Site icon

খেজুর রসঃ প্রকৃতির অপার দান

মো. আব্দুর রহমান, বাকৃবি থেকে


দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বিদায় নিচ্ছে। এখন সন্ধ্যা নামলেই অনুভূত হয় শীতের পরশ আর ভোরে হালকা থেকে কোথাও কোথাও মাঝারি কুয়াশার সাথে ঠান্ডাভাব। ভোরে ঠান্ডা হাওয়া, সকালে মিষ্টি রোদ, সন্ধ্যায় হালকা কুয়াশা -এসব জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। বাজারে ওঠা শীতের সবজি যেন হয়ে উঠেছে এর বার্তাবাহক।
বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে হেমন্তের পর অগ্রহায়ণ পেরিয়ে তবেই আসবে শীতকাল। কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে হেমন্তের শুরুতেই নগরীতে শীতের আগাম আমেজ অনভূত হচ্ছে। গ্রামের দিকে কুয়াশা পড়ছে রীতিমতো শীতকালের মতো। কুয়াশার চাদর ভেদ করে কোথাও কোথাও সূর্য উঠতে সকাল গড়িয়ে যায়।
শীতকাল আমাদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অনুভব-উপভোগে যতটা স্বতন্ত্র, ততটা আলোচ্য বিষয় হিসেবে মূল্য পায়নি। গ্রামজীবনে শীত আসে নানা মাত্রা নিয়ে। এর সঙ্গে একজন কৃষকের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা জড়িত, কষ্টের ভিতরেও নানা প্রাপ্তি যুক্ত। ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষি বা দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের জন্য সময়টা নিরানন্দময়। শহরে জন্ম নেওয়া মানুষ প্রকৃতির এই রূপ আর রং পরিবর্তনকে ততটা আমলে আনেন না। কেননা তার জীবিকা কিংবা বিত্ত-বেসাতির সঙ্গে বিশেষ কোনো ঋতু সরাসরি যুক্ত নয়। গাঁয়ে শেকড় রয়ে যাওয়া প্রথম প্রজন্মের শহরবাসী শীতকে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে দেন না সত্যি, কিন্তু কর্মব্যস্ত সময়ের ভিতর একে নিয়ে দু’দন্ড ভাবার অবসর তার কম।
শীতে উত্তুরে হাওয়া ধেয়ে এসে মানুষের শরীরে যেন হুল ফোটায়। শহরের দালান-কোঠার ভিড়ে এ হাওয়ার সঙ্গে কুয়াশার জঙ্গল একাকার হয়ে যায়। শীতে পানি নেমে যাওয়ার দিগন্ত জোড়া মাঠ গাঁয়ের মানুষের চলাচলের যোগ্য হয়ে ওঠে। খটখটে পায়েচলা কাঁচা সড়ক ধরে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতেও বাধা নেই তখন। মানুষের বেড়াতে যাওয়া বেড়ে যায় এ সময়। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া-আসা ও দূর গাঁ থেকে বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে বধূর শীতের চাদর গায়ে। গ্রামের বাজারগুলোও জমজমাট হয়ে ওঠে। প্রকৃত পক্ষেই শীতে উৎসবমুখর হয়ে উঠে গ্রামবাংলা। শীত উত্সবের সঙ্গে খেজুর রসের রয়েছে সম্পর্ক নিবিড়। একেবারে জলাভূমি ও কিছু পাহাড়ি ভূমি বাদে বাংলাদেশে এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে খেজুর গাছ জন্মে না। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খেজুর গুড় উত্পাদিত হয় বাণিজ্যিকভাবে। অনেক মানুষ যুক্ত হন খেজুর গাছ কাটা, রস সংগ্রহ, তা জ্বাল দেওয়া এবং গুড় তৈরির কাজে। যেকোনো চাষিই খেজুর গাছে কাটতে পারেন রস আহরণের জন্য, কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু কৌশল জানতে হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বহুকাল ধরে পেশাদার গাছ কাটিয়ে আছে। স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় গাছি। কার্তিক মাসের শুরু থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত তারা খেজুর গাছ কাটায় নিয়োজিত থাকেন। যেসব চাষির স্বল্প সংখ্যক খেজুর গাছ আছে; তারা নিজেরাই তা কাটেন, রস পাড়েন ও বাড়িতে এসে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজও সেরে নেন।
শীতের প্রকোপ যত বেশি পড়ে, রসও হয় তত বেশি। সকালে গাছ থেকে রস পাড়ার পর তা জ্বাল দেওয়া হয়। এ হলো ‘জিরান কাট’ রস, স্বাদ ও গন্ধে সবচেয়ে উত্তম। ‘জিরান কাট’ রস নামানোর পর আবারও রসের ভাঁড় বা কলস গাছে টাঙানো হয়, এ থেকে যে রস পাওয়া যায় তা ‘উলাকাটা’। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন গভীর রাতে রস জ্বালানো উনুনের আগুন খেজুর বনের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়, বহুদূর থেকে বোঝা যায়, ওই নিবিড় স্তব্ধতার মধ্যেও জীবনের স্পন্দন আছে। উনুনের পাশে থাকে গাছি আর মজুরদের থাকার জন্য বানানো কুঁড়ে ঘর, খেজুরের পাতা কিংবা বিচালি দিয়ে ছাওয়া। কান পাতলে শোনা যায়, গাছিয়া নিঃসঙ্গতা কাটাতে গ্রাম এলাকায় চালু নানা ধরনের গান গেয়ে চলেছেন। যার সুরে আছে অদ্ভুত প্রাণময়তা ও আবেগ, সহজেই হূদয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
শীত তার বিচিত্র রূপ ও রস নিয়ে হাজির হচ্ছে গ্রামবাংলায়। নবান্ন উৎসব কিংবা শীতের পিঠা পায়েশ তৈরির উত্সব এখন তেমন ঘটা করে হয় না। তারপরেও শীতের যা কিছু চিরায়ত, তা উপলব্ধি করতে হলে গ্রামে যেতে হবে। শীতের নিরবতার অস্তিত্ব সৌন্দর্যমন্ডিত বাংলাদেশের ষড়ঋতুর সরব প্রকাশ।

Exit mobile version