ঘাস বা সাইলেজ ছাড়াই কম খরচে গরু ফ্যাটেনিং বা হৃষ্টপুষ্ট করার সহজ উপায়

গরু ফ্যাটেনিং

গরু ফ্যাটেনিং

শাহ এমরান , স্বপ্ন ডেইরীর সত্ত্বাধিকারীঃ

গরু ফ্যাটেনিং ঃ ফ্যাটেনিং খামার করতে উৎসাহি একদল তরুনদের প্রশিক্ষন দেয়া হলো মোটাতাজাকরন গরুর খামার করতে ঘাস চাষ অবশ্যই করতে হবে। পাশাপাশি আপদকালীন সময়ের জন্য কর্ন সাইলেজ করতে পারলে আর কোন চিন্তাই নেই। ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি লাইভ ওয়েটের গরুকে প্রতিদিন ১৫ কেজি সবুজ ঘাস দিতে হবে সাথে দানাদার, খড় তো থাকবেই।

উদ্যমী তরুনরা চাকরী খুজে না পেয়ে ভেবেছে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে। প্রশিক্ষন নেয়া হলো কিন্তু ঘাসের জমি কোথায় পাবে? তাদের ভিটে মাটিতে অল্প জায়গা আছে, তাছাড়া অন্য যে জায়গা আছে সেখানে সারা বছর নিজের ও পরিবারের খাওয়ার জন্য ধান আর কিছু স্বব্জি চাষ করতে হয়। কিছু তরুন ছিল যাদের কয়েকজনের নিজের কোন জমি ছিলনা।

তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে খামার করবে। তরুনরা নিজ নিজ এলাকায় জমি ভাড়া নিয়ে ঘাস চাষ উতপাদন করা শুরু করলো৷

আবার কেউ কেউ মোটাতাজা গরুকে তারা ঘাস, খড়, সাইলেজ ও দানাদার সহ সবই কিনে খাওয়ানো শুরু করলো।

ঘাসের জমির ভাড়া, প্রতিদিন ঘাস কেটে আনার লেবার খরচ, লেবার মেইন্টেন, লেবার অসুস্থ থাকলে নানারকম দুশ্চিন্তা, ঘাস চুরির পাহাড়াদার নিয়ে অনেক ঝামেলা ও টেনশন তাকে বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌছায়ে দিলো।

পাশাপাশি সাইলেজ কিনে আনা, খড় কিনে আনা ইত্যাদি খরচ মিলিয়ে দিন শেষে লাভের হিসাব মেলানোই কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে একটা সময়।

হিসাবের খাতা নিয়ে দেখা গেলোঃ

১ কেজি সাইলেজের দাম পরিবহন খরচ সহ ১২ টাকা
১ কেজি ঘাস উতপাদন খরচ জমির ভাড়া, লেবার, পাহাড়াদার, চুরি মিলিয়ে ৩ টাকা
১ কেজি খরের দাম পরিবহন খরচ সহ ৯ টাকা
১ কেজি ঘাস কিনে আনলে খরচ ৫ টাকা

আজকের আমার এই লেখা এই সকল তরুনদের জন্য যারা গরুর মোটাতাজা বা ফ্যাটেনিং খামারে সাইলেজ, ঘাস খড় সব কিছু কিনে খাওয়াচ্ছেন। আমার আজকের লেখায় আপনাদের কাছে তুলে ধরার চেস্টা করবো কিভাবে কতটা কম খরচে কম ঝামেলায় গরু ফ্যাটেনিং খামার করা সম্ভব।

আমি যদি আপনাকে বলি, আগামীকাল থেকে আপনার গরুকে ঘাস, সাইলেজ দেবার প্রয়োজন নেই। আপনি ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি লাইভ ওজনের গরুকে সারাদিনে শুধু ২ থেকে ৩ কেজি খড় ও দানাদার দিয়ে গরু পালবেন। কি বিশ্বাস হবে আপনাদের!? অনেকেই বিশ্বাস করবেন না।

তবে অবশ্যই অবশ্যই দুগ্ধ গাভীকে সবুজ ঘাস দিতে হবে। আমি লিখছি আজকে ফ্যাটেনিং বা হৃষ্টপুষ্টকরন খামার নিয়ে।

গত ১ বছর যাবত ফ্যাটেনিং এ পরীক্ষামূলকভাবে প্রাকটিকালি নিজের খামারে অনেক কাজ করেছি যার কিছু চিত্র আপনাদের আগের পোস্টে তুলে ধরেছি।

দেশের বাইরে উন্নত দেশে ফ্যাটেনিং গরুকে টিএমআর (TMR) করে খাওয়ানো হয়। TMR অর্থ হলো টোটাল মিক্স রেশন যেখানে থাকে রাফেজ, দানাদার এবং সাপ্লিমেট।

বিদেশে রাফেজের মধ্যে ধানের খড়, আলফালফা, কর্ন সাইলেজ থাকতে পারে। দানাদারের মধ্যে ভুট্টা, ডিস্টিলার গ্রেইন বা সয়ামিল, গমের ভুষি এবং সাপ্লিমেটের মধ্যে থাকে এমন কিছু উপাদান যেখানে ভিটামিন, মিনারেলস, ফিড গ্রেড ইস্ট সহ এমন কিছু উপাদান যা খাদ্যকে হজম করার জন্য গরুর পেটের ভেতরে ফার্মেন্টেড প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহায়তা করে৷ একটি গরুর দৈহিক বৃদ্ধির জন্য যা দরকার সবই আছে এখানে।

একটি ফ্যাটেনিং গরুর দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস এবং ফ্যাট।

আমাদের দেশে এই উপাদানগুলোর মধ্যে কি কি পাওয়া যায়?

রাফেজের মধ্যে আমাদের আছে খড়, পাকচুং ঘাস। দানাদার উপাদান মোটামুটি সবই আছে এবং সাপ্লিমেন্ট বলতে যা বোঝানো হয়েছে তাও আছে।

এখন কথা হলো, বিদেশে রাফেজের মধ্যে আলফালফা এবং কর্ন সাইলেজে প্রোটিন সহ বেশ ভাল খাদ্য উপাদান আছে। আমি যদি শুধু খড় দেই তাহলে এখানে শুধু রাফেজ পাবে কিন্তু আলফালফা ও কর্ন সাইলেজ থেকে যে প্রোটিন এবং এনার্জি পাওয়ার কথা ছিল তা পাবেনা। তাহলে মনে রাখতে হবে যে প্রোটিন এবং এনার্জি এই দুটো উপাদান আমাদের অন্য কিছু দিয়ে পূরন করে নিতে হবে যদি শুধু খড় আর দানাদার দিয়ে গরু পালতে চাই।

সেক্ষেত্রে দানাদার খাদ্য মিক্স রেশন হতে হবে উচ্চমানের। বাংলাদেশে যদি নিজে খাদ্য উপাদান কিনে উচ্চমানের কেউ দানাদার খাদ্য নিজে বানিয়ে নিতে চায় তাহলে সর্বচ্চ খরচ কেজি প্রতি ২৮ থেকে ৩০ টাকার উপরে আসবেনা।

একটি রেশন দিচ্ছি আপনাদের যা থেকে উচ্চমান সম্পন্ন প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও ফ্যাট পাওয়া যাবে আপনার ফ্যাটেনিং গরুর জন্য।

ভুট্টা ২৫%
রাইস ব্রান ২০%
সয়াবিন মিল ২৫%
গমের ভুষি ২৫%
লবন ০.৫%
মিনারেলস ০.৫%
সাপ্লিমেন্ট ০.৫%
চিটাগুড় (ড্রাই) ৩.৩%
ইস্ট ০.২%

(১০০০ কেজিতে ২ কেজি ইস্ট)

১০০ কেজি লাইভ বডি ওয়েটের গরুকে প্রতিদিন ১.২% দানাদার দিতে হবে। অর্থাৎ যদি গরুর জন্য ৪০০ কেজি হয় তাহলে ৪.৫ (সাড়ে চার) কেজি দানাদার খাদ্য দিতে হবে প্রতিদিন খড়ের সাথে মিক্স করে। অর্থাৎ ২.২৫ কেজি দানাদার সকালে, ২.২৫ কেজি দানাদার বিকেলে।

আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি আমি লিখছি তাদের জন্য যাদের নিজেদের ঘাসের জমি নেই। ঘাস, সাইলেজ, খড় উচ্চদামে কিনে খাওয়াতে হয়।

কখন কিভাবে শুধু খড়ের সাথে মিক্স করে এই খাদ্য খাওয়াবেন তা নিম্নরুপঃ

আপনি আগামীকাল থেকে ঘাস ও সাইলেজ কেনা বন্ধ করে দিলেন। আপনার একটি ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি লাইভ বডি ওয়েটের গরু সারাদিনে ২ থেকে ৩ কেজি খড় খাবে (২ বেলায়)। কি অবাক লাগছে! মাত্র ২ থেকে ৩ কেজি? অবাক হবার কিছু নেই, এটাই ঠিক।

পেটে গাদায়ে আজেবাজে খাবার দেবার থেকে, পুষ্টিমান সম্পন্ন কম খাবার দিন ওতেই চলবে। আমি নিজে পরীক্ষা করে দায়িত্ব নিয়ে বলছি আপনাকে কোন সমস্যা হবেনা। নিজেই এক মাস পরীক্ষা করে দেখুন।

উপরে দেয়া খাদ্য তালিকা অনুযায়ী দানাদার খাবার, লবন, মিনারেলস, সাপ্লিমেন্ট, মোলাসেস, ইস্ট ও খড়কে ছোট ছোট ১ ইঞ্চি পিস করে একত্রে মিক্স করবেন, এটাইকেই বলে টিএমআর (TMR) । এই খাদ্যকে পরিবেশন করবেন প্রতিদিন দিনে দুবার। খাদ্য অবশ্যই শুকনো দেবেন। পানির মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া যাবেনা। গরুকে আলাদা ফ্রেস সাদা পানি দেবেন খেতে।

যে বিষয়গুলো মনে রাখবেন এবং সময়মত পরীক্ষা করবেন তা হলোঃ

১) ফ্যাটেনিং গরু কিনে আনার পরে অবশ্যই সেটাকে ডিওয়ার্মিং বা কৃমিমুক্ত করে নিতে হবে বুষ্টার ডোজ দিয়ে। এরপর ৩ মাস পর পর কৃমির ডোজ একবার করে দিতে হবে।

২) ভাল জাতের ক্রস ব্রিড গরু কিনবেন। কসাইয়ের মাংসের জন্য ফ্রিজিয়ান ক্রস ব্রিড বেস্ট। একদম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন গ্রোথ নিয়ে। দেশী শাহীওয়াল কোরবানীর জন্য ভাল হবে। তবে শাহীওয়ালের ব্লাড লাইন ভালো না হলে গ্রোথ ফ্রিজিয়ান ক্রস ব্রিডের মত আসবেনা। ছবিতে যে ফ্রিজিয়ান গরুটি দেখতে পাচ্ছেন কালো রংয়ের এই গরুটি উপরের দেয়া খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাস/সাইলেজ ছাড়া শুধু খড় ও দানাদার খাদ্যে ৩০ দিনে ৫২ কেজি ওজন বেড়েছে আমার খামারে, পরীক্ষিত।

৩) প্রতি ৪ মাস পর পর ক্ষুরা রোগের ভ্যাকসিন (FMD), এনথ্রাক্স ভ্যাকসিন দিতে হবে
৪) প্রতি ১৫ দিন পর পর ডিজিটাল লাইভ ওয়েট স্কেলে ওজন পরীক্ষা করতে হবে কতটুকু বাড়লো। হিসাব করতে হবে এই ১৫ দিনে কয় টাকা খরচ করলেন আর গরুটির কত টাকার মাংস বাড়লো। সেক্ষেত্রে ডিজিটাল লাইভ ওয়েট স্কেল একজন ফ্যাটেনিং খামারির জন্য অত্যান্ত অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। চোখে দেখে আন্দাজ করে বুঝতে বুঝতে অনেকে ধরতে পারেনা কতটুকু বাড়লো, ততদিনে হয়তো অনেক টাকার লোকসান হয়ে যায়। সব গরু যে ওয়েট বাড়বে তা নয়। অনেক কারন আছে ওজন না বাড়ার পেছনে। সেক্ষেত্রে ওজন না বাড়লে সাথে সাথে বিক্রি করতে দিতে হবে। খামারির লোকসান হবেনা।

৪) গরু ছেড়ে পালার কিছু টেকনিক আছে। সেগুলো ফলো করে গরু যদি ছেড়ে পালতে পারেন আপনার লেবার খরচ ৭৫% কমে যাবে, বিদ্যুত বিল ৭০% কমে যাবে, পানির বিল ৭০% কমে যাবে।

৫) গরুকে টিএমআর বা মিক্স খাদ্যকে পানির মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া যাবেনা, শুকনো দিতে হবে। সাদা পানি আলাদা দিতে হবে।

উল্লেখ্য যে বিষয়গুলো, যাদের নিজেদের ঘাসের জমি, ধানের জমি আছে তাদের জন্য সোনায় সোহাগা কারন তাদের কিছুই কিনে খাওয়াতে হয়না। আমি লিখছি ওই ভাইদের জন্য যাদের সাইলেজ, ঘাস, খড় সব কিনে খাওয়াতে হয়।

ঘাসের জমি যাদের আছে তারা খড় ও ঘাস মিক্স করে গরুকে পরিবেশন করবেন (ছবি দেখেন)। সেক্ষেত্রে ৫০% ঘাস ও ৫০% খড় হতে পারে বা কিছু কম বেশী করতে পারেন। ঘাস ও খড়ের মিশ্রনে খড়ের পরিমান ২০% এর কম করবেন না৷ তাহলে পরিপাকতন্ত্রে হজমে সমস্যা হতে পারে। এই পদ্ধতিতে যদি আপনার খরচ কম হয়, শুকরিয়া। আর যদি আপনি নিজেই এর থেকে কম খরচে লালন পালন করতে পারেন, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের সাথে শেয়ার করবেন কমেন্টে আপনার অভিজ্ঞতা।

আজ এই পর্যন্তই, আর কিছু মাথায় আসছেনা। বন্ধের দিনটাতে আমার ফার্মিং অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লেখার চেস্টা করলাম। ছবিতে যে গরুগুলো দেখছেন সাদা গরুটি বাদে সবগুলো আমার নিজের হাতে শুধু খড়, দানাদার দিয়ে তৈরী করা পরীক্ষামূলকভাবে যেগুলোর ওজন প্রতিদিন কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ কেজি করে বেড়েছে। চেস্টা করবেন ফ্যাটেনিং প্রজেক্ট ৪ থেকে সর্বচ্চ ৮ মাস মেয়াদী করতে। আশাকরি আপনারাও সফল হবেন।

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *