বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে সফলতা পাওয়ার কলাকৌশল

ব্যালকনিতে চাষ করুন

ব্যালকনিতে চাষ করুন
কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ:

 

সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য দানাদার শস্যের পাশাপাশি সবজি চাষ করে আসছে। কিন্তু উৎপাদনের পরিমাণের দিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চাহিদার তুলনায় খুব কম পরিমাণে সবজি চাষ হচ্ছে বাংলাদেশে। যার কারণে একজন মানুষের দৈনিক ৩০০ গ্রাম সবজি খাওয়ার প্রয়োজন থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে একজন মানুষ গড়ে পেয়ে থাকে ৫০-৫৫ গ্রাম সবজি। অথচ স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সবজি র গুরুত্ব অনেক বেশি। মানব দেহের খনিজ ও ভিটামিনের অভাব পূরন করতে সবজি র বিকল্প নেই। সবজি’র প্রতি মানুষের সচেতনতা ঠিক যথাযথভাবে বৃদ্ধি পায়নি। ডাক্তার প্রায় সকল রোগীকে বলে থাকেন নিয়মিত তাজা শাক-সবজি খাওয়ার জন্য । অথচ বাজারে যে সবজি পাওয়া যায় তার অধিকাংশই বিষ (কীটনাশক) যুক্ত। কারণ কীটনাশক ব্যবহারের পর সবজি সংগ্রহের যে সময় বেধে দেয়া আছে তা কৃষক মেনে চলে না। আবার অজ্ঞতা কারণে ভুল ও নিষিদ্ধ কীটনাশক কৃষক ব্যবহার করে থাকে। কাজেই এভাবে অধিক পরিমাণে বিষযুক্ত সবজি খাওয়ার ফলে আবার নতুন নতুন রোগও সৃষ্টি হচ্ছে। জমিতে কীট পতঙ্গের আক্রমণের কারণে কৃষক জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে প্রধানত তিন প্রকারের ক্ষতি হয় ।

১ম আর্থিক ক্ষতি – কারণ কৃষক অদক্ষতার কারণে,অন্য কৃষকের দেখাদেখী অথবা কীটনাশক বিক্রেতার দ্বারা প্রতারিত হয়ে জমিতে বেশি পরিমাণে ও ভুল কীটনাশক প্রয়োগ করে । এভাবে অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে পোকার মাঝে কীটনাশকের প্রতি সহনশীলতা তৈরি হয়। ফলে আরও অধিক পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করলেও পোকা মারা যায় না। এভাবে বিভিন্নভাবে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয় কৃষকের ।

২য় পরিবেশগত ক্ষতি – জমিতে প্রয়োগকৃত কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ বাতাসে ,মাটিতে ও পানিতে চলে যায় । এর ফলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ রকমের পরিবেশ দূষণ- মারা যায় মৃত্তিকাস্থিত উপকারী জীবাণু ও বন্ধু পোকা,ক্ষতিগ্রস্থ হয় মাৎস্যকুল, সৃষ্টি হয় মাটি দূষণ ও বায়ু দূষণ, জমির উর্বরতা শক্তি ও হ্রাস পায়।

৩য় স্বাস্থ্যগত ক্ষতি – কৃষক মাঠে যখন কীটনাশক প্রয়োগ করে তখনই তার নাকে ও মুখে কিছু কীটনাশক ঢুকে যায়। কেননা আমাদের দেশের কৃষকেরা কীটনাশক প্রয়োগের নীতিমালা কখনই মেনে চলে না । সব্জী সচেতন মানুষেরা কীটনাশকযুক্ত সবজি খাওয়ার ফলে আবার বিভিন্ন রোগেও আক্রান্ত হয়। কীটনাশকের প্রভাবে – মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, লিভার, ফুসফুস এবং কিডনি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে, প্রজনন ক্ষমতার উপর প্রভাব পড়ে, মহিলাদের অধিক পরিমাণ গর্ভপাত এবং মৃত অথবা বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম হতে পারে। কাজেই বর্তমানে যুগের দাবি হচ্ছে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা।
বর্তমানে একটি সে¦চ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট ইনিসিয়েটিভস(এস ডি আই) অন্যান্য উন্নয়নশীল কর্মসূচির পাশাপাশি ঢাকার অদুরে ধামরাই উপজেলায় কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । এ প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সাভারের তেতুলঝোড়া ইউনিয়নে । এর সফলতার পর প্রকল্প-২ শুরু হয় ধামরাই উপজেলায়। প্রকল্প ২টি তেই আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকে এস এফ)। এস ডি আই ক্ষতিকর কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রকল্প -২ এর আওতায় ধামরাই উপজেলার সোমভাগ ও রোয়াইল- এ দুইটি ক্লাস্টারের ২০০ জন চাষীকে নিয়মত প্রশিক্ষণ প্রদান করছে । এক্ষেত্রে প্রজেক্টের কৃষি সমন্বয়কারী কৃষিবিদ এস এম আওলাদ হোসেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন । প্রশিক্ষণের ফলে কৃষকরা চাষাবাদের ক্ষেত্রে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী সচেতন হয়েছেন । তারা এখন উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করাসহ উচ্চ মূল্যে তাদের উৎপাদিত সবজি বাজারজাত করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা মনে করেন, এই বিষমুক্ত সবজি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব। তাদেরকে এ স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে এস ডি আই। অনেক বেশি প্রতিশ্র“তিশীল ও আধুনিক। বর্তমানে তারা আইপিএম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি জৈব বালাইনাশকের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবজি উৎপাদন করছে।
প্রক্রিয়াটি যেভাবে কাজ করে
পোকার জীবন চক্রে সাধারণত চারটি ধাপ আছে । ১ম ধাপ – পূর্ণাঙ্গ পোকা , ২য় ধাপ – ডিম , ৩য় ধাপ – লার্ভা(কীড়া) ও ৪র্থ ধাপ-পিউপা ( পুত্তুলী )। ফসলের ক্ষতির জন্য প্রত্যেকটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধাপগুলোকে সঠিক সময়ে বাধাগ্রস্থ করতে পারলে ফসলের ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব ।
১ম ধাপ – পূর্ণাঙ্গ পোকা ঃ পূর্ণাঙ্গ পোকা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য কৃষক জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করে। এর ফলে কিছু পোকা কীটনাশকের ক্রিয়ায় মারা যায় । কিছু সংখ্যক পোকা সহনশীল হওয়ার কারণে কীটনাশক প্রয়োগ করা সত্বেও মারা যায় না। আবার কিছু সংখ্যক পোকা কীটনাশকের গন্ধ বুঝতে পেরে অন্য জমিতে চলে যায়। বিষক্রিয়া শেষ হলে তারা আবার পূর্বের জমিতে ফিরে এসে সবজি র ক্ষতি করে। এক্ষেত্রে কোন প্রকার কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই এসডিআই-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকেরা নিরাপদ ও পরিবেশ বান্দ্বব সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করে পুর্ণাঙ্গ পুরুষ পোকা ধ্বংস করছে । এতে ¯ত্রী পোকার হরমোনের গন্ধ সম্বলিত রাসয়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় । এর গন্ধেই পুর্ণাঙ্গ পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে পাত্রের মধ্যে আসে ও পাত্রের মধ্যে রাখা সাবান পানিতে পড়ে মারা যায়। প্রতি তিন শতাংশ জমির জন্য একটি সেক্স ফেরোমেন ফাঁদই যথেষ্ঠ। জমিতে প্রতি ১০-১২ মিটার দূরে দূরে বর্গাকারে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ স্থাপন করতে হয়। সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ সবজি র বাড়ন্ত অংশ (ফুল,ফল ও ডগা ) বরাবর শক্ত ভাবে বেঁধে দেয়া হয়। গাছের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে ফাঁদের উচচতাও বাড়াতে হয় । কুমড়া জাতীয় সবজির প্রধান শত্র“ই হলো মাছি পোকা। লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, শসা, ঝিঙ্গা, করলা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, উচ্ছে, ধুন্দল ইত্যাদি ফসলের মাছি পোকা দমনে অত্যন্ত কার্যকরী হচ্ছে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ। এছাড়াও বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা এ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা স¤ভব হয়েছে।
২য় ধাপ – ডিম ঃ সাধারনত উর্বর ডিম থেকে পোকার কীড়ার জন্ম হয়। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী পোকা সাধারণত উদ্ভিদের নিরাপদ স্থানে বিশেষ করে পাতার নিচে ডিম পাড়ে। কিন্তু কৃষক যে কীটনাশক দেয় তা পরিমাণে বেশি হলেও সাধারণত পাতার নিচে পৌঁছায় না। এভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কীটনাশকের মাধ্যমে ডিম ধ্বংস হয় না। আবার কৃষক হাত দিয়ে পাতা সংগ্রহ করে ডিম ধ্বংস করতে চাইলেও তা সকল ক্ষেত্রে সব সময়ই সম্ভব হয় না। ডিম থেকে যে লার্ভা (কীড়া) বের হয় তা ফসলের প্রচুর ক্ষতি করে। কাজেই ডিম ধ্বংস করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাইকোগ্রামা একধরনের শত্র“ পোকার ডিম ধ্বংসকারী পরজীবী পোকা। এ পোকা জমিতে ছেড়ে দিলে তারা জমি থেকে নিজ উদ্যোগে শত্র“ পোকার ডিম খেয়ে সেখানে নিজে ডিম পেড়ে নিজের বংশ বৃদ্ধি করে। ফলে নতুন ভাবে কোন কীড়া জন্মাতে পারে না । এভাবে ফসল উৎপাদনে সাহায্য করে ।
৩য় ধাপ – কীড়া / লার্ভা ঃ ডিম থেকে যে লার্ভা (কীড়া) বের হয় তা ফসলের প্রচুর ক্ষতি করে। ব্রাকন হলো একধরনের শত্র“ পোকার কীড়া/ লার্ভা ধ্বংসকারী পরজীবী পোকা যা লার্ভা খেয়ে বেঁচে থাকে। জমিতে ব্রাকন পোকা ছেড়ে দিলে তারা জমি থেকে খুঁজে খুঁজে লার্ভা খেয়ে ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে ।
৪র্থ ধাপ – পুত্তলী ঃ পোকার কীড়া আক্রান্ত সবজি দ্রূত পচে যায় এবং গাছ হতে মাটিতে ঝরে পড়ে। উক্ত সবজিতে লুকিয়ে থাকা পরিপূর্ণ কীড়া অল্প সময়ের মধ্যেই পুত্তুলি ও পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়ে নতুন ভাবে আক্রমণ শুরু করতে পারে। পুত্তলী সাধারণত মাটির নিচে, ফসলের অবশিষ্টাংশের স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। এদেরকে ধ্বংস করার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ প্রয়োজন। ভালভাবে জমি চাষ দিয়ে রেখে দিলে পাখি পুত্তলী খেয়ে ফেলে। আবার রোদের উচ্চ তাপেও মারা যায়। যেহেতু এ পোকার কীড়াসমূহ মাটির ১০-১২ সেন্টিমিটার গভীরে পুত্তুলিতে পরিণত হয় সেহেতু আক্রান্ত ফল ও ফসলের অবশিস্টাংশ মাটিতে কমপক্ষে ৩০ সেন্টিমিটার গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হয় অথবা হাত বা পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হয়।
সুতরাং এভাবে পোকার বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেমন সম্ভব হয়েছে ঠিক তেমন ভাবে আর্থিক ক্ষতি , পরিবেশগত ক্ষতি ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতি থেকে অনেকাংশেই পরিত্রান পেয়েছে বলে দাবি করছে এস ডি আই ও পিকে এস এফ। কৃষকদের এসকল কর্মসূচি দেখার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসুক কৃষকেরা ভিড় জমাচ্ছে ও অভিজ্ঞতা নিচ্ছে। এস ডি আই ও পিকে এস এফ আগামীতে এ প্রকল্পটিকে আরও বৃহৎ আকারে করার পরিকল্পনা করছে।

সহকারী অধ্যাপক, কৃষিশিক্ষা, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল। মোবাইল: ০১৭১১-৯৫৪১৪৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *