কৃষিবিদ মোঃ নূরুল হুদা আল মামুন*
বর্তমান সময়ে বৈরী জলবায়ু ও এর সম্ভাব্য প্রভাব বাংলাদেশ সহ বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। তবে আমাদের দেশে এটি আরো বেশী আলোচিত এ জন্য যে, দেশের অবস্থান ও ভৌগলিক কারণে এর প্রভাব আমাদের বেশী ক্ষতিগ্রস্থ করবে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১০ (এষড়নধষ ঈষরসধঃব জরংশ ওহফবী ২০১০) অনুসারে বাংলাদেশের নাম শীর্ষ তালিকায় থাকায়,এ আশংকা আরো প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাত হানার আশংকা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। অন্যান্য খাতের চেয়ে কৃষিই হচ্ছে বৈরী জলবায়ুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সংবেদনশীল। বাংলাদেশের যেখানে প্রায় শতকরা ৩৫ ভাগ জিডিপি আসে কৃষি ও কৃষি ব্যবসা থেকে, সেখানে জলবায়ুর বৈরী আচরণে কেবল আমাদের কৃষিই নয় ,আমাদের অর্থনীতিকে ও হুমকির দ্বার প্রান্তে উপনীত করেছে। বৈরী জলবায়ুর হুমকি থেকে কৃষিকে তথা আমাদের নিজেদের বাঁচাতে হলে সরকার থেকে শুরু করে কৃষিজীবী পর্যন্ত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর জলবায়ুর পরিবর্তন নির্ভর করে। এর মধ্যে যেমন আছে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, তেমন আছে বর্হিজগতের প্রভাব । শেষোক্ত কারণটির মধ্যে থাকতে পারে সৌর বিকিরণের মাত্রা,পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক-পরিবর্তন কিংবা সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান। বর্তমান সময়ে মনুষ্যজনিত গ্রীন হাউজ গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। মানবসমাজের কর্মকান্ডের ফলে বেশী বেশী করে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন গ্যাস এবং ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন গ্যাস নি:সরণের ফলে পৃথিবীকে বেষ্টনকারী বায়ুমন্ডলের ওজন স্তরের মধ্যে তাপ আটকে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার দরুণ জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায়,হিমালয় পর্বতের হিমবাহগুলো গলে যাচ্ছে, কিন্তু পরে আর তেমন বরফ জমছে না। সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী হিমালয় পর্বতের হিমবাহগুলো বছরে ২৩ মিটার করে কমে যাচ্ছে। ইউরোপে আল্পস পর্বতমালায়,একই উপর্সগ দেখা দিয়েছে । একই সময়ে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে বেশিমাত্রায় বরফ গলছে। আর এই বরফ গলে বাড়তি পানি সমুদ্রে মিশে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শুধু যে বেশি বেশি করে বরফ গলে যাচ্ছে ও সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে তাই নয়,পৃথিবীর বহু শুষ্ক অঞ্চল উষ্ণতর হচ্ছে,আবার বিষুবীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে আর্দ্র এলাকাগুলো আরো আর্দ্রতর হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বাংলাদেশ ঃ বাংলাদেশের প্রায় পনের কোটি মানুষ সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হতে চলেছে। ইতিমধ্যে এই পরিবর্তনের কারণে বন্যা, অনাবৃষ্টি,অতিবৃষ্টি, খরার মত ঘটনা ঘটছে। খরার কারণে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২১.৮ লক্ষ মেট্রিক টন এবং বন্যা বা অতি বর্ষণের ফলে প্রায় ২৩.৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ৯৩ টি দূর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। এসময়ে দেশের কৃষি ও অবকাঠামো খাতে ৫৯০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। এছাড়া ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশেষ করে বন্যার কারণে ১,০৬,৩০০ হেক্টর আবাদি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব অল্প হলেও পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন স্থানে পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। বঙ্গোপসাগরের লোনা পানিতে এর মধ্যে ৮ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি লবনাক্ত হয়ে পড়েছে। নোবেল বিজয়ী জাতিসংঘের ইন্টার-গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসির মতে ,২১০০ সালের অনেক আগেই আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা এক মিটার বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ জমি লবণাক্ত পানি দ্বারা তলিয়ে যাবে। এতে ১৩ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, যার পরিমাণ প্রায় দুইকোটি। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল পানির নিচে ডুবে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের কৃষি ও। ফলে জলবায়ু উদ্বাস্থু— হয়ে পড়বে এ অঞ্চলের অগনিত মানুষ। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে ঘুর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও ঘনত্ব বাড়বে। সিডর, আইলা ও নার্গিসের মতো ঘুর্ণিঝড় আগে ১০ থেকে ১৫ বছর পর পর আসতো। এখন প্রায় প্রতিবছর আসছে এবং এগুলোর গতি ও বাড়বে।
আমাদের দেশের কৃষকদের চাষাবাদের সময় সূচী সম্পর্কে একটা পূর্ব প্রস্তুতি ছিল ; কোন সময়ে কী ফসল তারা করবে, তার প্রস্তুতি নিতে পারত। এখন সবই অনিশ্চয়তায় ভরা। ফলে অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির শিকার হচ্ছে আমাদের কৃষকেরা। তাদের প্রচলিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আর কাজে লাগছে না। ফলে মারাত্বক ক্ষতির শিকার হচ্ছে আমাদের কৃষিখাত। জলবায়ুর বৈরী আচরণে আমাদের কৃষি খাতে আরো প্রত্যক্ষ যে সব প্রভাব পড়বে বলে আশংকা রয়েছে তা নিম্নরুপ ঃ
১.ফসলের উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব ঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের ফলনের উপর পড়বে মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব। কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধির ফলে সালোক সংশ্লেœষণ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও আবহাওয়া এবং বর্ধিত তাপমাত্রার কারণে দানাজাতীয় ফসলের প্রোটিনের পরিমান কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে,অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ফলে উদ্ভিদের নাইট্রোজেন,আয়রণ ও জিংক গ্রহনের ক্ষমতা হ্রাস পায় অর্থাৎ কৃষিজাত দ্রব্যের গুনাগুনের ওপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। আমাদের মতো পুষ্টি ঘাটতির দেশে দানা ফসলের গুণাগুণ কমে যাওয়া আসলেই পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকির ব্যাপার । তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উফশী ধানের ফলন কমে যাবে এবং গম ফসলে রোগের আক্রমণ বাড়বে। বাংলাদেশে বর্তমানের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে গম চাষ সম্ভব হবে না। ধান গাছের কচি থোড় থেকে ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশী হলে ধানে চিটা হবে। বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, ২১০০ সাল নাগাদ ফসলের ফলন ৩০% হারে কমবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন ৮.৮% এবং গমের উৎপাদন ৩২% হারে কমবে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় দেখা দেবে চরম অনিশ্চয়তা ।
২.আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস ঃ ষাটের দশক থেকে এখন পর্যন্ত সাইবেরিয়া অঞ্চলে প্রায় তিন ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ রির্পোট মতে সেখানকার বরফ গলে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়বে বলে উল্লেখ করা হয়। পক্ষান্তরে তাপমাত্রার এ পরিবর্তন চলতে থাকলে বরফ গলে কমপক্ষে এক মিটার পর্যন্ত সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। আর এর ফলে বাংলাদেশ সহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ধান উৎপাদন ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর নিচু জমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ফলস্বরুপ,ধানের জমি হ্রাস পাওয়ায় আমাদের দেশ সহ সারাবিশ্বে উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশে খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে।
৩. মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয় ও ভূমির ধ্বস ঃ জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির উপরিস্তরের ভূমি ক্ষয় বাড়বে, বাড়বে ভূমি ধ্বস ও। ফলে মাটির উপরিস্তরের পুষ্টিমানের অবক্ষয় হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাবে। সেই সাথে অধিক তাপমাত্রার জন্য জৈব পদার্থের পরিমাণও কমিয়ে দেবে। এছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাটিতে খনিজ উপাদানের পরিমাণ বাড়তে থাকবে যা ফসলের জন্য কমবেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের জমিতে যেখানে জৈব পদার্থের পরিমাণ এমনিতেই ২ শতাংশের কম। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রভাব আরো প্রকট হবে। কেননা অধিক আদ্রর্তা ও তাপমাত্রায় মাটির জৈব পদার্থের বিয়োজন বেশি হবে, ফলশ্র“তিতে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ কমবে।
৪. ফসলের রোগব্যাধি ও আগাছা বৃদ্ধির কারণে ফলন হ্রাসঃ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট অধিক তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতায় আগাছার বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারে সহায়ক। অধিক তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতায় ফসলের পোকমাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে কিছুটা অধিক আর্দ্রতার সাথে সাথে কিছুটা তাপমাত্রা, ছত্রাক ও ব্যকটেরিয়ার দ্রুত বংশ বৃদ্ধি ঘটানোর সাথে সাথে জীবাণুর রোগ সৃষ্টির সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার ফলে কিছু এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে যা বাতাসে আর্দ্রাতার পারিমাণ বাড়িয়ে দেবে। অতিরিক্ত তাপ এবং আর্দ্রতা গাছের ছত্রাক রোগ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে । একই ভাবে পোকামাকড় ও বিভিন্ন রোগের বাহক পোকার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। যেমন বোরো মৌসুমে যদি রাতে ঠান্ডা ও কুয়াশা পড়ে ও ধানের পাতায় পানি জমে থাকে এবং দিনে গরম পড়ে অর্থাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যায় তবে ব্লাইট রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। অধিক আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার কারণে শীথ ব্লাইট রোগের আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের দেশে সত্তরের দশক থেকে এখন পর্যন্ত ফসলের রোগের সংখ্যা পাঁচগুন বৃদ্ধি পেয়েছে আর এতে আবহাওয়ার প্রভাবকেই অনেকে দায়ী করেছেন।
৫.ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবঃ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীকে বেষ্টনকারী ওজোন স্তরের যে ক্ষয় হয়, তার ফলে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির রেডিয়েশন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। যা উদ্ভিদের শরীরতত্ত্বে প্রভার ফেলে কৌলিতাত্ত্বিক ভিন্নতা সম্পন্ন পরিবর্তিত (মিউটেন্ট) জাত সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি ভাবে পোকামাকড় বা রোগজীবাণুর আক্রমণাত্বক প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
৬. মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ঃ বাংলাদেশের উপকূলীয় প্রায় ১৩ শতাংশ এলাকায় বিশেষ করে বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার মাটিতে লবণাক্ততার প্রভাব দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে উপকূলীয় বন্যার ফলে সরাসরি লবণাক্ত পানি দিয়ে জমি ডুবে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে মাটির নিচে থাকা লবণাক্ত পানির ওপরের দিকে বা পাশের দিকে প্রবাহিত হওয়ার কারণে মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়,যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। ১৯৭৩ সনে ১৫ লাখ হেক্টর জমি মৃদু লবনাক্ততায় আক্রান্ত হয়,যা ১৯৯৭ সালে ২৫ লাখ হেক্টরে দাঁড়ায়। বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর। কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে,যা ভবিষ্যতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিমিত বৃষ্টিপাতের অভাবে ২০৫০ সালে ১৬ শতাংশ এবং ২১০০ সালে ১৮ শতাংশ উন্নীত হবে বলে আশংকা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের বিরাট একটা অংশের মাটি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হবে যা উপকূলীয় এলাকায় ফসল চাষের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৭.চাষাবাদের উপর প্রভাব ঃ জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রের পানিকে উত্তপ্ত করবে। যা বৃষ্টিপাতের ধারাকে প্রভাবিত করবে। পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরণ ধান উৎপাদনকে বাধাগ্র¯ত করবে। শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য ধান রোপণ এবং কর্তনের সময় দেরি হবে। যার ফলে ধানের ফলন কমে যাবে। তাছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরায় আক্রান্ত হয়। গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে গড় বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটিতে পানি শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা গাছের ক্ষতি করে। কম বৃষ্টিপাত এবং অধিক হারে মাটি থেকে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার ফলে কৃষি ক্ষেত্রে খরার প্রভাব দেখা যায়। দেশে বিভিন্ন মাত্রার খরায় আক্রান্ত ৮৩ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমির শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়। এছাড়াও খরা আউশ ও বোরো ধান, পাট ,ডাল,তেল ফসল,আলু,শীতকালীন সবজি এবং আখ চাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কাঁঠাল,লিচু,কলা ইত্যাদি ফলের গাছ অতিরিক্ত খরায় মারা যায়। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে নদী-নালার নাব্যতা হ্রাস এবং গাছের প্রস্বেদনের হার বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে। আকস্মিক বন্যা ও জলোচ্ছাসের কারণে দেশের ফসলের মারাত্বক ক্ষতি হবে। প্রতি বছর হাজার হাজার একর পাকা বোরো ধান আক¯িমক বন্যায় আক্রান্ত হয়। দেশের উত্তর-পুর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গমিটারও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ১ হাজার ৪ শত বর্গকিলোমিটার এলাকা এ ধরণের আক¯িমক বন্যার শিকার হচ্ছে।
৮.ফসলের উৎপাদন খরচের উপর প্রভাবঃ জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্নভাবে সেচের পানি ব্যবহারের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও সূর্যালোকিত আবহাওয়ায় ফসলের প্রস্বেদনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে গাছের পানি ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে ,ফলশ্র“তিতে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচ পানির প্রাপ্যতা নির্ভর করে বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাতের ওপর। কম বৃষ্টিপাতের ফলে খরা প্রবণ এলাকার ভূনিম্মস্থ পানির স্তর আরো নেমে যাবে,যার ফলে খাবার পানি ও সেচের পানির অভাব দেখা দেবে। বর্তমান বাংলাদেশের মোট সেচ এলাকার শতকরা ৮০ ভাগ জমি ভূনিম্মস্থ সেচ র্নিভর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূগর্ভস্থ ও ভূ উপরিস্থ পানির পরিমাণ কমে যাবে। ফলে আরো গভীর করে নলকূপ স্থাপন করতে হবে যা সেচ খরচ তথা ফসলের উৎপাদন খরচকে আরো বাড়িয়ে দেবে।
৯.হুমকির মুখে মৎস্য খাতঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৎস্য খাত হুমকির মুখে পড়বে। পানির তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এর বেশি হলে চিংড়ির মৃত্যুহার বেড়ে যায়। এই তাপমাত্রায় অনেক মাছের রোগ ব্যাধি বৃদ্ধি পায়। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির সহায়তায় ’সাসটেইনেবল এনভারনমেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কর্মসূচি’ কর্তৃক ২০০২-২০০৩ সালের প্রকাশিত তথ্য মতে , বিগত ২০ কিংবা ৩০ বছর পূর্বে বাংলাদেশে যে ধরনের মাছ পাওয়া যেত বর্তমানে তার বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির মুখোমুখি।
১০. জীব বৈচিত্রের উপর প্রভাবঃ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের ফলে বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরির্বতন হচ্ছে তাতে পৃথিবীর অনেক জীববৈচিত্র পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিশ্বের তাপমাত্রা১.৫ হতে ২.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ২০-৩০ শতাংশ গাছপালা ও পশু পাখির জীবনের উপর ভয়াবহ ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে। তথ্যানুযায়ী যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ, তাহলো ২০৮০ সালের মধ্যে ১১০ থেকে ৩০০ কোটি মানুষ ভয়াবহ জল সংকটে পড়বে এবং বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পতিত হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০টি প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। বিপন্ন প্রাণীসমূহের মাঝে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার,চিতাবাঘ, হাতি,অজগর সাপ,কুমির,ঘড়িয়াল ইত্যাদি। বিগত শতাব্দীতেই বাংলাদেশে ১৯টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো গন্ডার,বুনো মোষ,কালো হাঁস,নীলগাই,রাজশকুন ইত্যাদি। কেউ কেউ মন্তব্য করেন এই জনপদে ২৭ টি বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে ও ৩৯ টি প্রজাতি বাংলাদেশ হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় ঃ বৈশ্বিক জলবায়ুর বৈরী প্রভাবের কারণে আগামী সময়গুলোতে কৃষি তথা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার ওপর চ্যালেঞ্জ বাড়তে থাকবে সন্দেহ নেই। আর এ বিরুপ প্রভাবকে প্রতিহত করতে আবহাওয়ার মতো কৃষির ক্ষেত্রে পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তুলে বৈরী জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে বাস্তব সম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ুর বৈরী প্রভাবকে প্রতিহত করা সম্ভব না হলেও এর সাথে যেমন আমাদের অভিযোজন ঘটাতে হবে, তেমনি মানব সৃষ্ট কারণ গুলো নির্মূল করতে হবে। দিবানিশির এ লড়াইয়ে সমন্বিতভাবে নামতে হবে ব্যক্তি,সমাজ,প্রতিষ্ঠান,সরকার হতে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় পর্যন্ত সবাইকে। এজন্য স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। যেমনঃ (১) বৈরী জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানোর মত (লবনাক্ততা,বন্যা,খরা,জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপ সহিষ্ণু) ফসলের আরো জাত উদ্ভাবন ও আবাদ বাড়াতে হবে। (২) নতুন শস্যপর্যায় ও অভিযোজন কৌশলের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করতে হবে। (৩) অভিযোজন কৌশল ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে কৃষিজীবী সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। (৪) পরিবেশ বান্ধব সমন্বিত ফার্মিং সিস্টেমের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে (৫) নদী গুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। (৬) উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (৭) পরিবেশের জন্য হুমকি হয় এমন কর্মকান্ড পরিহার করতে হবে। (৮) নেদারল্যান্ডসে পুরো সমুদ্র উপকূল এমন ভাবে ড্যাম দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে,যাতে সমুদ্র থেকে নয় মিটার নিচেও জমিজমা ঘরবাড়ি আছে। আমাদের সমুদ্র উপকূলে এমনি ভাবে ড্যাম দিয়ে আটকে দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে । (৯) এছাড়া এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে,দেশের এক-চতুর্থাংশ যদি ডুবে যায় তাহলে সেখানকার লোকজনকে দেশের কোথায় সরিয়ে নেয়া যাবে। কত লোক সরিয়ে নেয়া যাবে,তাদের কর্মসংস্থান,বাসস্থান এবং খাদ্য ঘাটতি কিভাবে মেটানো যাবে এনিয়ে সুদূর প্রসারী মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। (১০) অন্যদিকে, আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপযুক্ত কর্মসূচি সরকারকে হাতে নিতে হবে আর জনগণকেও সেই সাথে আন্তরিক হতে হবে তা বাস্তবায়নের জন্য।
পরিশেষে বলা যায়,দেশের প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি,খাদ্য ও অবকাঠামো সহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করে,গবেষণার মাধ্যমে বৈরী জলবায়ুর সাথে অভিযোজন ক্ষমতা সম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়ন ঘটানোর মাধ্যমে আমাদের কৃষির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এখন সময়ের দাবী।
——
লেখকঃ কৃষি বিজ্ঞানী ও পিএইচডি গবেষক
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম