মোঃ মোশারফ হোসেন, নকলা (শেরপুর) :
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নকলায় তুলনামুলক খালের পরিমাণ কম থাকলেও ১১টি বিল, ৯টি জল মহাল, উপজেলার উপর দিয়ে ভয়ে যাওয়া ৫টি নদী, ৪হাজার ১২০টি পুকুর রয়েছে। তাছাড়া ১হাজার ৬৬৪ হেক্টর নিচু জমি রয়েছ্ েওইসব নিচু জমিবর্ষা কালে পানিতে তলিয়ে থাকে। ফলে কোন একসময় আমন বীজ তলা তৈরী করা সম্ভব হতো না। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তির এযুগে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্ভাবিত বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করার অংশ হিসেবে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে আশাতীত সফলতা দেখা দিয়েছে। উপজেলার সর্বত্র না হলেও নদী, বিল ও জলাবদ্ধ নিচু এলাকার পানিতে ভাসমান বেডে শাকসবজি ও বীজতলা গড়ে উঠেছে। উপজেলার পাইষকা গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া, ওসমান গণি, সোবহান, শাহজাহান, গোলাম মোস্তফা; কুর্শাবাদাগৈড় এলাকার লিয়াকত; রুণিগাঁওয়ের জমসেদ মেম্বার ও হানিফ উদ্দিন; ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার বেশ কয়েকজন সদস্য কৃষকসহ আরও অন্তত ১০-১২ জন কৃষকসহ অনেকেই আজ ভাসমান পদ্ধতিতে স্বল্প কালীন শাকসবজি ও ধানের বীজতলা করে সফলতা পেয়েছেন।
কৃষক সবুজ জানান, দুই বছর ধরে ভাসমান পদ্ধতিতে বিভিন্ন শাকসবজি ও ধানের চারা উৎপাদন করে আসছেন। তিনি মিষ্টি লাউ, শীত লাউ (কদু), ঝিঙ্গা, কুমড়া, বেড়স, লাল শাক, কলমি শাকসহ বেশ কিছু শাকসবজি চাষ করে লাভবান হয়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও এই চাষ পদ্ধতিতে শাকসবজি উৎপাদনে আগ্রহী হয়েছেন। সে চলতি আমন মৌসুমে সব জমিতে এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত ধানের চারা রোপণ করবেন। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা অন্য চারার তুলনায় অনেক সুস্থ্য ও সবল হয়। এই চারার উৎপাদন ক্ষমতাও অন্য চারার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তাছাড়া সরকারী পরিত্যক্ত জলমহাল বা জলাবদ্ধ খাস জমি গুলোতেও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা সম্ভব।
বেশ কয়েকজন কৃষকে দেয়া তথ্যমতে, ভাসমান পদ্ধতিতে প্রতিটি বেডের দৈর্ঘ্য ২০ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ফুট হওয়া উত্তম। প্রতিটি বেডে ৫ থেকে ৮ কেজি ধানের বীজ বপণ করা যায়। ভাসমান বেড তৈরী করতে প্রথমে বাঁশ, কলাগাছ, পচাঁনো কচুরিপানা ইত্যাদি দিয়ে ভাসমান মাচা তৈরী করা হয়। মাচার নিচে ২ ফুট এবং উপরে ২ থেকে আড়াই ফুট উঁচু করে পচাঁনো কচুরিপানা দিতে হয়। তার উপরে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি উঁচু করে মাটি দিয়ে তার উপরে শাকসবজির বীজ বপণ করতে হয়। তবে ধানের বীজতলা তৈরী করতে ভিজা মাটিই ভালো হয়। এতে সাধারণত কোন প্রকার রাসায়নিক সার বা কীট নাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। বেড পানিতে ভাসমান থাকায় সার এবং ক্ষতিকর পশু পাখির ও কীট পতঙ্গের অত্যাচার পোহাতে হয়না। ফলে প্রায় বিনা খরচেই ভালো চারা ও নিরাপদ শাকসবজি পাচ্ছেন তারা। বদ্ধ জলাশয়ে বেড তৈরী করলে তেমন কোন কিছুই দরকার হয়না, তবে বহমান পানিতে বেড তৈরী করলে রশি দিয়ে বেধে বা খুঁটি দিয়ে আটকে রাখতে হয়। অন্য এক চাষি লিয়াকত জানান, ভাসমান প্রতি বেডের ধানের চারা দিয়ে ১০ শতাংশ জমি লাগানো সম্ভব এবং প্রতিটি বেড হতে উৎপাদিত শাক ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা বিক্রি করা সম্ভব; আর বিভিন্ন সবজি চাষে লাভ আরও বেশি হয়; কিন্তু খরচ নেই বললেই চলে। এবিষয়ে ভূরদী গ্রামের কৃষক ছাইয়েদুল হক জানান, ৫ শাতাংশ জমির বীজতলায় চাষ দেওয়া, ধান বীজ, সার, জমির লীজ মূল্যসহ ১হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু জলাশয়ে ভাসমান বেডে বীজ তলা করলে সর্বোচ্চ খরচ হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তাছাড়া শাকসবজি হতেও প্রচুর আয় হবে যা অকল্পনিয়। এই হিসাবে নকলা উপজেলার সব জলাশয়ে ভাসমান শাকসবজি ও ধানের বীজ তলা তৈরী করতে পারলে কৃষকের বছরে কোটি কোটি টাকা বেঁেচে যাবে বলে তিনি আশা করেন। বানেশ্বরদী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, ভূরদী ব্লকের আশ্রাফুল ইসলাম, পাইষকা ব্লকে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ কয়েক জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ভাসমান পদ্ধতিতে বেডকরে শাকসবজি ও বীজতলা তৈরী করতে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের উদ্বোদ্ধ করা হচ্ছে। অনেক কৃষক শুরু করেছেন। আগামিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষির সংখ্যা ও পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়বে বলে তারা আশা করছেন। অন্যদিকে ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার ২৫ সদস্য সবাই স্থানীয় চাড়িয়া বিলে অন্তত একটি করে ভাসমান বীজ তলা ও সবজী বেড তৈরী করবেন বলে জানিয়েছেন।
এবিষয়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ ও উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, ভাসমান বীজ তলা তৈরী ও বেডের মাধ্যমে চাষাবাদ করলে পরিত্যক্ত ও সরকারী জলাশয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ূন কবীর বলেন, সারা দেশব্যাপী ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করতে পারলে কৃষি অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। মাঠ পর্যায়ে এই চাষ পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেওয়ায় কৃষকরা ভাসমান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।