নিতাই চন্দ্র রায়
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার উজানপাড়া গ্রামের মোঃ সিরাজুল ইসলাম একজন প্রগতিশীল ধান চাষী। এবছর তিনি দুই বিঘা জমিতে ব্রি২৯ জাতের ধানের চাষ করেন এবং সময় মতো চারা রোপণ, সেচ, সার প্রয়োগ ,আগাছা ও পোকা-মাকড় দমন করেন। এসব কারণে আশেপাশের জমি থেকে তাঁর জমিতে ফলন হয়েছে বেশি। তাঁর সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বিঘাতে এবার তাঁর ফলন হয়েছে ২০ মন। গত বছর ফলন হয়েছিল সাড়ে ২২ মন। এবছর অতিবৃষ্টি ও বাতাসে পরাগরেণু ঝরে যাওয়ার কারণে তুলনামূলক ফলন কম হয়েছে। ৩৩ শতকের এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে তাঁর মোট খরচ হয়েছে ১০ হাজার ৪০০ টাকা। প্রতিমন ৭৫০ টাকা দরে ২০ মন ধান বিক্রি করে তাঁর আয় হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি নিট লাভ হয়েছে ৪ হাজার ৬০০ টাকা। ধানের ফলন একটু কম হলেও গত বছরের চেয়ে দাম বেশি থাকার কারণে বহুদিন পর তিনি বোরো ধানের চাষ করে লাভের মুখ দেখলেন। তাঁর মতে বোরো ধানের দাম হওয়া উচিত কমপক্ষে এক হাজার টাকা মন। বিঘা প্রতি ধান উৎপাদনের তিনি যে হিসাব দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়- প্রতি বিঘা জমি চাষে খরচ হয়েছে ৭৫০ টাকা, বীজ ক্রয়ে ৩০০ টাকা, চারা তৈরীতে ৩৫০ টাকা, চারা রোপণে ১০০০ টাকা, আগাছা দমনে ৫০০ টাকা, সারও কীটনাশক বাবাদ ২০০০ টাকা, সেচ বাবদ ২০০০ টাকা এবং ধান কাটা ,মাড়াই ,ঝাড়া ও শুকানো বাবদ ৩৫০০ সহ মোট ১০ হাজার ৪০০ টাকা। ছলিমপুর গ্রামের সাইফুজ্জামান নামের আর একজন চাষির কাছ থেকে জানা যায়, এবছর তিনি ব্রি ২৮ জাতের ধান চাষ করে বিঘা প্রতি ফলন পান সাড়ে ১২ মন, অথচ গত বছর ওই জমিতে বিঘা প্রতি ফলন পেয়েছিলেন ১৫ মন। তাঁর বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে আট হাজার টাকা।প্রতিমন ধান ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করে খরচ বাদে তাঁর বিঘা প্রতি লাভ হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকা, যা অন্যান্য ফসলের তুলনায় খুবই কম। সামানিয়াপাড়া গ্রামের আর একজন প্রগতিশীল বর্গা চাষি এক একর জমিতে হাইব্রিড হীরা ধানের আবাদ করে বিঘা প্রতি ফলন পান ২৭ মন। বিঘা প্রতি তাঁর খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। প্রতিমন ধান ৭০০ টাকা মন দরে বিক্রি করে প্রতি বিঘা জমি থেকে আয় করেন ১৮ হাজার ৯০০ টাকা। খরচ বাদে তাঁর নিট লাভ হয় ৮ হাজার ৯০০ টাকা।এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এবার জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে চৈত্র-বৈশাখ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় সারাদেশেই বোরো ধানের ফলন হ্রাস পেয়েছে । কিন্তু ধানের দাম গত বছরের চেয়ে বেশি থাকায় কৃষক বোরো ধান চাষে লাভবান হয়েছেন।
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। চাষাযোগ্য মোট জমির শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে ধানের চাষ হয়। উৎপাদিত ধানের শতকরা ৫৬ ভাগ আসে বোরো থেকে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করে ১ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। বোরো ধানের উৎপাদনের উপরই চালের দাম, আমদানি এবং খাদ্যনিরাপত্তা বহুলাংশে নির্ভর করে- একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। কোনো কারণে বোরো ধানের উৎপাদন কম হলে বাজারে চালের দাম হুহু করে রেড়ে যায়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবছর অকাল বন্যায় হাওরের বোরো ধান বিনষ্ট হওয়ায় বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দুর্ভোগের শিকার হয় স্বল্প আয়ের মানুষ। বর্তমানে প্রতি কেজি মোটা স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪১ থেকে ৪২ টাকাতে, এক মাস আগেও যার দাম ছিল ৩৮ টাকা এবং গত বছর এই সময়ে ছিল ৩৫ টাকা। বর্তমানে চিকন পাজাম প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা , এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকা কেজিতে এবং গত বছর এ সময়ে এর দাম ছিল ৪৬ টাকা। বোরো ধানের এই ভরা মৌসুমে চালের দামের ঊর্ধ্ব গতিতে ভোক্তা সাধারণ শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
সারাদেশে এবার ৪৭ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এই পরিমাণ জমির মধ্যে হাওর অঞ্চলে অকাল বন্যায় ১ লাখ ৭১ হাজার হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া অতিবৃষ্টির কারণে দেশের নিম্মাঞ্চল ও বিল এলাকায় বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে নেকব্লাষ্ট রোগের ব্যাপক আক্রমণ দেখা দেয়। এতে বোরো ধানের ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব কারণে এ বছর বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আনুমানিক ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদন হতে পারে।
চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার হতে ৭ লাখ টন ধান এবং ১লাখ টন আতপ চালসহ ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার । এবার প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা এবং প্রতি কেজি আতপ চালের সংগ্রহ মূল্য ৩৩ টাকা ও সেদ্ধ চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪ টাকা। সরকারি ভাবে এই ধানচাল সংগ্রহ অভিযান ২ মে থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত চলবে। বর্তমানে প্রতিকেজি বোরো ধান দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২২ টাকা এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে। বিদ্যমান অবস্থায় সরকারি ধানচাল সংগ্রহ কতটুকুু সফল হবে তা এ মুহুর্তে সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা -যদি ধান চালের বর্তমান বাজার দর অব্যাহত থাকে বা দাম না কমে তাহলে সরকারি ধানচাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বেশ কঠিন হবে । সেক্ষেত্রে সরকারের একমাত্র ভরসা হলো বিদেশ থেকে চাল আমদানি । সরকারি হিসেবে এবার প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ২২ টাকা এবং চালের কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে ৩১ টাকা। গত বছর ধান ও চালের উৎপাদন খরচ ছিল যথাক্রমে ২০.৭০ টাকা এবং ৩২ টাকা। গত বছর সরকার ২৩ টাকা কেজি দরে অভ্যন্তরীণ বাজার হতে ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান ও ৩২ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করে। একারণে অনেক এলাকায় বোরো ধানের আবাদ বন্ধ বোরো ধানের আবাদ বন্ধ করে দেয় বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম গুলোর খবরে জানা যায়।
হাওর অঞ্চলে বন্যার কারণে সরকারি ধানচাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়া এবং সরকারি গুদামে চালের মজুদ ৩ লাখ টনে নেমে আসায় বোরো ধানের ভরা মৌসুমেই সরকার ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির দরপত্র আহবান করে। পাশাপাশি সাময়িকভাবে চাল আমদানি শুল্ক শতকরা ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে শতকরা ১০ ভাগ নির্ধারণ করারও চিন্তাভাবনা করছে সরকার। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিডিপি) বলছে, ২০১৪-১৫ সালে শূণ্য শুল্কের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে চাল আমদানির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়। সরকারি হিসেবে ২০১৪ -১৫ সালে শূণ্য শুল্কের সুযোগ নিয়ে প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়। এতে দেশে ধানের দাম কমে যায়, কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।রাস্তায় ধান ফেলে ও মানব বন্ধন করে প্রতিবাদ জানান। তাই এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এনবিআরকে আরো সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল আমদানি করে কৃষকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে এ ব্যাপারেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ থাকতে হবে।
এপ্রিলে বোরোর নতুন চাল ওঠা শুরু হলে সাধারণত চালের দাম কম থাকে। কিন্তু এ বছর চালের বাজার দর না কমে বরং ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে মোটা চালে দর ছিল প্রতিকেজি ৩১ টাকা। ২০১৫ সালে ছিল ২৯ টাকা, ২০১৬ সালে ছিল ২৪ টাকা ৩৮ পয়সা।২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ টাকা। গত তিন বছর চালের দাম কম থাকায় কৃষক বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এবার চালের দাম বেশি হলে তাতে দেশের ২ কোটি কৃষক পরিবার একটু উপকৃত হবেন। তাঁদের ম্লান মুখে হাসি ফুটবে। কিন্তু সরকার যদি বেসরকারি খাতে শুল্কমুক্ত চাল আমদানির সুযোগ দেয়, তা হলে তা হবে কৃষি ও কৃষকদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও আত্মঘাতি।
দেশে চাষকৃত বোরো ধানে শতকরা ৬৫ ভাগ ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ জাতের। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় নেকব্লাষ্টের কারণে ব্রিধান ২৮ ও ব্রিধান ২৯ জাত দু’টি বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের স্বার্থে এ জাত দু’টির চাষ কমিয়ে অন্য উচ্চ ফলনশীল ব্লাষ্ট প্রতিরোধী জাতের আবাদ বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বীজ উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসিকে বোরো মৌসুমে জাত ভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। অন্যথায় সারা দেশে নেকব্লাস্ট মহামারি আকারে দেখা দিলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
…
লেখকঃ
সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
৪৫/১ হিন্দু পল্লী , ত্রিশাল
ময়মনসিংহ