হাবিপ্রবি থেকে মুজাহিদ মুয়াজ,
বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে হেমন্তের চমৎকার বেগুনী বা হালকা গোলাপি রঙের ফুল দেবকাঞ্চন গাছটির সবুজ পাতার ফাকে ফাকে চোখে পরবে হাবিপ্রবির সবুজ চত্বরে। হাবিপ্রবিতে নতুন পুরাতন মিলিয়ে বেশ কয়েকটি দেবকাঞ্চন গাছ রয়েছে, এর মধ্যে ডঃ ওয়াজেদ ভবনের সামনে দুটি দেবকাঞ্চন গাছ বেশ শোভাবর্ধন করছে। টিএসসির সামনেও একটি প্রকাণ্ড গাছ আছে এছাড়া একাডেমিক ১ ভবনের পাশে, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ভিসি-বাংলো সহ পুরো হাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে ডজন খানেক দেবকাঞ্চন গাছ দেখতে পাওয়া যায়।
দেবকাঞ্চন গাছটি বাংলাদেশের নিজস্ব গাছ হওয়ায় দেশের সর্বত্রই কমবেশি দেখা যায়। ঢাকার পার্কগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য লাগানো হয় দেবকাঞ্চন। বিশেষ করে রমনা পার্কের দক্ষিণ দিকে এ গাছের চমৎকার সারি রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের হাইকোর্ট-সংলগ্ন প্রাচীরের পাশেও এ গাছের লম্বা সারি দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে রাস্তার পাশে প্রায়শঃ দেবকাঞ্চন লাগানো হয়। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পাহাড়গুলোতেও দেবকাঞ্চন দেখতে পাওয়া যায়।
দেবকাঞ্চনের বৈজ্ঞানিক নাম Bauhinia purpurea/ Phanera purpurea, এটি Leguminosae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।দেবকাঞ্চন গাছের আকৃতি মাঝারি, উচ্চতা ৮-১০মিটার বা আরও বেশি হতে পারে, গাছের চুড়া বেশ ছড়ানো। পাতা মাথার দিকে দুভাগে বিভক্ত, অনেকটা উটের পায়ের খুরের মত, তাই ইংরেজিতে এই গাছের নাম ক্যামেল’স ফুট ট্রি। দেবকাঞ্চন পত্রঝরা উদ্ভিদ, শীতের শেষে পাতা ঝরে যায় আবার বসন্তে নতুন পাতার প্রাচুর্যে ডালপালা ভরে ওঠে।অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে দেবকাঞ্চন গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে,ডিসেম্বর পর্যন্ত গাছে ফুল থাকতে পারে। ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ডালগুলো হালকা বেগুনি ফুলে ভরে ওঠে। স্নিগ্ধ সৌরভ, সুগন্ধিতার সঙ্গে আকর্ষণীয় পাঁচটি বেগুনি পাপড়ির সমাহারে দেবকাঞ্চন হেমন্তের প্রকৃতিতে সৌন্দর্যের এক ভিন্নমাত্রা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করে।
দেবকাঞ্চন ফুলের পাপড়ি হালকা বেগুনী, মৃদু রক্তিম, গোলাপি বা সাদাটে হতে পারে। তবে হালকা বেগুনি রঙের দেবকাঞ্চনই বেশি চোখে পড়ে। ফুলগুলো গুচ্ছাকারে নয়, একটি ডগায় কয়েকটি করে ফোটে। পাপড়িগুলো ঘন সন্নিবেশিত নয়, কিছুটা বিচ্ছিন্ন। মাঝারি আকারের গাছগুলোতে সাধারনত শীতের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফুল থাকে। ফুল ছয় থেকে আট সেন্টিমিটার চওড়া, পাপড়ি পাঁচটি ফুলে মিষ্টি সৌরভ থাকে, সেই সৌরভে মুগ্ধ হয়ে কীটপতঙ্গ উড়ে আসে, তাতেই পরাগায়ণ ঘটে। হেমন্তের মাঝ নাগাদ শাখা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে।
দেবকাঞ্চনের শিমের মতো চ্যাপ্টা ফল হয়, শুঁটি ১০-৩০সে.মি. লম্বা। চৈত্রমাসে পাতাবিহীন গাছে ঝুলন্ত ফলগুলি সশব্দে ফেটে বীজ ছড়ায়। প্রতিটি ফলে ১২-১৬টি বীজ থাকতে পারে।দেবকাঞ্চন ফলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এদের বীজ নিক্ষেপের ক্ষমতা। অন্য কিছু উদ্ভিদের মত দেবকাঞ্চনও সর্বোচ্চ রেকর্ড দূরত্বে (১৫মিটার) তার বীজ চালিত করতে পারে, এজন্য বীজ অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়ে। বীজ থেকে সহজেই চারা গজায়।দেবকাঞ্চনের আদি নিবাস হিমালয়ের পাদদেশের আসাম প্রদেশে, তাই দেবকাঞ্চন ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব উদ্ভিদ।
দেবকাঞ্চনের অনেক ঔষধি গুণও রয়েছে। এগাছের ফুল, বীজ, মূল, বাঁকল, পাতা ইত্যাদি নানা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়, বিশেষ করে ডায়রিয়া, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, ক্ষত ও ব্যথানাশক হিসেবে এগুলোর ব্যবহার বেশ ফলপ্রসূ। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে প্রাচীন আদিবাসী সমাজে প্রথাগত চিকিৎসা হিসেবে দেবকাঞ্চনের ব্যবহার ছিল।
হাবিপ্রবির কৃষিবনায়ন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সফিকুল বারী জানান, “দেবকাঞ্চন লিগুমিনাস পরিবারের উদ্ভিদ হওয়ায় এরা মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করতে পারে, ফলে এ গাছটি অধিকহারে রোপণ করলে মাটির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করবে”। তিনি আরও জানান, “গোখাদ্য উৎপাদনকারি হিসেবেও এই উদ্ভিদের জুড়ি নেই। নেপালে এর পাতা গৃহপালিত পশু, গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে”।
পরিশেষে বলা যায়, সুন্দর পরিবেশ রক্ষায় ও নৈসর্গিক চিত্তবিনোদনের জন্য দেবকাঞ্চন গাছটি লাগানো যায়। এ গাছটি আমাদের দেশের নিজস্ব গাছ হওয়ায় খুব সহজে যেকোনো আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারে। তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু বিদেশী গাছের পরিবর্তে দেবকাঞ্চন প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গনে, রাস্তার ধারে, ফসলের আইলে বা পার্কগুলোতে লাগানোর জন্য সুপারিশ করা যেতে পারে।
(লেখকঃ ছাত্র ও সাংবাদিক, হাবিপ্রবি)