরোগ, অন্ধত্ব, কিডনী রোগ, ডায়েবেটিস, স্নায়ু রোগ প্রভৃতি জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী আজ অসহায় হয়ে পড়েছে। বাতাসে সীসা, পানিতে আর্সেনিক, চাউলে-ক্যাডমিয়াম, মাছে ফরমালিন, ফলে- কার্বাইড, ফলের রসে- বিভিন্ন ক্ষতিকারক র্গামেন্টস রং, মুরগীর মাংসে- ক্রোমিয়াম সর্বদিকে বিষ আর বিষ আমরা যাবো কোথায়? এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে খাদ্য ভেজালের কারনে শুধু দক্ষিন এশিয়ায় বছরে ৭৯ লক্ষ মানুষ মারা যায় (উঐঊঘ, ঔঁহব ২১-২০১৪) ।

বৃক্ষ রোপণ:
তাপমাত্রা ও উষ্ণতা রোধে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ রোপনের বিকল্প নেই। গাছ আমাদের অতি মূল্যবান অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে যাহা আমরা নিশ্বাসে ত্যাগ করি। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ % গাছপালা-বন থাকা দরকার, সেখানে বর্তমানে আমাদের দেশে রয়েছে মাত্র ১০Ñ ১২%। এ সমস্যা উত্তরণের জন্য সরকার বৃক্ষরোপনের উপর অত্যাধিক জোর দিচ্ছেন। প্রত্যেককে অন্তত তিনটি গাছ লাগানোর পরার্মশ দিয়েছেন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে একটি ফলজ, একটি বনজ এবং একটি ঔষধি। কিন্তু আমাদের কিছু অপরিমাণর্দশী সিদ্ধান্তে কতক অ্রাগাসী প্রজাতির গাছ দেশকে মরুময়তার দিকে নিয়ে যাচেছ। সারাদেশে রাস্তার দুই পার্শ্বে কড়ই গাছ লাগানো, বিশেষ করে সিরাজগঞ্জে ইউক্যালিপটাস গাছ-বাড়িতে, ক্ষেতের আইলে জমিতে বাগান আকারে চাষ/সৃজন করা হচ্ছে। যে গাছের পাতা সহজে পচেনা, পাখি বাসা বাঁধে না, মৌমাছি মধু আহরন করে না এবং আমাদের ভূ-নিমস্থ পানি ব্যাপক শোষণ করে উড়িয়ে দিয়ে দ্রুত মরুময়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিম্মমুখী হচ্ছে ফলশ্রুতিতে পানিতে আর্সেনিকসহ অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি সহজেই অনুমেয়। অথচ আমরা এর পরিবর্তে দ্রুত বর্ধনশীল বেলজিয়াম, একাশিয়া, ইপিল-ইপিল,মেহগনি ইত্যাদি কাঠের গাছের সাথে ফল গাছ (আম, জাম, কলা, লিচু, পেয়ারা, কাঠাল ইত্যাদি) লাগিয়ে একদিকে পরিবেশের উন্নতি সাধন ও অন্যদিকে ফলের চাহিদা পূরণ করে পুষ্টি সমস্যা সমাধান করতে পারি। আর এটা সম্ভব হলে ”ফল বৃক্ষে ভরবে দেশ, বদলে যাবে বাংলাদেশ”।


লেখকঃ উপ-পরিচালক
জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি
গাজীপুর।

Exit mobile version