জান্নাত ঝুমা
কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের কৌশলঃ সাম্প্রতিককালে উপকূলবাসীর কাছে কাঁকড়ার উচ্চ বাজারমূল্য নতুন আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চট্রগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় নদী ও তৎসংলগ্ন খালসমূহে চিংড়ি পোনা সংগ্রহকারীদের জালে প্রচুর পরিমাণে কাঁকড়ার পোনা ধরা পড়ে। তাছাড়া জোয়ারের পানিতে কাঁকড়ার পোনা চিংড়ির ঘেরে প্রবেশ করে ও সেখানে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ফলে চিংড়ির সাথে বাড়তি ফসল হিসেবে প্রচুর কাঁকড়াও পাওয়া য়ায়। রপ্তানী বাণিজ্যে ¤হান করে নেয়ার কারণে উপকূলীয় জেলাগুলোতে কাঁকড়া চাষের ব্যাপকতা শুরু হয়েছে। কাঁকড়া রপ্তানী ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের রূপ ধারণ করেছে।
কাঁকড়া একটি লাভজনক পণ্য। বাংলাদেশ থেকে জীবন্ত কাঁকড়া আকাশ পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং ও মালয়েশিয়ায় কাঁকড়া রপ্তানি শুরু হয়। তখন কতিপয় রপ্তানিকারক নিজস্ব উদ্যোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও খুলনা অঞ্চল হতে কাঁকড়া সংগ্রহ করে ঐসব দেশে প্রেরণ করতেন। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এর চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় চিংড়ি চাষীদের মাঝে কাঁকড়া চাষ সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বিগত বছরগুলোতে এদেশ হতে ৫,০০০ হতে ৭,০০০ মেট্রিক টন কাঁকড়া তাইওয়ান, কোরিয়া, হংকং, চীন প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাপ্ত মাড ক্রাব বা শীলা কাঁকড়ার (Scyllaserrata) আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ও অধিক মূল্য, প্রাকৃতিক উৎসে পোনার প্রাচুর্যতা, স্বল্প সময়ে বাজারজাত করার সুযোগ ইত্যাদি কারণে উপকূলীয় চাষীদের কাছে কাঁকড়া চাষ ও ফ্যাটেনিং ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
কাঁকড়া চাষ ও পোনা উৎপাদন কৌশল
বাংলাদেশে কাঁকড়া চাষ ও ফ্যাটেনিং পুরোপুরিভাবে প্রাকৃতিক উৎস হতে আহরণের ওপর নির্ভরশীল। চাষের ব্যাপকতা বৃদ্ধির সাথে সাথে অধিক মুনাফা লাভের আশায় প্রাকৃতিক উৎস হতে নির্বিচারে মা কাঁকড়া, পোনা এবং অপরিপক্ক ছোট কাঁকড়া আহরণের প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কাঁকড়া চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বর্তমানে প্রচলিত প্রাকৃতিক উৎস হতে নির্বিচারে অপরিপক্ক/ছোট কাঁকড়া ধরার প্রবণতা রোধ করার জন্য এর পোনা উৎপাদন এবং চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। তদুপরি অপরিপক্ক ও ছোট কাঁকড়া আহরণের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্রমবর্ধমান কাঁকড়া শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাই কাঁকড়া চাষকে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীল রাখতে হলে চিংড়ির ন্যায় হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন অত্যাবশ্যক।
বর্তমানে কাঁকড়া চাষের চেয়ে ফ্যাটেনিং করে বাজারজাতকরণ অধিকতর লাভজনক। সাধারণতঃ অপরিপক্ক স্ত্রী কাঁকড়া (অপরিপক্ক গোনাড এবং ওজন ১৭০ গ্রামের নিচে) এবং অপুষ্ঠ পুরুষ কাঁকড়া (কম মাংশল এবং ওজন ৩৫০ গ্রামের নিচে) বিদেশে রপ্তানি হয় না। এগুলো স্থানীয় বাজারে খুব কম দামে বিক্রয় হয়। এই জাতীয় কাঁকড়াসমূহ উপযুক্ত পরিবেশে ২-৪ সপ্তাহ লালন-পালন করে গোনাড পরিপক্ক বা মাংশ পরিপুষ্ঠ করাকে ফ্যাটেনিং বলা হয়। আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধি, অপেক্ষাকৃত কম মৃত্যুহার, কম পুঁজি বিনিয়োগ এবং স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক প্রযুক্তি হিসেবে এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং কার্যক্রম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইন¯িটটিউটের পাইকগাছাস্থ লোনাপানি কেন্দ্র এবং কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে বিগত ২০০১ এবং ২০০৩ সালে প্রথম কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন বিষয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার কারণে ঐ সময়ে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন কার্যক্রম বেশীদুর অগ্রসর হয় নাই। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে লোনাপানি কেন্দ্রে পূনরায় জিআইজেড, বাংলাদেশ এর কারিগরি সহায়তায় কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। পাশাপাশি ২০১৫ সালে ওর্য়াল্ড ফিস এবং সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের যৌথ তত্বাবধানে স্থানীয় হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এই পর্যায়ে ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে প্রথম ও পরবর্তিতে লোনাপানি কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হয়।
লোনাপানি কেন্দ্রের হ্যাচারিতে তিন ধরনের লবণাক্ত পানি (২৫, ৩০ ও ৩৫ পিপিটি) ব্যবহার করে পরিপক্ক (গ্রাভিড বা দেহ গহবরে ডিমসহ) কাঁকড়াকে বেরিড (eggmass under abdominal flap) করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে, ৩৫ পিপিটি লবণাক্ততায় কোন বেরিড কাঁকড়া উৎপাদন করা যায় নাই। তবে ২৫ পিপিটি লবণাক্ততায় ১৯% এবং ৩০ পিপিটি লবণাক্ততায় ৬৯% কাঁকড়াকে বেরিড করা সম্ভব হয়েছে। আকার ভেদে প্রতিটি কাঁকড়া হতে ০.৭ হতে ৩.৮ মিলিয়ন পর্যন্ত হ্যাচিং পরবর্তি জুইয়া উৎপন্ন হয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের গবেষণায় মোট ৩টি পরিপক্ক মা কাঁকড়া হতে যথাক্রমে ৩.২ মিলিয়ন, ১.৬ মিলিয়ন ও ২.৬ মিলিয়ন হ্যাচিং পরবর্তি জুইয়া উৎপন্ন হয়েছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশে জোয়ার-ভাটা বিধৌত প্যারাবন সমৃদ্ধ মোহনা এলাকায় কাঁকড়ার আবাসস্থল হলেও পরিপক্ক স্ত্রী কাঁকড়া ডিম ছাড়ার জন্য গভীর সমুদ্রে চলে যায়। ডিম ছাড়ার পর পোনা অবস্থায় অর্থাৎ জুইয়া পর্যায়ে সমুদ্রের অগভীর এলাকায় অতিবাহিত করে এবং মেগালোপা পর্যায়ে জোয়ারের পানিতে ভেসে ভেসে পুনরায় এরা প্যারাবন এলাকায় চলে আসে। এরপর মোহনা ও প্যারাবন এলাকায় পরিপক্কতা লাভের পর পুনরায় গভীর সমুদ্রে চলে যায়। এভাবেই তাদের জীবনচক্র চলতে থাকে।
হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা ((crablet/crabinstar) উৎপাদন অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি। এক্ষেত্রে এশিয়ার অগ্রসর দেশসমূহ যেমন ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারতে কাঁকড়ার অনেক হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা পেলেও ব্যাপকতা লাভ করেনি। মূল বাধা কাঁকড়ার পোনার কম বাঁচার হার। যদিও প্রজাতি ও আকারভেদে পরিপক্ক কাঁকড়ার ডিম দেওয়ার ক্ষমতা অনেক (০.০৮ মিলিয়ন হতে ১০.০ মিলিয়ন পর্যন্ত), তবে কাঁকড়ার পোনার বাঁচার হার গড়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রায় ১০ ভাগ পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
ইনস্টিটিউটের দুইটি কেন্দ্র হতেই কাঁকড়ার পোনা প্রতিপালনের গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। হ্যাচারি পর্যায়ে কাঁকড়ার পোনা প্রতিপালনে, হ্যাচিং পরবর্তি জুইয়া হতে পূর্ণাঙ্গ কাঁকড়ায় রপ্তান্তরিত হতে মোট ৬টি ধাপ পাড় হতে হয়। এগুলো হচ্ছে জুইয়া-১ হতে জুইয়া-৫ পর্যন্ত ধাপ ও মেগালোপা ধাপ। জুইয়া-১ হতে জুইয়া-৫ ধাপসহ মোগালোপা হতে ক্রাবলেট এ রপ্তান্তর হতে মোট ২২-২৮ দিন সময় প্রয়োজন হয়েছে। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় পরিপক্ক কাঁকড়ার হ্যাচিং এর তথ্য পাওয়া গেলেও জুইয়া ধাপ পাড় হওয়ার তথ্য নাই। সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে দেশে সর্বপ্রথম কাঁকড়ার পূর্ণাংগ পোনা তথা মেগালোপা উৎপাদন হওয়ার সফলতা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। লোনাপানি কেন্দ্রে মোট পাঁচবার পোনা প্রতিপালন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। খাদ্য হিসেবে জুইয়া-১ হতে জুইয়া-২ পর্যন্ত রটিফার এবং জুইয়া-৩ হতে মেগালোপা পর্যন্ত আর্টিমিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবারই সফলতার সাথে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে, ক্রাবলেট পর্যন্ত পোনা বেঁেচ থাকার হার ০.০১ হতে ০.৫৪% পর্যন্ত পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত ক্রাবলেটগুলি পরবর্তীতে ১ মাস পর্যন্ত নার্সারী করে কিশোর এবং ৩ মাস পর্যন্ত প্রতিপালন করে অপরিপক্ক কাঁকড়ায় পরিণত করা সম্ভবপর হয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রথম। লোনাপানি কেন্দ্রে ইনস্টিটিউটের কাঁকড়া-কুঁচিয়া উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে বর্তমানে মৃতুহার কমিয়ে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবনের ওপর গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
হ্যাচারিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে যুগোপযোগী হ্যাচারি অবকাঠামো, গুণগত মান সম্পন্ন মা কাঁকড়ার প্রাপ্যতা, ব্যবহৃত পানি যথাযথ বিশুদ্ধকরণ, রোগ প্রতিরোধ ও সর্বপরি খাদ্য হিসেবে মান সম্পন্ন লাইভ ফিড সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাঁকড়া পোনার লালনের জন্য ওর্য়াল্ড ফিসের সহায়তায় ইতিমধ্যে ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে এবং জিআইজেড এর সহায়তায় লোনাপানি কেন্দ্রে পূর্ণাঙ্গ live feed culture laboratory স্থাপন করা হয়েছে, যা এতদঞ্চলে কাঁকড়া হ্যাচারি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখবে। লোনাপানি কেন্দ্র এবং কক্সবাজারের হ্যাচারিতে কাঁকড়া পোনা উৎপাদনের প্রাথমিক সফলতা কাঁকড়া চাষী ও চিংড়ি হ্যাচারি মালিকদের মাঝে আশার আলো সৃষ্টি করেছে। কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে ইনস্টিটিউটের পর্যাক্রমিক গবেষণা সফলতা অদুর ভবিষ্যতে অনেক চিংড়ি হ্যাচারি মালিক ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে আগ্রহী করে তুলবে। সেই সাথে উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁকড়া চাষের বিস্তৃতি ঘটবে এবং উপকূলীয় জীব বৈচিত্র্যও সংরক্ষিত হবে।
আমাদের চিংড়িস¤পদের ন্যায় কাঁকড়াও হতে পারে অর্থনৈতিক স¤পদ। মৎস্য রপ্তানি বাণিজ্যে চিংড়ির পরই কাঁকড়ার স্থান। এজন্য প্রয়োজন কাঁকড়ার পরিবেশ রক্ষাসহ সামগ্রিক উপকূলীয় জলজস¤পদের সংরক্ষণ ও সহনশীল মাএায় ব্যবহার। উপকূলীয় নদী ও প্যারাবনে পোনার প্রাচুর্যতা ও অল্প সময়ে বাজার উপযোগী হওয়ার কারণে চাষীদের মধ্যে কাঁকড়া চাষ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ প্রেক্ষিতে কাঁকড়ার চাষ আরও সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। তদুপরি কক্সবাজার অঞ্চলে নরম খোসার কাঁকড়া চাষ ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিপনন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন উৎস হতে পারে।