Site icon

প্রকৃতিজন্মা লটকন ফল বাণিজ্যিক ভাবে চাষে লাখপতি হচ্ছেন চাষীরা

লটকন ফল চাষে লাখপতি

মো. মোশারফ হোসেন (শেরপুর):

লটকন ফল চাষে লাখপতি

এককালের চাহিদা বিমুখ প্রকৃতিজন্মা লটকন ফল (স্থানীয় নাম বুবি) কালের আবর্তে এখন সবার চাহিদা সম্পন্ন ও ব্যাপক অর্থকরী ফল হিসেবে অত্যাধিক গুরুত্ব বহন করছে।

কৃষির উপর নির্ভরশীল বৃহৎ জনগোষ্টীর শেরপুর জেলাধীন নকলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক কৃষক প্রকৃতিজন্মা লটকন ফলের বানিজ্যিক ভাবে বাগান করে লাখপতি হয়েছেন। বাগান মালিকরা কয়েক বছর ধরে প্রতি মৌসুমে শুধু লটকন (বুবি) বিক্রি করে ঘরে তুলছেন লাখ লাখ টাকা। আর ওই বাগান থেকে লটকন কিনে নিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে পাইকারী এবং স্থানীয় বাজারে খুচরা বিক্রি করে অনেক মৌসুমীফল বিক্রেতা আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন। ভাগ্য খুলেছে উপজেলার ওইসব লটকন বাগান মালিক ও শতাধিক মৌসুমী ফল বিক্রেতাদের।

এই ফল চাষের শুরুতে গাছের চারা কিনা ও রোপন খরচ ছাড়া আর কোন খরচ নেই। নামে মাত্র শ্রমে কোন প্রকার পরিচর্যা ছাড়া তথা একদম কম খরচে লাভ বেশি পাওয়ায় উপজেলার উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে বেলে বা বেলে-দোআঁশ মাটিতে তথা পরিত্যক্ত জমিতে লটকন বাগান করে কৃষক ও ফল বিক্রেতারা আর্থিক ভাবে অধিক লাভবান হচ্ছেন। তা দেখে অনেকেই এই ফল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। অনেক চাষি তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় ও পরিত্যক্ত জমিতে এবং বিভিন্ন কাঠের বাগানে লটকন ফলের চাষ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

চন্দ্রকোণা ইউনিয়নের বন্দটেকী গ্রামের বানিজ্যিক ভাবে লটকন ফল চাষি শহিদুল ইসলাম, শরীফ হোসেন, মুনসেফ আলী ও খোকন মিয়া; পৌরসভার মোছারচর এলাকার চাষি ছাইদুল ইসলাম, আক্কাস আলী, ইন্তাজ মিয়া ও আব্দুল হাইসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক বাগান মালিক ও বেশ কিছু বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বীজের গাছে ফলন আসতে ৮ বছর থেকে ১০ বছর সময় লাগে, কিন্তু কলম করা গাছে ফলন আসতে সময় লাগে মাত্র ২ থেকে ৩ বছর। প্রতিবছর মাঘ-ফাল্গুন মাসে লটকন গাছে ফুল আসা শুরু হয় এবং জৈষ্ঠ্য মাসের শেষের দিক থেকে ফল পাকা শুরু হয়।

বন্দটেকী গ্রামের চাষি শহিদুল ইসলাম জানান, তিনি ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত নার্সারীর ব্যবসা করেছেন। ২০০৫ সালে লটকন বাগান করে স্বাবলম্বী হওয়ার সংবাদ পত্রিকায় পড়ে তার নার্সারী ২০টি লটকন গাছ বাড়ির আঙ্গিনার পরিত্যক্ত জমিতে রোপন করেন। পরের বছর ২৭ শতাংশ জমিতে ৭৫টি এবং ৩৫ শতাংশ জমিতে ৫৬ টি লটকন গাছ রোপন করেন। ২০১৫ সালে ওইসব গাছে ফল আসে, ওই বছর ৭ হাজার টাকার লটকন বিক্রি করনে তিনি। তার পর থেকে প্রতিবছর ফলন বাড়তে থাকে এবং টাকা আয়ের পরিমানও বাড়ে। চলতি মৌসুমে তার ওই দুই বাগানের লটকন পাইকারদের কাছে অগ্রিম ৭৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, অগ্রিম বিক্রি না করলে লক্ষাধিক টাকায় ওই বাগানের লটকন বিক্রি করা যেত। অন্য চাষি শরীফ হোসেন জানান, তার ১৪৫ টি গাছের ফল অগ্রিম এক লাখ ৪৫ হাজার টাকায় এবং মুনসেফ আলীর ৭৫ টি গাছের ফল ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। চার বছর আগে কলম কাটা চারা রোপন করা খোকনের ৬০ টি গাছের ফল পাইকাররা অগ্রিম দাম করেছেন ৪৫ হাজার টাকা।

লটকন বাগানের মালিকরা জানান, বিনাশ্রমে ও বিনাব্যয়ে লটকন ফল চাষে যে লাভ পাওয়া যায়, তা অন্য কোন ফল-ফসল বা শাক-সবজি চাষে কল্পানাও করা যায়না। বর্তমানে আগাম জাতের কিছু লটকন বাজারে উঠতে শুরু করেছে। যার খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা, পাইকারী মূল্য ৭৫ টাকা থেকে ৯০ টাকা। আর প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, এক একর জমিতে লটকন ফল চাষ করার পরে ফলন আসলে প্রথম বছরেই লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। উপজেলার গনপদ্দী, বানেশ্বরদী, টালকী, চন্দ্রকোণা ও নকলা ইউনিয়নসহ গৌড়দ্বার, পাঠাকাটা, চরঅষ্টধর ইউনিয়ন, পৌরসভার ধুকুড়িয়া, লাভা, গড়ের গাঁও, জালালপুর ও কায়দা এলাকার জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ হওয়ায় ওইসব এলাকা লটকন চাষ করার উপযোগী।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর বলেন, বাড়ির আঙ্গীনায় এবং যেকোন কাঠ বা ফলের বাগানেও লটকন চাষ কার সম্ভব। ছায়া যুক্তস্থানের লটকন মিষ্টি বেশি হয়। তাই এটা চাষ করতে বাড়তি জমির দরকার হয়না। যেকোন কাঠের বা ফলের বাগানেও চাষ করা যায়। তাছাড়া অন্যান্য ফল বা ফসলের চেয়ে লটকন ফলে রোগ বালাই ও পোকার আক্রমন কম হয়। তাই ঝুঁকি মুক্ত এই ফলের আবাদ বাড়াতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

Exit mobile version