জোড়া ধানের সাফল্য: খুলে যেতে পারে কৃষকের নতুন দিগন্ত

জোড়া ধানের সাফল্য

জোড়া ধানের সাফল্য

এম সাইফুল মাবুদঃ

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাদা গ্রামের কৃষক মকবুল হোসেন চাষ করেছেন জোড়া চালের ধান (ইনসেটে)। তাঁর সাফল্যে মানুষের মধ্যে সাড়া পড়েছে।

একে অধিক পানি সহনশীল, তার ওপর জোড়া চাল—নতুন জাতের এ ধান চাষে দেশে সফলতা পাওয়া গেছে। এ দেশে উঁচু বা সমতল ভূমিতে চাষের মতো নানা জাতের ধান থাকলেও ডোবা বা অধিক পানি সহনশীল জাতের ধান ছিল না। দোশতিন নামের জোড়া চালের নতুন জাতের এ ধান চাষে সফলতা পাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের নিচু অনাবাদী জমি ধান চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের এক কৃষক মকবুল হোসেন নিজের জমিতে চার বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে জোড়া চালের ধান চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। জোড়া চালের এ ধান উত্পাদন করে উপজেলার মহেশ্বরচাদা গ্রামের ওই কৃষক এলাকায় ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন। এ ধরনের ধানের চাষ এ অঞ্চলে এটাই প্রথম বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা।

কৃষক মকবুল হোসেন জানান, চার বছর আগে এএসডি বাংলাদেশ নামের এক এনজিওর পরিচালক সুবাস বিশ্বাস তাঁকে ২০ গ্রাম দুই চাল বিশিষ্ট ধান বীজ দেন পরীক্ষামূলকভাবে চাষের জন্য। ঝিনাইদহ এলাকায় দুই চালের ধানের চাষ নেই। তাই তিনি অতি আগ্রহে ধানের বীজগুলো বাড়িতে নিয়ে এসে সংরক্ষণ করেন। এরপর আমন মৌসুমে বীজতলার একপাশে চারা তৈরি করে ওই বছর অন্য জাতের ধান ক্ষেতের পাশে রোপণের মাধ্যমে ছয় শ গ্রাম ধান পান। পরের বছর পুষ্ট বীজগুলো বেছে আগের বছরের চেয়ে একটু উঁচু জমিতে রোপণ করেন। কিন্তু এ বছর ধান গাছগুলো অপেক্ষাকৃত চিকন ও দুর্বল হয়। ফলনও হয় কম। আবার পরবর্তী আমন মৌসুমে বাড়ির পাশের জলাবদ্ধ ডোবা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেন। এবার উঁচু জমির চেয়ে জলাবদ্ধ জমিতে ধানের গাছগুলো বেশ সতেজ ও সবল হয়। ফলনও হয় ভালো। এতে তিনি বুঝতে পারেন, জলাবদ্ধ ডোবা জমিতে এ ধানের ভালো ফলন পাওয়া যাবে। গত আমন মৌসুমে তিনি বাড়ির পাশের জলাবদ্ধ ডোবা তিন শতক জমিতে এ ধানের চাষ করেন। এ মৌসুমে তিন শতক জমি থেকে তিনি ফলন পেয়েছেন দেড় মণ। সবটুকু ধান বীজ হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে বীজ হিসেবে ওই ধান প্রতি কেজি ১০০ টাকা করে ৪০ কেজি বিক্রি করেছেন।

কৃষক মকবুল আরো জানান, হাওর-বাঁওড় জলাবদ্ধ বিলের জমিতে এ ধানের চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। এ ধান দেখতে অনেকটা দেশি জাতের ধানের মতো মোটা। তবে একটি ধানে দুটি করে চাল থাকায় ধান মোটা দেখা গেলেও চালগুলো চিকন। কৃষক মকবুল মনে করেন, পানি সহনশীল এ ধান ডোবা জলাবদ্ধ বাঁওড়-খাল-বিলে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। এ জাতীয় ধান বেশি পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারে। এ জাতের ধান গাছগুলো মাঠের অন্য জাতের ধান গাছের চেয়ে অপেক্ষাকৃত লম্বা ও মোটা হয়। ধানের বাইলগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। জলাবদ্ধ জমি এমনকি বেশি পানিতে লড়াই করে টিকে থাকা যেকোনো ধানের চেয়ে এ ধান বেশি ফলনশীল। চাল চিকন হওয়ায় বাজারে এ জাতীয় ধানের দামও বেশি। এ ধানের রোগবালাই হয় কম। ফলে আবাদে উত্পাদন খরচও কম হয়।

এএসডি বাংলাদেশ এনজিওর পরিচালক সুবাস বিশ্বাস বলেন, ‘আশির দশকের দিকে নেপালে এ ধানের চাষ হতো। নেপাল থেকে বীজ এনে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে দেখা গেছে, আমন মৌসুমে ডোবা বা জলাবদ্ধ জমিতে এ ধানের ভালো ফলন হয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকজন কৃষক পরীক্ষামূলক এ ধান চাষ করে সফল হয়েছেন। উঁচু বা সমতল ভূমিতে চাষের মতো অনেক ধান আমাদের দেশে আছে। কিন্তু জলাবদ্ধ হাওর-বাঁওড়-খাল-বিলে চাষের মতো কোনো ধান নেই। আমাদের দেশে জলাবদ্ধতার কারণে অনেক জমি অনাবাদি থাকে। সেসব জমিতে অধিক পানি সহনশীল দোশতিন নামের জোড়া চালের এ ধান চাষ করে অনাবাদি জমি আবাদযোগ্য করে তোলা সম্ভব।’

ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. শাহ মো. আকরামুল হক বলেন, দুই চালের ধান এ অঞ্চলে এই প্রথম। এ ধানের নমুনা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার পর এ ধানের গুণাগুণ জানা যাবে।

গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘দুই চাল বিশিষ্ট ধান নিয়ে আমাদের কখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। জোড়া চালের ধানের নমুনা গবেষণা ইনস্টিটিউটে যদি এসে থাকে, তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। আমাদের অনেক জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান রয়েছে। জলাবদ্ধ ডোবা জলাশয়ে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে পারে, এমন কোনো ধান আমাদের নেই। আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় হাওর-বাঁওড়- খাল-বিল জলাবদ্ধ হয়ে অনেক জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকে। জোড়া চালের ধান যদি অধিক পানি সহনশীল হয়, তাহলে ওই সব এলাকায় এ ধানের চাষ করা সম্ভব হবে। আমরা পানি সহনশীল ধানের ভ্যারাইটি বের করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি।’ কালের কন্ঠ।।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *