কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ
বোরোধান চাষাবাদের শুরুতেই বিভিন্ন স্থান থেকে সেচ সংকটের খবর আসছে। পানির অভাবে, অনেক জমির মাটি ফেটে যাচ্ছে। ধান গাছ মারা গেছে। বোরোধান উৎপাদন সেচের ওপর নির্ভরশীল। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে সেচযন্ত্রে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় ২০ হাজার সেচ যন্ত্রের মালিক পল্লী বিদ্যুতায়ন র্বোডে আবেদন করেও বিদ্যুৎ সংযোগ পায়নি। অপরদিকে, ট্রান্সফরমারসহ বিভিন্ন বিদ্যুৎ যন্ত্রাংশ লাখ লাখ টাকা দিয়ে কৃষকরা কিনে বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় সেচের এই ভরমৌসুমে বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। এবার বিদ্যুতচালিত সেচ যন্ত্রের সংখ্যা হচ্ছে দুই লাখ ৫৯ হাজার ৪৪টি এবং ডিজেল চালিত পাম্প আছে ১৪ লাখ ২৫ হাজার ৯১৮টি। এখন গ্রামে বিদ্যুৎ প্রয়োজন ২ হাজার ২শত মেগাওয়াট। সরবরাহ হচ্ছে ১ হাজার ৫শত মেগাওয়াট। ডিজেল লাগছে ১১ লাখ মেট্রিক টন। বিদ্যুতের ব্যাপক লোডশেডিংয়ে সেচ কাজ মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও মিটার ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, ভৌতিক বিল, মিনিমাম চার্জ আদায়, রিডিং না দেখে বিল করা, গ্রাহকদের নোটিশ ছাড়া জরিমানা আদায়, সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, লোভোল্টেজ, সংযোগ বা পুনঃসংযোগে হয়রানির শিকার হচ্ছে কৃষকরা। এ গবেষণায় দেখা গেছে, এক কেজি বোরোধান উৎপাদন করতে তিনহাজার লিটার পানি লাগে। এই পানি মাটির গভীর থেকে উঠিয়ে প্রতি বিঘার জন্য প্রায় এক হাজার পাঁচশত টাকা সেচ যন্ত্র মালিকের খরচ হয়। কৃষকের খরচ হয় চার থেকে পাঁচ মণ ধান। এ জন্য সরকার প্রতি বিঘা সেচের জন্য ৩৫০ টাকা হারে কৃষককে র্ভতুকি দিচ্ছে। সর্বোচ্চ এক একরের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। সেচ কাজ জানুয়ারি থেকে শুরু হলেও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভর্তুকি দিয়েছে।
এবার বিদ্যুৎ সংযোগের অভাব, কৃষকের ট্রান্সফরমার ক্রয়, লোডশেডিং, পানির স্তর গভীরে যাওয়া, সেচ যন্ত্রের দাম বেশি, সনাতন পদ্ধতিতে সেচ দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে বোরো ধানের সেচ সংকট প্রকট। উন্নত পদ্ধতি এবং কিছু কৌশল অবলম্বন করলে অল্প সেচ দিয়ে ফসলের পানির চাহিদা পূরণ করা যায়। সেচের পানির বাস্পীভবন, অনুস্রবণ, চুয়ানো, শোষণ, অনুছিদ্র ইত্যাদি কারণে অপচয় হয়। সেচের পানির অপচয় রোধ করে কার্যকারিতা বাড়ানোর কিছু কৌশল এখানে উল্লেখ করা হলো ঃ
* সেচ নালা সম্ভব হলে পাকা করা উচিত। অন্তত নালা এঁটেল মাটি দিয়ে লেপে দেয়া যেতে পারে। সেচ নালায় পলিথিন কাগজ বিছিয়ে দিলেও পানি মাটিতে অনুস্রবণ, চুয়ানি ও শোষণ বন্ধ হবে। ফলে পানির অপচয় হবে না।
* পুরানো সেচ নালার ছিদ্র, ভাঙা, পাড় উঁচুসহ যাবতীয় সংস্কার ও মেরামত করলে পানি অনত্র যেতে পারবে না।
* হুজ পাইপ বা প্লাস্টিক পাইপ দিয়ে সেচ দিলে পানি বাস্পীভূত হয় না, মাটির নিচে যেতে পারে না, নালা তৈরি করতে হয় না, পানি দ্রুত জমিতে সরবরাহ করা যায়, সম্পূর্ণ জমিতে সুষমভাবে পানি পৌঁছে ও পানি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একবার পাইপ কিনলে কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়।
* এডব্লিউডি বা চুঙ্গী পদ্ধতিতে অল্প পানি দিয়ে গাছের চাহিদা পূরণ করা যায়। ৩০ সেমি. লম্বা ১০ সেমি. ব্যাসের প্লাস্টিকের বা বাঁশের পাইপে ২০ সেমি. ছিদ্র করতে হবে। পাইপটি ৫০ সেমি. পরপর ৩ সূতি ব্যাসের ড্রিল বিট দিয়ে ছিদ্র করতে হবে। পাইপটি ধান ক্ষেতের ২০ সেমি. মাটির নিচে ১০ সেমি. মাটির উপরে রাখতে হবে। এক একর ধান ক্ষেতের ২/৩ জায়গায় গর্ত করে পাইপ খাঁড়াভাবে বসাতে হবে। এতে গাছে পানির চাহিদা বুঝে পানি দিলে ৩০-৩৫ ভাগ পানি কম লাগে।
* সঠিক পদ্ধতিতে সেচ দেয়া। যেমন- মাঠ ফসল ও উদ্যান ফসলে নালা পদ্ধতিতে সেচ দিলে পানি কম লাগে।
* গাছের চাহিদার সময় সেচ দিতে হয়। যেমন বোরো ধানে কুঁশি গজানোর আগে জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হয়। কুঁশি গজানোর পর পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়। এতে কুঁশির পরিমাণ বাড়ে। থোড় আসার সময় জমিতে পানি বেশি রাখতে হয়। এতে ধানের চিটা কম হয়। ধান পরিপক্ক হওয়ার সময় থেকে জমি শুকনা রাখতে হয়। অন্যথায়, গাছ হেলে পড়ে ধানের ক্ষতি হয়।
* বিদ্যুৎ ও ডিজেল সংকট হলে ঢেঁকি কলে সেচ দেয়া যেতে পারে। এতে খরচ কম ও সহজ পদ্ধতিতে একজন মানুষ পা দিয়ে পানি উঠাতে পারে। ঢেঁকিকল দামে সস্তা। অনেক দিন ব্যবহার করা যায়। প্রতি মিনিটে ৭৫ লিটার পানি তোলা যায়। মেরামত খরচ নেই বললেই চলে। পরিবারের সবাই পানি উঠাতে পারে। সেচের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না। এক মৌসুমেই মোট খরচের প্রায় তিনগুণ আয় করা যায়।
* রাতে সেচ দিলে পানি বাস্পীভুত হয়ে বাতাসে কম যাবে। অপরদিকে, রাতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ বেশি থাকে।
* যতটুকু সম্ভব সেচ নালার দৈর্ঘ্য কমাতে হবে। এতে মাটিতে পানি শোষণের পরিমাণ কম হয় এবং বাস্পীভূত কম হয়।
* একই নলকূপের অধীনের জমিগুলো সমতল হলে সব জমিতে সমান পরিমাণ পানি সরবরাহ হবে।
* সেচ-নালা ফসলের জমির দিকে ঢালু রাখতে হবে। সেচ নালা সরু করলে পানি বাস্পীভূত কম হয়।
* মাটির গঠন ও মাটির কণার আকার আকৃতির ভিত্তিতে সেচ দিতে হবে। এতে পানির পরিমাণ অনুসারে সেচ দেয়া যায়।
* জমির আইল শক্ত করে বাঁধা উচিত। সেচ দেয়ার সময় মাঝে মধ্যে সেচ নালা পরীক্ষা করতে হবে। ছিদ্র হলে সেঙ্গ সঙ্গে ছিদ্র বন্ধ করতে হবে।
* আগাছা দমনের পর সেচ দিতে হয়। এতে আগাছা পানি শোষণ করতে পারে না।
* মাটিতে জৈব পদার্থ দিতে হয়। জৈব পদার্থ মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে পানি মাটির বেশি নিচে যাবে না।
পানির অভাবে ধানের ফলন কমে, চিটা হয় ও দানা ছোট হয়। সেচের অভাবের জন্য এবার বোরোর লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৮৭ লাখ মেট্রিক টন অর্জন না হওয়ার আশংকা রয়েছে। এতে দেশে ব্যাপক খাদ্যঘাটতির আশংকা আছে।
লেখক : কৃষি সাংবাদিক ও কলেজ শিক্ষক
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম