মোঃমোস্তাফি
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। আগে মাছে ভাতে বাঙ্গালী বলে পরিচিত ছিলাম আমরা। তবে বর্তমানে নদীর, নানা খাল বিলে পানির পরিমান কমে যাওয়ায় এখন মাছ চাষের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে স্বল্প সময়ে মাছ চাষ। এতে করে আমরা অল্প জায়গায় অল্প পানিতে খুব সহজে অধিক পরিমানে মাছ উৎপাদন করে আমাদের চাহিদা পুরণ করতে পারে। তারই অংশ হিসেবে আজকে মাছ চাষে পোনা নির্বাচনের গুরুত্ব ও উপায় নিয়ে আলোচনা। আজকে আমরা মাছ চাষে লাভবান হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় জানবো । আর অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজে উন্নতির পাশাপাশি দেশের ও উন্নতি হবে ইনশাআল্লাহ।
মাছ চাষের পোনা নির্বাচনঃ মাছ চাষের ক্ষেত্রে পোনা নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপুর্ণ।এই পোনা নির্বাচণের উপর অনেকাংশে লাভ ক্ষতি নির্ভর করে।মাছের দৈহিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে এই পোনা।পোনা ভাল হলে ভাল বৃদ্ধি হবে মাছে এবং সেই মাছ আমাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করবে। খামার করেন এমন কিছু কিছু লোক দেখা যায় যারা পোনা নির্বাচনে ভুল করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এজন্য জানাশোনা আছে এমন পরিচিত হ্যাচারী কিংবা পোনা বিক্রয় কেন্দ্র থেকে পোনা সংগ্রহ করা উত্তম। এক্ষেত্রে পোনার বৈশিষ্ট্য দেখে নেয়া ভাল-
ক্স ভাল পোনা সুস্থ্ ,চঞ্চল ও উজ্জ¦ল হবে।
ক্স একই আকারের এবং একই ওজনের হবে।
ক্স পোনার ত্বক পিচ্ছিল হবে।
ক্স পোনার শরীর বা পাখনার কাছে কোন দাগ বা ক্ষত থাকবেনা।
ক্স পোনার আইশ উজ্জ¦ল ও ঝকঝকে হবে।
ক্স ভাল পোনা সগ্রহ করতে পারবে খামারী অনেকটায় নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন যে তার মাছের বৃদ্ধি ভাল থাকবে।
ভালো পোনা মজুদের সুবিধা অনেক; যথা-
দ্রুত বর্ধনশীল হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হবে;
সহজলভ্য সম্পুরক খাদ্যে অভ্যাস্ত হবে।
মাছে বৃদ্ধি ও আকার সুষম এবং একই রকম হবে।
ভাল পোনার যেমন বৈশিষ্ট্য দেখে চেনা যায় , আর কিছু বৈশিষ্ট্য যা ভাল পোনায় থাকেনা, তা আমাদের মনের মধ্যে সন্দেহ হয়, তখন আমরা খারাপ পোনা হিসেবে ধরে নেয়। ঠিক তেমনি খারাপ পোনার ও কিছু খারাপ বৈশিষ্ট্য আছে- আর তা হলো
অ. পোনা অলস ভাবে পানিতে স্থির হয়ে থাকবে। সাঁতার কাটতে তার অহীনা লক্ষ্য করা যাবে।
ই. কখনো কখনো অসম আকৃতির দেখা যাবে। বিশেষ করে মাথা শরীরের তুলনায় অনেক বড়।
ঈ. ত্বকের মধ্যে উজ্জলতা না থেকে খস খসে থাকবে মনে হবে এটা কোন পানির জীবন নয়
উ. সারা দেহে অথবা লেজের কোন স্থানে ক্ষত দেখা যাবে। তা ছোট কিম্বা বড়ও হতে পারে।
ঊ. আইস তার অসল রঙ হারিয়ে ফ্যাকাসে রং ধারণ করবে।
ঋ. পোনার আকার ও ওজন একই রকম না হয়ে এতে ভিন্নতা দেখা যাবে। একই বয়সের হওয়া স্বত্বেও ।
ভাল ও খারাপ পোনার বৈশীষ্ট আমাদের জানা হলো। আমাদের বিশ্বাস আপনারা সবচেয়ে ভাল মানের পোনা সংগ্রহ করেছেন চাষের জন্য। লাভবান হবেন বলে আমরাও অনেক আশাবাদী। কিন্তু পোনা সংগ্রহের স্থান থেকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আসতেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ভুল পরিবহন ও অনান্য সমস্যার কারনে মারা যায় কিছু পোনা । যে যে কারণে পরিবহনের সময় পোনা মারা যায় তা হলো-
১। পলিথিন প্যাকেটে অক্সিজেনের অভাব হলে।
২। পোনার পাত্রে বা পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে।
৩।পাত্রে বা পলিথিন প্যাকেটে বর্জ্য বা বিপাকীয় বর্জ্য হতে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়।
৪।পোনার ঘনত্ব বেশি হলে।
৫।পরিবহন সময় হলে।
৬।পোনা নিয়ে আসার সময় প্রচুর ঝাঁকুনি খেলে।
পোনা পরিবহন করতেই হয় কারণ একস্থানে পোনা পাওয়া যায় আর তার প্রয়োজন হয় দেশ ব্যাপী। তবে কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে, ভাল পোনা চাষ করা সহজ হবে। তাই পোনা পরিবহনে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তা হলো-
পোনার ব্যাগে কোন রকম আঘাত বা খোঁচা দেয়া যাবেনা।
পোনার ব্যাগে আগুন বা ধারালো বস্ত থেকে নিরাপদ রাখতে হবে।
ভিন্ন বয়সী পোনা একপাত্রে রাখা যাবে না।
পারিমানের চেয়ে বেশি পোনা নিন্দিষ্ট পাত্রে পরিবহন করা যাবেনা।
ড্রামে পরিবহণের ক্ষেত্রে রাস্তায় পানি পরিবর্তন করলে অজ্ঞাত বা দূষিত পানি না দেয়ায় ভাল।
রোদের তাপে যেন খোলা অবস্থায় পোনা পরিবহন করার সময় তাপমাত্রার দিকে খুব সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। এক্ষেত্রে ছাতা বা অন্য কোন মাধ্যম দিয়ে পানি সরাসরি রোদের আলো থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্ঠা করতে হবে।
পোনা পরিবহণের পাত্রে বেশি ঝাঁকুনি দেয়া যাবেনা।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে মাছের পোনার মৃত্য হার কমে যাবে অনেকাংশে। যথেষ্ট সুন্দর ভাবে তা যথাস্থানে স্থানান্তরিত করতে হবে।
পোনা পরিবহনে অক্সিজেন সমৃদ্ধ পলিব্যাগে ডেলিভারী করা উত্তম।
রেনু পোনা পরিচিতিঃ
কোন কিছু চাষ করতে হলে তার সবকিছু সম্পর্কেই জ্ঞান থাকা ভাল। এতে করে যেমন চাষের ক্ষেত্রে কোন সংশয় থাকে ঠিক তেমনি সবকিছু জেনে কাজ শুরু করার ফলে নিজের ভিতরে আত্ববিশ্বাস বেড়ে যায়। যার ফলে আনন্দ নিয়ে হতাশ ভুলে খামার বা চাষ করলে সহজেই লাভবান হওয়া যায়।
বড় মাছ উৎপাদনের জন্য চারা উৎপাদন করা হয়। চারা পোনার আকারে আসতে রেণু পোনার কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। পর্যায়গুলো নিম্নরূপ-
ডিম পোনা
ডিম ফুটে বের হওয়ার পরের অবস্থা। এদের পেটের নিচে একটা থলে থাকে ()এর থলে থাকা অবস্থায় তারা কোন খাদ্য গ্রহণ করে না। জন্মের ২-৩ দিন পর্যন্ত এ অবস্থা থাকতে পারে। যা নির্ভর করে তাপমাত্রা এবং পরিবেশের ওপর। এ অবস্থায় রেণু চলাফেরা থাকে উলম্ব। এ পর্যায়ে পোনাকে হ্যাচারীতে বিশেষ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়।
রেনু পোনাঃ
পেটের খাদ্য থলি শেষ হয়ে যাও্যার পরবর্তী অবস্থাকে রেনু পোনা বলা হয়। এ অবস্থায় পোনার বয়স সাধারনত ৩-৪ দিন হয়ে থাকে। খাদ্য থলি না থাকায় এরা বাইরের খাদ্য গ্রহণ শুরু করে। এই অবস্থায় এদের চলাফেরা বড় মাছের মত আনুভুমিক হয়। রেণু অবস্থায় প্রজাতি সনাক্তকরণ অত্যন্ত কঠিন । এ অবস্থায় পোনা নার্সারী পুকুরে মুজুদ করতে হয়।
ধানী পোনাঃ রেণু পোনা বড় হয়ে ধান আকার হলে তাকে ধানী পোনা বলে। সাধারণত ১ থেকে ১।৫ সে মি আকারের পোনাকে ধানী পোনা ধরা হয়। ধাণী অবস্থায় প্রজাতি সনাক্ত করা যায়। রেণু থেকে ধানী হতে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। তবে তা খাদ্য, অক্সিজেন প্রাপ্যতা , তাপমাত্রা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।
চারা পোনাঃ
ধানী পোনা আরু বড় হয়ে হাতের আঙ্গুলের বা তার চেয়ে বড় আকার ধারণ করলে তাকে চারা পোনা বলে। ( ৭ সে মি এর চেয়ে বড়)। তবে তা নির্ভর করে মজুদ ঘনত্ব, সার প্রয়োগ ,খাদ্য প্রয়োগ ও তার গুনগত মান ,অক্সিজেনে প্রাপ্যতা, বিষাক্ত গ্যাসের বিস্তৃতি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। এ সময় পোনা মজুদ পুকুরে ছাড়ার যোগ্য হয়।
বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের পোনা ব্যবহার করা হয়। নিন্দিষ্ট চাষ ব্যবস্থায় নিন্দিষ্ট পোনা ব্যবহার করলে খুব সহজে এবং কম সময়ের মধ্যে দ্রুত ফলন পাওয়া যায়। তাই চাষ শুরু করার আগে স্থানীয় ফিসারিজ অফিসার এর নিকট থেকে পরামর্শ নিয়ে কাজ শুরু করায় বুদ্ধিমানের কাজ। এতে করে কম সময়ে দ্রুৎ ফলন পাওয়া সহজ হবে আশাকরা যায়।
পোনা পুকুরে ছাড়ার সময় বিবেচ্য বিষয়াবলীঃ
পোনা পুকুরে ছাড়ার সময় কিছু লক্ষনীয় বিষয় থাকে , যা লক্ষ্য করলে পুকুরে ছাড়ার পর পোনার মারা যাবার হার কমে যায় অনেকাংশে। পলিথিন ব্যাগ বা পাত্রে পোনা পরিবহন করা হলে সে ব্যাগে বা পাত্র হতে পোনা নার্সারী পুকুরে ছাড়ার সময় পুকুরের পানিতে বেশ কিছুক্ষন ভাসিয়ে রেখে তাপমাত্রার সমতা আনতে হবে। এর পর ব্যাগ বা পাত্রের মুখ খুলে থার্মোমিটার দিয়ে পুকুর এবগ পাত্রের পানির তাপমাত্রা দেখতে হবে। উভয় তাপমাত্রা সমান না হওয়া পর্যন্ত পাত্রের কিছু পানি পুকুরে এবং পুকুরের কিছু পানি পাত্রে প্রবেশ করাতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে উভয় পানির তাপমাত্রার পার্থক্য যেন ১-২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি না হয়। এর পর পানির তাপমাত্রা সমান হলে পাত্রটি পানির দিকে কাত করে বাহির থেকে ভিতরের দিকে স্রোতের ব্যবস্থা করতে হবে। এ অবস্থায় সুস্থ্য সবল পোনার স্রোতের বিপরীতে ধীর ধীরে পুকুরে চলে যাবে। মৃদু ঠান্ডা অবহাওয়ায় ভোরে বা বিকেলে পোনা পুকুরে ছাড়া উত্তম ।
এভাবে পুকুরে পোনা ছাড়ার কিছুদিন পর পানির মধ্যে খাদ্যের উপস্থিতি পরীক্ষা করে খাবার প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম দিকে সম্পুরক খাবার দেয়াই বেশি উত্তম। এতে করে অল্প সময়ে দ্রুত ফলন নিশ্চিত করা যায়।
সম্পূরক খাবারের গুরুত্বঃ
অধিক ঘনত্বে পোনা ও বড় মাছ চাষ করা যায়।
কম সময়ে বড় আকারের সুস্থ্য ও সবল পোণা তৈরি করা যায়।
কৃত্রিম খাদ্যে পুষ্টি বিরোধী উপাদান থাকেনা।
খাদ্য রূপান্তর হার() আকর্ষনীয় হয়।
পোনা বাঁচার হার বেড়ে যায়।
মাছ পুষ্টির অভাবজনিত রোগ থেকে মুক্তি পায়।
মাছের রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
কম সময়ে অধিক মুনাফা পাওয়া যায়।
পানির গুনাগুন রক্ষা করে মাছের সুষম বৃদ্ধি হয়।
পুকুরে সম্পুরক খাবার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষ্যনীয় বিষয়হলো-
ক্স মাছের আকার/আকৃতি ও বয়স ।
ক্স মাছের ওজন ও মাছের প্রজাতি।
ক্স মাছের স্বভাব এবং খাদ্যস্তর।
ক্স পানিতে প্রাক্ক্রিতিক খাবারের পরিমাণ।
ক্স খাবারের গুনগত মান।
ক্স খাদ্য রূপান্তর হার
ক্স পানির তাপমাত্রা ইত্যাদি।
উল্লেখিত বিষয় বিবেচনা পুর্বক মাছ চাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা হলে আবারো বাংলদেশে মাছের চাষ বাড়বে। প্রাকৃতিক ভাবে কম হলেও বিজ্ঞান সম্মত ভাবে এর চাষ করে যেমন একদিকে ব্যক্তি অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ দিয়ে অনেকের আমিষের ঘাতটি পুরণ হবে। তাই দেশের জন্য অবদান রাখার জন্য হলোও আমাদের মাছ চাষে মনোনিবেশ করা কর্ত্যব্য। তাহলেই আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে।