Site icon

মার্চ মাসের কৃষি পর্ব থেকে কৃষিতে এ সময়ের ভাবনা ও করনীয় সম্পর্কে জেনে নিন

This is an image caption

কৃষিবিদ ড. এম. এ. মান্নান

স্বাধীনতার মাস মার্চ মাস৷ এ মাসেই জাতি নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে৷ স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্যই আমাদের কৃষি৷ কেননা কৃষিই আমাদের কৃষ্টি৷ স্বাধীন বাংলার প্রায় ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিধানই কৃষির অন্যতম উদ্দেশ্য৷ কৃষিজীবী ভাই ও বোনেরা সে ব্রত নিয়েই কৃষি উত্‍পাদনে ব্যস্ত থাকেন৷
বসন্তের এ সময়ে বাংলার প্রকৃতিতে তাপদাহের পাশাপাশী চৈতালী হাওয়া কখনো কখনো ঠান্ডা হয়ে বয়ে চলে৷ এরকম আবহাওয়ার সাথে কোকিলের সুমধুর কন্ঠস্বর ঋতুরাজ বসন্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷ মূলতঃ আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে মার্চ মাস৷ গ্রামীণ জীবনে বাঙলীর ঐতিহ্যবাহী মেলার পসরা বসে এসময়ে৷ তাই গ্রামীণ সমাজে এসময়ের গুরুত্ব একটু ভিন্ন৷ প্রিয় পাঠক, স্বাধীনতার লাল গোলাপ শুভেচ্ছা নিন৷ চলুন জেনে নেই মার্চ মাসে কৃষিতে করণীয় সমর্্পকে৷

ধান

Picture2_6
যেসব ক্ষেতে বোরো ধানের চারা সময়মতো রোপণ করা হয়েছে সেসব জমিতে ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে৷ তবে যারা দেরিতে চারা রোপণ করেছেন তদের জমিতে চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে ইউরিয়া শেষ উপরি প্রয়োগ করে ফেলুন৷ অবশ্য গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করে থাকলে এ সময়ে আর নতুন করে সার প্রদান করতে হবে না৷ ধানের জমিতে ক্ষতিকর পোকা ও রোগের আক্রমণ হতে পারে এজন্য সতর্ক থাকুন৷ ক্ষেতে ডাল বা বাঁশের কঞ্চি পুতে দিয়ে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে পারেন৷ তাছাড়া আলোর ফাঁদ ব্যবহার করেও ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ তবে উপকারী পোকা ও প্রাণী সংরক্ষণ করতে পারলে সে গুলো ক্ষতিকর পোকা খেয়ে নিয়ন্ত্রণ করে৷ পোকা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অভিজ্ঞ চাষি, উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা অথবা অন্য কোন কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন৷ নিচু এলাকায় বোনা আউশ বা বোনা আমন বীজ বপনের সময় এখন৷ বৃষ্টি হলেও প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করে বীজ বপনের ব্যবস্থা নিন এবং সময়মত প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করুন৷
গম


মার্চ মাসের প্রথম পক্ষ থেকে গম পাকা শুরু হয়৷ পাকা গম গাছ এ সময় খড়ের মতো রঙ ধারণ করে এবং বাতাসে এক রকম ঝনঝন আওয়াজ হয়৷ তবে গম ফসল কাটার আগে মাঠে যে জাতের চাষ করা হয়েছে সে জাত ছাড়া অন্য জাতের গাছ সতর্কতার সাথে তুলে ফেলতে হবে৷ নয়তো ফসল কাটার পর বিজাতের মিশ্রণ হতে পারে৷ বীজ ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুব তাড়াতাড়ি মাড়াই-ঝাড়াই করে ফেলতে হবে৷ দেরি হলে বীজের আদর্্রতা বেড়ে যেতে পারে৷ এতে রোগ-পোকার আক্রমণ বেশি হয়৷ সংগ্রহ করা গম বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করুন৷
ভুট্টা


আপনার ক্ষেতের পাকা ভুট্টা সংগ্রহ করে শুকিয়ে নিন৷ এগুলো জ্বালানী এবং গো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়৷ তবে গবাদি পশুকে খাওয়ানোর আগে পানিতে ভিজিয়ে নিন৷ আপনি গ্রীষ্মকালীন ভুট্রা চাষ করতে চাইলে বীজ বপনের ব্যবস্থা নিতে পারেন এ সময়৷ এজন্য হেক্টর প্রতি (প্রায় সাড়ে সাত বিঘা) ২৫-৩০কেজি বীজ লাগবে৷ আর প্রতিহেক্টর জমিতে সার লাগবে ইউরিয়া ৯০ কেজি, টিএসপি ৫৫ কেজি, এমওপি ৩০ কেজি, জিপসাম ৪০ কেজি, এবং দস্তা সার ৪ কেজি৷
পাট


এ সময়ে বৃষ্টি হওয়ার পরপরই পাট চাষের জন্য জমি তৈরি করতে হবে৷পাটের জমিতে আড়াআড়ি ৫-৭টি চাষ ও মই দিতে হবে৷ তবে রবি ফসল যেমন-সরিষা, আলু, পেয়াজ, রসুন এসব চাষ করা জমিতে ২-৩টি চাষ দিলেই চলবে৷ জমিতে প্রয়োজন মত গোবর সার দিতে পারলে রাসায়নিক সার কম লাগবে৷ জৈব সার প্রয়োগ না করলে প্রতি হেক্টর জমিতে ১০০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি জিপসাম ও ১০ কেজি দস্তা সার প্রয়োগ করুন৷ বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করে নিতে পারলে পরবতীতে রোগের আক্রমণ কম হয়ে থাকে৷ এজন্য অনুমোদিত বীজ শোধন যেমন- ভিটাভেক্স বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করা যায়৷ রাসায়নিক বীজ শোধনের পরিবর্তে ১৫০ গ্রাম রসুন বাটা ১ কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে এবং তা শুকিয়ে বপন করতে পারেন৷ পাট চাষের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন, আগাম জাত ছাড়া অন্যান্য জাতের পাট বীজ চৈত্র মাসের আগে বপন করা যাবে না৷ এতে অল্প সময়ে গাছে ফুল এসে যাবে, পাটের ফলন ব্যহত হবে৷
গ্রীষ্মকালীন শাকসব্জি
গ্রীষ্মকালীন শাকসব্জি চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করতে হবে৷ এজন্য জমি তৈরী, মাদা তৈরী, সার প্রয়োগের কাজ করতে হবে৷ গ্রীষ্মকালে যেসব সব্জি চাষ করা যায় সেগুলো হলো গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ঢেড়শ, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দল, চিচিঙা, শসা, ওলকচু, পটল, কাকরোল, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, পুঁইশাক, লালশাক, কলমিশাক, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ইত্যাদি৷ এসব ফসলের উন্নত জাত সংগ্রহ করে বীজ বপন বা চারা রোপণ শুরু করতে হবে৷
অন্যান্য ফসল
ঝড়-বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হওয়ার আগেই পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, তেল ও ডাল ফসল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করে শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে৷ কাউনের শীষ বের হওয়ার সময় মাটিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে সেচের ব্যবস্থা করুন৷ এ সময় জমিতে সবুজ সার ফসল বিশেষ করে ধৈঞ্চা চাষের উদ্যোগ নিতে পারেন৷
সবুজ সার
নানা কারণে আমাদের জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে৷ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাওয়া এর অন্যতম কারণ৷ আবার জৈব সার পর্যাপ্ত পরিমাণে চেক করা৷ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনার জমিতে সবুজ সার ফসল চাষ করে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়াতে পারেন৷ সবুজ সার ফসল যেমন- ধৈঞ্চা, শনপাট, বরবটি, মাষকলাই, ছোলা, অড়হর চাষ করার এখনই উপযুক্ত সময়৷ বীজবপনের সময় চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে৷ এ ক্ষেত্রে জমিতে পানি থাকা প্রয়োজন৷ বৃষ্টি না হলে সেচ দিতে হবে৷ এতে সবুজ সার ফসল মাটিতে পচে জৈব পদার্থ যোগ করবে৷ সবুজ সার মাটির সাথে মেশানোর ৮-১০ দিনের মধ্যেই পরবতর্ী ফসল চাষ করা যাবে৷
গাছপালা :
এ সময়ে বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রস কমে যায়৷ এ অবস্থায় আপনার গাছের গোড়ায় পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এসময়ে আমের মুকুল আসে৷ এজন্য আমের রোগ/পোকার আক্রমণ থেকে সতর্ক থাকা উচিত৷ আম গাছে হপার পোকার আক্রমণ হলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিন৷ কাঁঠালের ফল পঁচা ও মুচি ঝরা সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ তাই প্রয়োজনে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়৷ এ সময় বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করা যায়৷ এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হয় এবং পরে উন্নত বরই গাছের কুঁড়ি দেশী জাতের গাছে সংযোজন করতে হয়৷ কলা বাগানের পাশর্্বচারা, মরা পাতা কেটে দিন৷ এখন পেঁপের চারা রোপণ করতে পারেন৷ তাছাড়া নার্সারিতে চারা উত্‍পাদনের জন্য বনজ গাছের বীজ রোপণ করুণ৷ বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায় মাটি ও জৈব সার প্রয়োগ করুন৷ বাঁশ ঝাড় পরিষ্কার করার এখন উত্তম সময়৷ তাই বাঁশ ঝাঁড়ের ভাঙ্গা রোগাক্রান্ত ও পচা বাঁশ পরিষ্কার করুন৷ নতুন করে বাঁশ ঝাড় তৈরী করতে হলে এখনই জমি তৈরী করে বাঁশের কাটিং লাগাতে হবে৷
পশু সম্পদ :
চৈত্র মাসে বেশ গরম পড়ে৷ তাই গবাদিপশুর এসময়ে বিশ্রামের প্রয়োজন৷ আপনার গবাদিপশুকে ছায়ায় রাখুন ও বেশী বেশী পানি খাওয়ান৷ সেই সাথে নিয়মিত গোসল করান৷ গবাদিপশুর গলাফুলার , তড়কা, বাদলা এবং মুরগীর রাণীক্ষেত, হাঁস-মুরগীর কলেরা রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন৷ গবাদিপশু ও হাঁসমুরগীর টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করুন৷
মত্‍স্য
মাছের আতুঁর পুকুর তৈরীর কাজ শেষ করতে হবে৷ পুকুরের মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে উদ্যোগ নিন৷ মাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য পরিমিত খাদ্য সরবরাহ করুন৷ মাছের রোগ হলে তা সারাতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন৷
প্রিয় পাঠক৷ সময় আসছে ঝড় বাদলের৷ ঘূর্ণি ঝড়ে ফলের গাছ সমূহ যেন ভেঙ্গে না যায় সে জন্য পূর্বে থেকেই সম্ভাব্য ফল গাছ বা অন্যান্য গাছপালা সমূহতে ঠেস দিয়ে দিতে হবে৷
প্রিয় পাঠক, কৃষি একটি জটিল প্রক্রিয়া৷ তাই এ ক্ষেত্রে সবসময় সর্তক থাকতে হয়৷ আপনার যে কোনো সমস্যায় স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাহায্য নিন৷
*ই-মেইল: dmannan2000@yahoo.com

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version