Site icon

কোন কারনে বীজ সংকটে ব্যাহত না হোক বরিশস্যের চাষাবাদ প্রক্রিয়া

নিতাই চন্দ্র রায়

এখনও কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। জিডিপির শতকরা ১৯ ভাগ আসে কৃষি থেকে এবং শতকরা ৪৮ ভাগ লোকের কর্মসংস্থান করে এখাতটি। কৃষির উদ্ভব, উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাথে বীজের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বীজ ছাড়া কৃষির কথা চিন্তা করা যায় না। কথায় বলে, সুবংশে সুসন্তান সুধী জনে কয়, ভাল বীজে ভাল ফসল ফলিবে নিশ্চয়।
ময়মনসিংহের নতুন বাজারের কৃষাণ এগ্রো সার্ভিস, মোহাম্মদী বীজ ভান্ডার, আল-আমীন বীজ ভান্ডারসহ সারা দেশের বীজের দোকানগুলোতে বীজ বিক্রির ধুম পড়েছে।বেড়েছে কৃষকের পদচারণা। এসময় বোরো ধান, গম, মসুর, আলু, সরিষা, তিসি, ফুলকপি, বাধাকপি, টমেটো,বেগুন, লাউ, ক্ষীরা, মিষ্টি কুমড়া, পালংশাক, ওলকপি ,গাজর, শালগম, পেঁয়াজ, মরিচ, ্ও ধনেপাতাসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ বিক্রি হয় প্রচুর। বীজ ব্যবসায়ীরা এই সময়টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন সারা বছর।আগে কৃষক নিজের বীজ নিজেই উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতেন। এ কাজে গ্রামীণ মহিলাদের ভূমিকা ছিল প্রধান। তাঁরা মাটির হাড়ি ,কলসি ও টিনের কৌটায় পরম যত্নে বীজ সংরক্ষণ করে রাখতেন।রোগ ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মাঝে মধ্যে রোদেও শুকাতেন ওইসব বীজ। আজ থেকে দু’তিন দশক আগেও হাইব্রিড বীজের তেমন প্রচলন ছিলনা। হাইব্রিড বীজ থেকে কৃষক পরবর্তী ফসলের জন্য বীজ উৎপাদন করতে পারেন না। তাই প্রতি বছর বীজের জন্য তাঁকে দ্বারস্থ হতে হয় বহুজাতিক কোম্পানির কাছে।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো বিশুদ্ধ বীজ । ভাল বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে শস্যের ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বাড়ানো যায়। পোকা-মাকড় , রোগ-বালাই ও আগাছার উপদ্রব হয় কম ।ফসলের গুণগতমানও বৃদ্ধি পায়।বাংলাদেশে গুণগত মানের বীজের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।সব ফসল মিলে দেশে বার্ষিক বীজের চাহিদা ১১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে আলু বীজ প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন, ধান বীজ আড়াই লাখ টন এবং সবজিসহ অন্যান্য ফসলের বীজের চাহিদা আড়াই লাখ টন।তবে বীজের এ বিশাল বাজারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ করা বীজের পরিমাণ অনেক কম।সরকারী ও বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, যা চাহিদার মাত্র ৫৩ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ করা এ বীজের প্রায় ১০শতাংশ নিম্ম মানের।জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সনদবিহীন বিভিন্ন কোম্পানি কৃষকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নামে মানহীন বীজ বিক্রি করছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের নামেও বিভিন্ন স্থানে মানহীন বীজ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বাংদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, প্রতিষ্ঠিত অনেক কোম্পানির নাম দিয়ে কোথাও কোথাও মানহীন বীজ বিক্রি হচ্ছে। এ ধরনের কর্মকান্ড এশিল্পের জন্য বড় বাধা। সঠিক তদারকী না থাকায় এসব কর্মকান্ড রোধ করা যাচ্ছে না। নজরদারী না বাড়ালে কৃষক আরো বেশি করে প্রতারিত ও ক্ষতির শিকার হবেন।
দেশের একমাত্র সরকারি বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসি বছরে সরবরাহ করে মাত্র দেড় লাখ টন বীজ। বাকি বীজের সরবরাহ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। হাইব্রীড বীজের ৯০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করছে খাতটি। এখাতের মাধ্যমে প্রায় শত ভাগ সবজি ও ভুট্টা বীজ সরবরাহ করা হয়। সার্বিকভাবে বীজ বাজারে এখন ভাল অবস্থানে রয়েছে সুপ্রিম সীড, লালতীর, ব্র্যাক ও এসিসআই। এন মধ্যে সুপ্রিম, ব্র্যাক ও লালতীরের কাছে মজুদ আছে ৭২ শতাংশ বীজ। এ ছাড়া ইস্পাহানি, আফতাব, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, মল্লিক, ইউনাইটেড, পারটেক্স সিডকোম্পানিও বীজ সরবরাহে রাখছে উল্লেখযোগ্য অবদান।
দেশের কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষিউন্নয়ন কর্পোরেশন( বিএডিসি) উৎপাদিত গুণগতমানের সিংহভাগ বীজের যোগান দাতা । এ প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ এবছর বীজের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। অকাল বন্যায় ও অতিবৃষ্টির কারণে এ বছর হাওরাঞ্চলসহ সারা দেশের কৃষক বোরো ধানের প্রয়োজনীয় বীজ সংরক্ষণ করতে পারেনি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল হারিয়ে কৃষক দিশেহারা। তাঁদের হাতে নগদ অর্থ নেই। এ পরিস্থিতিতে শস্য বীজের মূল্যবৃদ্ধি মরার ওপর খাড়ার ঘা ছাড়া আর কিছুই নয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বলছেন, বীজের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে এবং দেশের কৃষি খাতেএর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গত ৯ আগষ্ট থেকে বিএডিসির বীজের এই বর্ধিত মূল্য কার্যকরী হয়। গত আমন মৌসুমে যেখানে প্রতি কেজি প্রত্যায়িত ধান বীজের দাম ছিল ৩৫ টাকা এখন তার দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ টাকা এবং ৪০ টাকা কেজির ভিত্তি ধান বীজের মূল্য বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৮ টাকা । ৩৪ টাকা কেজির গম বীজের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ টাকা। সে হিসেবে মূল্য বৃদ্ধির শতকরা হার ৪২ থেকে ৪৫%।অন্যান্য বীজের দামও একইভাবে বাড়ানো হয়েছে। যেমন মুগডালের প্রতিকেজি বীজের দাম ৫৮ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৪ টাকা । মাসকলাই ৮০ থেকে ৯০ টাকা, খেসারি ৪৮ থেকে ৬৪ টাকা, ছোলা ৬৬ থেকে ৯৮ টাকা, মটর ৫০ থেকে ৯৬ টাকা। তেল বীজের বেলায় সয়াবিন প্রতিকেজি ৫৪ থেকে ৬৮টাকা, তিল ৪৫ থেকে ৬৮টাকা, চিনাবাদাম ৮৪ থেকে ৯৬ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। শাক-সবজির ক্ষেত্রে রতন জাতের টমেটোর বীজের দাম প্রতিকেজি ১৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪১৫ টাকা। মূলার বীজের দাম প্রতিকেজি ১৬০ থেকে করা হয়েছে ১৮০ টাকা ,পালংশাক ৯০ থেকে ১১০ টাকা এবং লালশাকের বীজ ২৬০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৮০ টাকা। তাছাড়া খরিপ ফসলের বীজের দামও বাড়ানো হয়েছে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা।কৃষক নেতাদের ধারণা বিএডিসির বীজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে আর্থিকভাবে কৃষক আরো দুর্ভোগের শিকার হবে।
বাংলাদেশে এখন শতাধিক কোম্পানি বিভিন্ন ফসলের বীজ আমদানি করছে এসব কোম্পানির সারাদেশে রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি ডিলার ও ডিস্টিবিউটর। দেশে এখন বীজ বাণিজ্য কয়েক হাজার কোটি টাকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নতুন নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন ,কৃষকের জ্ঞান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে গুণগতমানের বীজের চাহিদা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন উদ্ভাবিত এসব বীজের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে শস্যের উৎপাদন বাড়বে প্রায় ৭৬ হাজার মেট্রিক টন, যার আনুমানিক মুল্য ২৫ হাজার কোটি টাকা। উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বীজের কাক্সিক্ষত প্রসার ঘটলে লাভবান হবে কৃষক এবং প্রবৃদ্ধি বাড়বে কৃষি খাতের।
সম্প্রতি এ আর মালিক সিড কোম্পানি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ৪০ একরের এক বিশাল সবজি বীজ গবেষণাগার গড়ে তুলেছে। সেখানে তারা জাপানের বিখ্যাত বীজ কোম্পানি সাকাতার সাথে যৌথ উদ্যোগে আলু, বেগুন, পটোল, চাল কুমড়া, লাউ, করলা, চিঙ্গিা, ঢেঁড়সসহ কম পক্ষে ত্রিশটি শাক-সবজি বীজের মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন সবজি ও ফলের ৮০টি জাতের বীজ আমদানিও বাজারজাত করছে।
বাংলাদেশে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলির মধ্যে লালতীর অন্যতম।বর্তমানে লালতীর ৩৩ টি শাক-সবজির ১৩১ জাতের বীজ বাজারজাত করছে।তাঁদের ৫৫ টি ইনব্রিড ও ৭৬ টি ইনব্রিড বীজ রয়েছে। প্রায় ৬ হাজার সংযোগ চাষিও ২৮ হাজার ১৭৩ জন শ্রমিকের মাধ্যমে ১৪টি বিভিন্ন উৎপাদন এলাকায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কৃষিদিগণের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত হচ্ছে গুনগম মান সম্পন্ন সবজি বীজ। লালতীরের মার্টিনা লাউ, কুরুডা৩৫ গাজর, ¯েœা হোয়াইট ফুলকপি, প্রিমিয়াম মরিচ, ইপসা১, ইসপা২ সীম, আলতাপেটি লালশাক, আলভী, শীলা শসা. ইভা, শিংনাথ, লাবনী বেগুন, গ্রীন ফিংগার ঢেঁড়স, সুপ্রীমা, সুইটি মিষ্টি কুমড়া,তাসাকি, রকি মুলা, রতন ,রোমা মিন্টু টমেটোর বীজ উচ্চ ফলন ও গুণগতমানের জন্য সারাদেশের সবজি চাষিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এছাড়া মেটালের লালিমা মিষ্টি কুমড়া, ইউরেকা ঝিংগা, ব্র্যাকের শক্তি ধান, সুপ্রিমের হীরা ধান-২, ইউনাইটেডের রেড লেডি পেঁপের বীজও কৃষকের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বেসরকারিভাবে সনদপ্রাপ্ত ১৭৬ টি কোম্পানি দেশে বীজ বাণিজ্যের সাথে জড়িত। এসব কোম্পানি সারাদেশে ১৭ হাজার ডিলারের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে বিভিন্ন ফসলের বীজ। এর বাইরে সারা দেশে রয়েছে আরও ১০ হাজারের মতো ভ্রাম্যমান বীজ ব্যবসায়ী। অন্যদিকে সরকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসি আট হাজার নিবন্ধিত বীজ ডিলার ও তিন হাজার সার ডিলারসহ ১১ হাজার ৬০০ ডিলারের মাধ্যমে সরবরাহ করছে গুণগত মানের শস্য বীজ।
গত মৌসুমে আমন ধানের বীজ ক্রয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছে সারা দেশের অসহায় কৃষক। তাঁদেরকে ৩৫০ টাকা দামের ১০ কেজি ওজনের আমন ধানের বিএডিসির প্রত্যায়িত বীজ কিনতে বাধ্য করা হয়েছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। ্আসন্ন বোরো মৌসুমে যাতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে এজন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত বীজ-সার মনিটরিং কমিটিকে তদারকি ও মূল্যায়ন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এছাড়া কেউ যেন ভেজাল বীজ বিক্রি করে কৃষকের সর্বনাশ করতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ।এজন্য প্রয়োজনে উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ গুণগত মানের বীজের কৃত্রিম সংকটের কারণে যদি বোরো ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ, শীতকালীন শাক-সবজির উৎপাদন ব্যহত হয়, তবে সরকার গৃহীত হাওর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কর্মসূচি একবারে ভেস্তে যাবে। কৃষকের মেরু্দন্ড ভেঙ্গে যাবে। দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্য শস্যের দ্বারা মূল্য বৃদ্ধির এ প্রবণতাকে কোনো অবস্থাতেই রোধ করা সম্ভব হবেনা।

লেখকঃ কৃষিবিদ ও কলামিষ্ট
সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ

Exit mobile version