Site icon

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় নয়া ফসল: কাসাভা

আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ*

কাসাভা হলো উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের আলুজাতীয় ফসল যা পৃথিবীর প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় । রোগজীবানু ও পোকামাকড়ের আক্রমন প্রতিরোধি এ ফসল সহজেই অনুর্বর জমি ও খরা প্রবন এলাকায় চাষ করা যায় । কাসাভার সাথে সাথী ফসল হিসাবে অন্যান্য ফসল চাষ করা যায়, সারা বছর ধরেই ফসল সংগ্রহ করা যায় এবং তুলনামূলকভাবে উৎপাদন খরচ অনেক কম । তাই শর্করা সমৃদ্ধ এ ফসল সারা পৃথিবীতে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । বর্তমানে মানুষের পাশাপাশি পশু খাদ্য এবং স্টার্চ ও সুক্রোজ উৎপাদনের জন্য বানিজ্যিকভাবে কাসাভা চাষ করা হচ্ছে।

কি আছে এতে: কাসাভায় সাধারনভাবে ৩০-৪০ ভাগ শর্করা , ১-২ ভাগ প্রোটিন, এবং ৫৫-৬০ ভাগ জলীয় অংশ বিদ্যমান । আলুর তুলনায় কাসাভাতে দ্বিগুনেরও বেশী শর্করা থাকায় ইহা আলুর চেয়ে আনেক বেশী পুষ্টিকর । যেখানে আলুতে ১৮ ভাগ শর্করার মাত্র ১৬.৩ ভাগ স্টার্চ হিসাবে থাকে সেখানে কাসাভার ৪০ ভাগ শর্করার ৯০ ভাগই স্টার্চ হিসাবে থাকে । এছাড়াও কাসাভাতে ক্রুড ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও ভিটামিন সি উল্লেখযোগ্য পরিমানে পাওয়া যায় ।

কোথায় চাষ হয়: পৃথিবীর উৎপন্ন কাসাভার ৬০ ভাগ মানুষের খাদ্য, ২৫ ভাগ পশুখাদ্য এবং বাকীটা স্টার্চ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় । আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এ ফসল মানুষের খাবারের অন্যতম প্রধান উপাদান । ল্যাটিন ও দক্ষিন আমেরিকায় মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবেও কাসাভা ব্যবহৃত হয় । আফ্রিকার নাইজেরিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, জায়ার, মোজাম্বিক, ঘানা ও জায়ারে সবচেয়ে বেশী কাসাভা চাষ হয়। এশিয়াতে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে কাসাভার চাষ হয় । এসব জায়গায় মানুষের খাবারের পাশাপাশি স্টার্চ কারখানার কাচামাল হিসাবে কাসাভার ব্যবহার বেশী লক্ষ্য করা যায় ।

এলো কোথা থেকে: প্রায় ৭০০০ বছর পূর্বে কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলায় কাসাভা চাষের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় । তাই দক্ষিন আমেরিকাকেই কাসাভার উৎপত্তিস্থল হিসাবে মনে কর হয় । পনের শতকে স্পেনিয় বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা মধ্য আমেরিকায় এর চাষ সম্প্রসারিত হয় । ১৬ শতকের শেষের দিকে পূর্তগীজরা কাসাভা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে নিয়ে আসে । এশিয়াতে প্রথম ফিলিপাইনে স্পেনিয়রা মেক্সিকো থেকে কাসাভা নিয়ে আসে যা পরবর্তীতে পাশ্ববর্তী দেশসমূহে ছড়িয়ে পড়ে । ১৮ শতকের শুরুতে পূতগীজদের দ্বারা ভারতে কাসাভার আগমন ঘটে । জানা যায় বাংলাদেশে ১৯ শতকের মাঝামাঝি জনৈক খ্রীষ্টান মিশনারীর মাধ্যমে মধুপুর আঞ্চলে প্রথম কাসাভা চাষ করা হয়।

জাত: কাসাভার অনেকগুলো প্রচলিত ও উন্নত জাত রয়েছে । কৃষকরা খাবার ও বানিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যের ভিত্তিতে জাত নির্বাচন করে থাকে । খাবারের জন্য অনেক অঞ্চলে মিষ্টি জাতের কাসাভা চাষ করা হয় । ভারতে কাসাভার জনপ্রিয় হাইব্রিড জাতগুলো হলো M-4, H-97, H-165,H-226, H-1687, H-2304 I S-856। ইন্দোনেশিয়ায় ADIRA-1,2,3,4 থাইল্যান্ডে RAYONG-1,2,3,60 ফিলিপাইনে PR-C 13,24,62 এবং চীনে SC-201,205,124জাতগুলো জনপ্রিয় । নাইজেরিয়ায় TMS-3001,30572,50395,30555এবং কলম্বিয়ায় M.Col.-2215,1684, M.BRA-5,12 জাতগুলো উল্লেখযোগ্য ।

চাষের যত নিয়ম কানুন:

মাটি: উষ্ণ ও নাতিষিতোষ্ণ অঞ্চল কাসাভা চাষের জন্য উপযোগী । অনুর্বর পাহাড়ী মাটি কিংবা বালি মাটি যেখানে অন্য কোন ফসল ফলানো যায় না সেখানেও কাসাভা চাষ করা যায় । তবে এ ফসল জলাবদ্ধতা ও উচ্চ লবনাক্ততা সহ্য করতে পারে না ।

জলবায়ু: এটি একটি খরা সহনশীল ফসল । যেখানে ৬ মাস পর্যন্ত খরা বা শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করে সেখানেও কাসাভা সহজে চাষ করা যায় । তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রীর সেন্টিগ্রেডের নিচে কাসাভা ভালো হয় না । উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড । সমুদ্রপৃষ্ট হতে ২৩০০ মিটার উপরেও কাসাভা চাষ করা যায় ।

বংশবৃদ্ধি: গাছ লাগানোর জন্য বীজ কিংবা কাটিং উভয়ই ব্যবহার করা যায় । বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য পরিপক্ক কান্ডের কাটিং ব্যবহার করা হয় । কাসাভা সংগ্রহের সময় সুস্থ্য সবল ও রোগমুক্ত কান্ডগুলো কেটে পরবর্তী বছর লাগানোর জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষন করতে হয় । লাগানোর সময় কান্ডকে ১৫-২০ সেমি করে কেটে সোজা করে লাগাতে হবে । প্রতিটি কাটিং এ কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টা নোড থাকতে হবে ।

জমি তৈরি: সাধারনত জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না । তবে বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য জমি চাষ করা যেতে পারে। অধিকাংশ জায়গায় পিট তৌরি করে কাসাভার কাটিং বা সেট লাগানো হয় । পাহাড়ী এলাকায় এটি একটি সহজ ও সুবিধাজনক পদ্ধতি । তবে পিটগুলো মাটি থেকে একটু উপরের দিকে উঠানো হলে ফলন ভালো পাওয়া যায় ।

লাগানোর নিয়ম: প্রতি হেক্টর জমিতে ১০,০০০ গাছ লাগানো যায় । একটি গাছ থেকে অন্য গাছের দূরুত্ব ৭৫ থেকে ৯০ সেমি রাখতে হবে । কাটিং মাটিতে লাগানোর সময় ২০ সেমি মাটির নিচে এবং ৫ সেমি মাটির উপরে থাকতে হবে । সাধারনত ১৫-২০ দিনের মধ্যে কাটিং থেকে নতুন কুশি বের হয় । যেসব কাটিং থেকে কুশি বের হবে না সেগুলো তুলে ফেলে সেখানে ৪০ সেমি আকারের নতুন কাটিং লাগাতে হবে ।

লাগানোর সময়: সারা বছরই গাছ লাগানো যায় । তবে সাধারনত বর্ষার শুরুতে কাসাভার কাটিং লাগানো ভালো । আমাদের দেশে এপ্রিল – মে মাস কাসাভা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ।

সার ব্যবস্থাপনা: তেমন কোন সার প্রয়োগ করতে হয় না । তবে বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ১৮০-২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫-২২ কেজি ফসফরাস এবং ১৪০-১৬০ কেজি পটাসিয়াম প্রয়োগ করলে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যায় ।

সেচ: সাধারনত সেচের প্রয়োজন হয়না । তবে কাটিং লাগানোর পর গাছ গজানোর জন্য ৩-৫ দিন অন্তর অন্তর কমপক্ষে ২ বার সেচ দিতে হবে । দীর্ঘদিন খরা অবস্থা বিরাজ করলে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এতে ফলন বৃদ্ধি পায় ।

আন্তঃপরিচর্যা: গাছ লাগানোর পর এক মাস অন্তর অন্তর গোড়ার আগাছা পরিস্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন ব্যাপক বৃদ্ধি পায় । যদিও কাসাভায় রোগবালাই ও পোকামকড়ের আক্রমন খুবই কম তথাপিও এক ধরনের মাকড়ের আক্রমনে অনেক সময় ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে । সবসময় রোগবালাই ও পোকামাকড় মুক্ত কাটিং লাগাতে হবে এবং মাকড়ের আক্রমন থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হলে আক্রমন দেখা দেবার সাথে সাথে মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে । অনেকসময় ইঁদুর মাটির নিচের কাসাভা খেয়ে বেশ ক্ষতি সাধন করে থাকে । এজন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে হবে ।

আন্তঃফসল চাষ: আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ৯০ ভাগ কাসাভা জমিতে আন্তঃফসল হিসাবে ডালজাতীয় ফসল ও শাক-সবজি চাষ করা হয় । ভারতে কাসাভার সাথে আন্তঃফসল হিসাবে সীম, চীনাবাদাম, মটর, পেঁয়াজ ও শাক-সবজি চাষ করা হয় । ইন্দোনেশিয়ায় কাসাভার সাথে ধান ও ভূট্রা চাষ করা হয় । মালেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে নারিকেল, পামওয়েল ও রাবার বাগানে আন্তঃফসল হিসাবে কাসাভা চাষ করা হয় । আন্তঃফসল চাষের কারনে কাসাভার ফলনের তেমন কোন ক্ষতি হয় না । তবে এক্ষেত্রে গাছের ঘনত্ব কিছুটা কমিয়ে দিলে চাষে সুবিধা হয় ।

ফলন: সাধারনত হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ টন ফলন পাওয়া যায় । তবে ভালো ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাত চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৫৫ থেকে ৬০ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায় ।

গুদামজাতকরন: গুদামজাতকরনের সীমাবদ্ধতা কাসাভা উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সমস্যা । শরীরবৃত্তিয় ও অনুজীবিয় পরিবর্তন এবং বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকের আক্রমনের কারনে দ্রুত পচনশীল কাসাভা সাধারনত গুদামজাত করে সংরক্ষন করা যায় না । তবে উত্তোলন না করে গাছসহ মাটির নিচে রেখে দিলে কাসাভা নষ্ট হয় না । এজন্য কৃষককে তার প্রয়োজনমতো জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করতে হবে এবং সংগ্রহের কয়েক দিনের ভিতরই ব্যবহার কিংব প্রক্রিয়াজাত করতে হবে । আফ্রিকাতে কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মতো ধীরে ধীরে জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করে । অথবা কাসাভা সংগ্রহের পর টুকরো টুকরো করে রোধে শুকিয়ে সংরক্ষন করে থাকে । স্টার্চ উৎপাদনের জন্য কাসাভা সংগ্রহের কয়েকদিনের ভিতরই কারখানায় প্রেরন করতে হয় । তবে আদ্র বালি কিংবা আদ্র কাঠের গুড়ার উপর কাসাভা রেখে দিয়ে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষন করা যায় । সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা যায়, ০.৪% থায়োবেনডাজল দ্বারা কাসাভা আলু শোধন করে পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষন করলে কাসাভা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে ।

বাংলাদেশে বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপ্রবন এলাকায় মঙ্গা নিরসনকল্পে বেশ কয়েকটি স্থানীয় এনজিও এর সহায়তায় কাসাভা চাষ করা হচ্ছে । এখানে চাষকৃত জাতগুলো বহুবর্ষজীবি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী একটি গাছ থেকে বেশ কয়েকবার পর্যায়ক্রমে কাসাভা সংগ্রহ করা হয় । বর্তমানে এসব এলাকার কৃষকদের বাড়ির আশেপাশের পতিত জায়গায় গ্রামীন মহিলাদের অর্ন্তভূক্ত করে কাসাভা চাষ উৎসাহিত করা হচ্ছে । খরা সহনশীল এ ফসলটি শুষ্ক মওসুমে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা মোকাবেলায় একটি উল্লেখযোগ্য ফসলে পরিনত হতে পারে ।

এছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্দ্যেগে কুমিল্লার ময়নামতির টিলা অঞ্চল, মধুপুর গড়, গারো পাহাড় ও চট্রগ্রামের ফটিকছড়িতে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বানিজ্যিকভাবে কাসাভা চাষ করা হচ্ছে । এখানে চাষকৃত জাতগুলো থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে আমদানীকৃত এবং একবর্ষজীবি । এসব জায়গায় উৎপাদিত কাসাভা স্টার্চ উৎপাদনের জন্য কারখানায় ব্যবহৃত হয় । গাছ প্রতি ১৫-১৮ কেজি এবং একর প্রতি ৬ টনের অধিক ফলন পাওয়া যায় । কুমিল্লায় সাথি ফসল হিসাবে কাসাভার সাথে ছড়াকচু এবং মধুপুর অঞ্চলে শরিষা চাষ করা হয় ।

বাংলাদেশের পাহাড়, টিলা, গড় ও শুষ্ক অঞ্চল যেখানে অন্য কোন ফসল করা যায় না সেখানে কাসাভার চাষ সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করতে পারে । ফসল বহুমুখীকরন, মঙ্গা মোকাবেলা এবং দেশের পতিত জমি সমূহ ফসল চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাসাভা একটি লাগসই ফসল । প্রতি বছর আমাদের দেশের ঔষধ শিল্প সহ অন্যান্য শিল্প-কারখানায় প্রচুর পরিমানে স্টার্চ ও সুক্রোজ প্রয়োজন হয় যা সাধারনত বিদেশ থেকে আমদানী করা হয়ে থাকে । দেশের পতিত এলাকা সমূহ লিজ ভিত্তিতে সহজের কাসাভা চাষের আওতায় নিয়ে এসে স্টার্চের এ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ।

* লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ,
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version