মো: আব্দুর রহমান:
মাছ চাষে সফল : ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ী ইউনিয়নের মহেচ্ছাতুল গ্রামের খায়রুন নাহার একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ইতোমধ্যে বেশ অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। মাছ চাষে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ২০১৫ সালে জাতীয় পুরস্কারে রুপা পদক লাভ করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করেন। সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের অর্থায়নে তিনি নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন সৃষ্টি ফেয়ার মৎস্য হ্যাচারি।
খায়রুন নাহার এখন এলাকায় মাছবন্ধু হিসেবে পরিচিত। কাজটা খুব সহজ ছিল না। মাছচাষ করতে গিয়ে স্বামী আবুল কালাম আজাদ প্রায় পথে বসে যান। সে সময় তাকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন তার স্ত্রী খায়রুন নাহার। শুরু করলেন এক নতুন সংগ্রাম। মাছচাষে সফলই হলেন না, পেলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। অনেক কষ্ট আর পরম মমতায় মাছের চাষ করেন। বয়স চল্লিশের কোঠায়। নিজের সন্তান নেই, তবুও উৎফুল্ল থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। সব সময় মেতে থাকেন মাছ নিয়ে। মাছচাষই তার নেশা ও পেশা।
নিজ গ্রামের ১১টি পুকুরে তার প্রকল্প এরই মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ ১১টি পুকুরে বর্তমানে রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্লাস কার্প, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ, শিং, মাগুর, গুলশা মাছের চাষ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে তার প্রকল্পে উৎপাদিত মাছের বিক্রির পরিমাণ ১ কোটি টাকার উপরে পৌঁছবে বলে আশা করছেন উদ্যমী এই নারী উদ্যোক্তা।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০১২ সালে নিজ উদ্যোগে জোগাড় করা ১ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন মাছের রেণু পোনা উৎপাদন। এ কাজে তার পাশে ছিলেন স্বামী। প্রচুর পরিশ্রম করে হ্যাচারিটি প্রতিষ্ঠা করলেও প্রথম ছয় মাসে তেমন ভালো ফল পাননি। কিন্তু তাতে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেননি খায়রুন নাহার। তত দিনে অনেক ধারদেনা হয়ে গেছে। ভেঙে না পড়ে আবারো বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধারকর্জ করে গ্রামে পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। পরের বছর ২০১৩ সালে সোনালী ব্যাংকের ঈশ্বরগঞ্জ শাখা ৪ লাখ টাকা নারী উদ্যোক্তা ঋণ পান তিনি। সোনালী ব্যাংকের অর্থায়নে খায়রুনের মাছ চাষ প্রকল্প বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে তত দিনে। ইতোমধ্যে খায়রুনের মাছ চাষ প্রকল্পে ভালো ফল আসতে শুরু করে। তার মাছ চাষের সাফল্য দেখে এবং প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে পরবর্তীতে সোনালী ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৮ লাখ টাকায় উন্নীত করে। খায়রুনের মাছ চাষ প্রকল্পের পুকুরের সংখ্যা ৪ থেকে বেড়ে ১১টিতে পৌঁছেছে বর্তমানে। তার প্রকল্পের আয়তন ১৭ একর।
এ বছর তার খামারে উৎপাদিত মাছ বিক্রির পরিমাণ ১ কোটি টাকার ওপরে পৌঁছবে বলে মনে করছেন এই সফল নারী উদ্যোক্তা। মাছ চাষ প্রকল্পের পাশাপাশি খায়রুন বর্তমানে বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে সৌরবিদ্যুতে পরিচালিত সেচ প্রকল্প চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন।
নিজ এলাকা ঈশ্বরগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, নরসিংদীর বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত গ্রামে সৌরবিদ্যুতে পরিচালিত সেচ প্রকল্প চালুর মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গ্রামীণ জনজীবনে নতুন পথের সূচনা করতে সচেষ্ট রয়েছেন পরিশ্রমী এই নারী উদ্যোক্তা। তার এ নতুন উদ্যোগে আগের মতো আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে পাশে দাঁড়াবে সোনালী ব্যাংক, আশা করছেন খায়রুন। এ ছাড়াও তিনি নিজস্ব উদ্যোগে গ্রামীণ নারীদের সংগঠিত করে একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্পে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করছেন।
গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়ন করতেই তার এ উদ্যোগ, তিনি জানালেন। তার নতুন উদ্যোগে অনেক গ্রামীণ নারীই সাড়া দিয়েছেন ইতোমধ্যে।
তিনি বলেন, গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জাতীয় উন্নয়নে নারীর সর্বাত্মক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই এখন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তার মতে অনেক নারীই এখন ঘরের চার দেয়ালের মাঝে নিজেদের বন্দি রাখতে রাজি নন। নিজের যোগ্যতা আর সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন করতে তারা অনেকটাই মনোযোগী এখন। নানা প্রতিষ্ঠানিক বাধা, সামাজিক সংস্কার, পুরনো প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি উপেক্ষা করে যারা এর মধ্যে নানা উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন তারা সাফল্যের নানা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নারী উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করে তাহলে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারেন তারা।
সফল নারীর স্বামী আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিনি যেখানে হার মেনেছেন, তার স্ত্রী সেখান থেকেই শুরু করেছেন। নিজে ব্যর্থ হলেও স্ত্রী সফল হয়েছেন মাছ চাষ করে। পরম মমতায় মাছ চাষ করে আজ তার স্ত্রী সফল। আর স্ত্রীর সকল কাজে তিনি এখন সহযোগিতা করেন। এদিকে তার স্ত্রীর মৎস্য খামারে কাজ করে অনেক পরিবারও আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেছে বলে জানান তিনি।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম সানোয়ার রাসেল বলেন, নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে খায়রুন নাহার একজন নারী হয়েও অনন্য উচ্চতার শিখরে পৌঁছেছেন। তার পাশাপাশি যেন উপজেলার অন্য নারীরাও মাছ চাষে আগ্রহী হন সে জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। মাছ চাষে খায়রুন নাহার সারাদেশের জন্য মডেল। খায়রুন নাহার শুধু নিজে সফল হননি, তার হ্যাচারিতে বেকার যুবক ও নারীরা নিয়মিত কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগও তৈরি করেছেন।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব কুমার সরকার বলেন, একজন সফল উদ্যোক্তা খায়রুন নাহার। নিজের কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃতও হয়েছেন। এটি নারীদের জন্য গর্বের। তাকে দেখে নারীরা উদ্বুদ্ধ হলে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটবে।