Site icon

মাছের ডিম নিষিক্তকরণ, স্ফুটন ও পরবর্তী রেণু পরিচর্চা

মাছে নিষিক্তকরণকৃষিবিদ মোঃ সিরাজুল ইসলামঃ


নিষিক্তকরণ (Fertilization) একটি পদ্ধতি। প্রত্যেক প্রাণির পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের হয়ে থাকে। সাধারণতঃ স্ত্রীর জরায়ুতে (Uterus) ডিম  এবং পুরুষ প্রাণির অন্ডকোষে (Testis) জন্ম নেয় শুক্র , পুরুষপ্রাণির শুক্র ও স্ত্রী প্রাণির ডিম বিশেষ প্রক্রিয়ায় সফল মিলন ঘটলেই একে নিষিক্তকরণ বলা হয়। ডিম থেকে রেণু স্ফুটনের পূর্বশর্ত হলো ডিমগুলোকে অবশ্যই নিষিক্তকরণ সম্পন্ন হতে হবে। নিষিক্তকরণের জন্য পুরুষ মাছের শুক্র বা স্পার্শকে  স্ত্রী মাছের ডিমের সংস্পর্শে আসতে হবে।

কৃত্রিম উপায়ে ডিম নিষিক্তকরণ পদ্ধতি ঃ দুই পদ্ধতিতে মাছের ডিম কৃত্রিম উপায়ে বা হ্যাচােিত নিষিক্তকরণ করা হয়, যথা- ক. স্বাভাবিক পদ্ধতি; খ. চাপ পদ্ধতি বা স্ট্রিপিং পদ্ধতি।

ক. স্বাভাবিক পদ্ধতি ঃ পরিপক্ক ব্রুড মাছের দেহের সাধারণত আন্তঃ মাংসপেশীয় (Intra-mascular) হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়াও, অন্তগহ্বরীয় (Intraperitonial) ইনজেকশন মাছের শ্রেণী পাখনা বা বক্ষ পাখনার গোড়ায় দেয়া হয়। অপরদিকে আন্তঃ মাংসপেশীয় ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয় লেজের অঞ্চলে বা পৃষ্ঠ পাখনার নিচে বা পার্শ্ব পাখনার উপরের অংশে। এ পদ্ধতি খুব সহজ ও অধিক কার্যকর। আন্তঃমাংসপেশীয় ইনজেকশনের ক্ষেত্রে আঁইশের নিচে প্রথমে দেহের সমান্তরাল ও পরে ৪৫০ কোণে সুঁচ প্রবেশ করানো হয়। হরমোন ইনজেকশন দেয়া স্ত্রী মাছকে ব্রিডিং পুলে স্রোতযুক্ত ফোয়ারায় রাখতে হবে। পুরুষ মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেয়ার পর অন্য একটি ব্রিডিং পুলে স্রোতও ফোয়ারা সহকারে স্ত্রী মাছ হতে বিচ্ছিন্নভাবে রাখতে হবে। স্ত্রী মাছের ডিম ছাড়ার ২ ঘন্টা পূর্বে পুরুষ মাছকে স্ত্রী মাছের ব্রিডিং পুলে স্থানান্তর করতে হবে। স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের সাহচর্যে ডিম পাড়বে ও পুরুষ মাছ শুক্র  ছাড়বে এবং ডিম নিষিক্ত হবে। নিষিক্ত ডিমের পানি শোষন (Water Hardening) সম্পূর্ণভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত (প্রায় ২ থেকে ২.৫ ঘন্টা পর্যন্ত) অপেক্ষা করতে হবে। ‘এই সময়টুকু অপেক্ষা না করলে ডিম নষ্ট হয়ে যাবে।’ এ সময় পর পানি শোষিত নিষিক্ত ডিম পরিমাপ (ওজন) সহকারে জুগার জগ বা হ্যাচিং পুলে পানির স্রোত ও ফোয়ারার মধ্যে স্ফুটনের জন্য রাখতে হবে। ডিম ও বীর্য নিঃশেষিত স্ত্রী ও পুরুষ ব্রুড মাছকে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন (প্রতি কেজি মাছের জন্য ০.২ সিসি হারে রেনামাইসিন) দেয়ার পর নির্দিষ্ট ব্রুড পুকুরে সরিয়ে দিয়ে পরবর্তীকালে পুণরায় ব্যবহারের জন্য যথা নিয়মে পরিচর্যা করে যেতে হবে।
খ. স্ট্রিপিং পদ্ধতি ঃ স্ত্রী ও পুরুষ ব্রুড মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেয়ার পর আলাদা ব্রিডিং পুলে স্রোত ও ফোয়ারা সহকারে রাখতে হবে। এরপর ডিম পারার সঠিক সময়ে স্ত্রী ব্রুড মাছকে ধরে পেটে সামান্য চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি পাত্রে ডিম সংগ্রহ করতে হবে। এরপর পুরুষ মাছের পেটে চাপ দিয়ে বীর্য পূর্বে সংগৃহীত ডিমের উপর ফেলতে হবে। মুরগীর নরম পালক দিয়ে বীর্যকে ডিমের সাথে মিশিয়ে ডিমকে নিষিক্ত করতে হবে। নিষিক্ত ডিমে ক্রমান্বয়ে পানি দিয়ে ডিমের পানির শোষন সম্পূর্ণভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত (২ ঘন্টা থেকে ২.৫ ঘন্টা) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন পানি শোষিত নিষিক্ত ডিমকে পরিমাপ সহকারে হ্যাচিং জার অথবা হ্যাচিং পুলে পানির স্রোত ও ফোয়ারার মধ্যে স্ফুটনের জন্য রাখতে হবে।

মাছের ডিম স্ফুটনের সময়কাল ঃ তাপমাত্রা ও প্রজাতি ভেদে ডিম ফুটে মাছের বাচ্চা বের হওয়ার সময়কাল কম-বেশি হয়ে থাকে। যেমন- সরপুঁটি মাছের জন্য ৮-১০ ঘন্টা, রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার, কার্প, গ্রাস কার্প ও বাটা মাছের জন্য ১৬-২০ ঘন্টা, বিগহেড মাছের জন্য ২০-২৪ ঘন্টা, কমন কার্প ও মিরর কার্পের জন্য ৩৬-৭২ ঘন্টা সময় লাগে।

স্ফুটনকালীন সতর্কতা ঃ এই প্রক্রিয়াটি অত্যান্ত নাজুক বিধায় নি¤œরূপ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাছের শতকরা ৫ ভাগ ডিম ফুটে পোনা বের হলে পানির প্রবাহ ঠিক ১০ মিনিট বন্ধ করে রাখতে হবে। পুনরায় পানির প্রবাহ আবার চালু করতে হবে। ফলে সব ডিম দ্রুত ফুটে পোনা বের হবে। পোনা ফুটে বের হওয়ার পর ডিমের খোলস পঁচতে শুরু করবে বিধায় ডিম পোনাকে অন্য একটি পরিস্কার জারে সরিয়ে দিতে হবে। ডিমের পানি শোষন (ওয়াটার হার্ডনিং) হওয়ার পর থেকে ডিম পোনার কুসুম থলি (Yolksac) শোষিত না হওয়া পর্যন্ত ০৩ (তিন) বার ০১:০২ পিপিএম ম্যালাকাইট গ্রীণ দ্বারা ডিম/ডিম পোনা শোধন করতে হবে। এর ফলে ডিম বা ডিম পোনা ব্যাকটোরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হবে না।

রেণু পোনার প্রাথমিক খাদ্য ও প্রয়োগ ঃ প্রজাতিভেদে ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিষিক্ত ডিম ১৬ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে ফুটে রেণু পোনায় রূপান্তরিত হয়। এ অবস্থায় এদের সাথে কুসুম থলি থাকে। এরা কুসুম থলি থেকে পুষ্টি পায়। ডিম ফোটার ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে কুসুম মিলিয়ে যাওয়ার পর এদেরকে বাহির থেকে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। একে প্রাথমিক খাদ্য(Primary feed) বলে। প্রাথমিক খাদ্য হিসেবে হাঁস-মুরগির ডিমের কুসুম অথবা জীবন্ত খাবার, প্রাণিজ খাদ্য ক্ষণা (Zooplankton) দিতে হবে। প্রতি ৪ ঘন্টা পর পর প্রতি ৫ লাখ রেণু পোনার জন্য ১টি সিদ্ধ ডিমের কুসুম ব্লেন্ডারে বেটে এবং কাপড়ে ছেঁকে খাদ্য হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, রুই, কাতলা ও মৃগেল জাতীয় মাছের প্রতি কেজিতে আনুমানিক রেণুর সংখ্যা ৩ থেকে ৪.৫ লাখ, সিলভার, বিগহেড, গ্রাস কার্প জাতীয় মাছের প্রতি কেজিতে রেণুর সংখ্যা আনুমানিক ২ থেকে ৩.৫ লাখ ও সরপুঁটি মাছের প্রতি কেজিতে রেণুর সংখ্যা আনুমানিক ৮ থেকে ১০ লাখ হয়ে থাকে।

রেণু পোনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা ঃ রেণু পোনার রোগ প্রতিকারের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই উত্তম। রেণু পোনা যাতে রোগে আক্রান্ত না হয় সে জন্য উল্লেখিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়- ডিম ফুটানোর জলধারকে ২০% ফরমালিন দিয়ে অথবা প্রতি লিটার পানিতে ১০০ মি. গ্রা. ম্যানাকাইট গ্রীণ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১০০ মি. গ্রা. হারে ফুরাসিন দিয়ে ডিম জীবাণুমুক্ত করতে হবে। হ্যাচারির বিভিন্ন উপকরণ জীবাণুমুক্ত করতে হবে। জলাধারে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ রাখতে হবে। অনুকূল পিএইচ  ৭.০-৮.৫ ও তাপমাত্রা ২৭-২৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস সংরক্ষণ করা উত্তম। সঠিক ঘনত্বে (১০০০/লিটার) রেণু মজুদ করা উচিত। জলাধার ময়লা আবর্জনামুক্ত রাখতে হবে। এজন্য সাইফনিং করতে হবে। পরিমিত খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।

—–

কৃষির আরো খবরাখবর জানতে আমাদের পেইজে লাইকদিনঃ facebook.com/krishisongbad.com

Exit mobile version