চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা
মো. মোশারফ হোসাইন, শেরপুর প্রতিনিধি:
চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা : শেরপুরের নকলায় যেদিকে দৃষ্টি যায়, শুধু বোরো ধানের সোনালী সমারোহ নজরে পড়ে। উপজেলার দিগন্তজুড়ে শুধু পাকা বোরো ধানের সোনালী মাঠ কৃষকের মনে আনন্দের সঞ্চার করেছে। এবার উপজেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলন দেখে কৃষক-কৃষাণীর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এবার উপজেলায় ১৩ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এ আবাদের উপর ভিত্তিকরে চাল উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৮ হাজার ১০১ মেট্রিকটন।
বিভিন্ন মাঠে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা কেউ ধান কাটছেন, কেউ আঁটি বাধছেন, কেউবা ধানের আঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন, কেউ কেউ ধান মাড়াই ঝাড়াই করছেন, কেউ আবার বিক্রি বা গুলাতে ধান উঠানোর জন্য ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন স্তরের কৃষি অফিসারদের একান্ত প্রচেষ্ঠা ও কৃষকদের নিরন্তর পরিশ্রমের ফলে এই মৌসুমের ধানে করোনা কালীন ক্ষতি কাটিয়ে কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষি অফিসার ও কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলায় বোরো ধান রোপনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর জমি, তবে অর্জন হয়েছে ১৩ হাজার ১২৫ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে অর্জন কমার কারন হিসেবে জানা যায়, কৃষকদের ভুট্টা চাষে উৎসাহিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া ও ভুট্টা চাষে উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় কৃষকরা গত বছরের তুলনায় এবার ভুট্টার আবাদ বেশি করেছেন। ফলে উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্জন ১২২ হেক্টর কমেছে।
ভুরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার সভাপতি মো. ছায়েদুল হক ও সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল উদ্দিনসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বোরো আবাদ বেশ ব্যয় বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল চাষে খরচ নেই বললেই চলে। তাই তারা ব্যয়বহুল বোরো আবাদ ছেড়ে ভুট্টাসহ অন্যান্য আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। তাছাড়া ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে তাদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। তাই এবছর ভুট্টার আবাদ অনেকে বেড়েছে। তবে যে সকল কৃষক বোরো আবাদ করেছেন তাদের উৎপাদন ও ধানের বাজার দাম দেখে কৃষকরে মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
বানেশ্বরদী ইউনিয়নের ভূরদী ব্লকে কর্মরত আসাদুল হক বাবু, বানেশ্বরদী ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার আশরাফুল আলম, টালকী ব্লকে কর্মরত সারোয়ার জাহান শাওন ও বাছুরআলগা ব্লকে কর্মরত উপসহকারী কৃষি অফিসার মশিউর রহমান, উপসহকারী কৃষি অফিসার আনোয়ার হোসেন, এম.এ সামাদ ও আলতাফ আলীসহ অনেক উপসহকারী কৃষি অফিসারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমের ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই, সংরক্ষণ ও ধানের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তাছাড়া কৃষি বান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক দেশের আবাদ যোগ্য কিন্তু অনাবাদি রয়েছে এমন প্রতি ইঞ্চি জমি কৃষি আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে তাঁরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
উপসহকারী উদ্ভিদ সংরণ কর্মকর্তা ফকির মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, চলতি বোরো মৌসুমের ধান কাটা থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি খরিপ-১ মৌসুমে আউশ ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কৌশলগত পদপে সমূহ বাস্তবায়ন করতে তাঁরা নিরলস কাজ করে চলছেন।
অতিরিক্ত কৃষি অফিসার কৃষিবিদ রোকসানা নাসরিন জানান, নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ, প্রতিরোধ ও প্রাদুর্ভাব জনিত কারণে সরকার ঘোষিত দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি কালীন সময়ে বিরাজমান দেশের অনেক এলাকা অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে, এমতাবস্থায় যাতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত না হয় তথা বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে ফসল উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষকদের কাছে হাজির হচ্ছেন সর্বস্তরের কৃষি কর্মকর্তারা। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে কৃষি অফিসারদের উপস্থিতি ও নিরলস সেবা দেওয়া দেখে বুঝার কোন উপায় নেই যে, দেশে নভেল করোনা ভাইরাস (কভিট-১৯) এর প্রদুর্ভাব হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, এ বছর নকলা উপজেলায় বোরো ধান রোপনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর জমি, তবে ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় ১২২ হেক্টর কমে অর্জন হয়েছে ১৩ হাজার ১২৫ হেক্টর। তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, উপজেলায় হাইব্রিড জাতের বিভিন্ন ধানের আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে, উফশী জাতের বিভিন্ন ধানের আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ৯৫ হেক্টরে ও স্থানীয় বা দেশীয় জাতের বিভিন্ন ধানের আবাদ করা হয়েছে মাত্র ৫ হেক্টর জমিতে। হাইব্রিড জাতের বোরো আবাদ হতে চালে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৪.৭৫ মেট্রিকটন হিসেবে মোট ৩৮ হাজার ১১৯ মেট্রিকটন, উফশী জাতের ধান হতে চালে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৩.৯২ মেট্রিকটন হিসেবে মোট ১৯ হাজার ৯৭২ মেট্রিকটন এবং স্থানীয় বা দেশীয় জাতের বিভিন্ন ধানের আবাদ হতে চালে লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ১.৯৪ মেট্রিকটন হিসেবে মোট ১০ মেট্রিকটন। কৃষি অফিসারের দেওয়া এ হিসেব মতে উপজেলায় চলতি বোরো আবাদে ৫৮ হাজার ১০১ মেট্রিকটন চাল উৎপাদন হবে। যা স্থানীয় চাহিদার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস ধারনা করে বলেন, বোরো আবাদের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় কৃষক ও কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সকলেই খুব খুশি। উপজেলার বিভিন্ন ব্লকের কৃষকদের প্রদর্শনী প্লটের নমুনা শস্য কর্তনে প্রাপ্ত ধানের হিসেব অনুযায়ী তিনি ধারনা করে বলেন, চলতি বোরো মৌসুমের বাকি সময়ে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে উৎপাদন বাড়তে পারে। তিনি আরও জানান, এবছর উপজেলা থেকে এক হাজার ৪০ টাকা প্রতি মণ হিসেবে এক হাজার ৮৩১ মেট্রিকটন বোরো ধান সরকারি ভাবে ক্রয় করা হবে। তাতে কৃষকরা বেশ লাভবান হবেন বলে তিনি মনে করেন।