কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
‘প্রজাপতি নানা রঙে তড়বড়িয়ে উড়ে, মধু ভরা জংলী ফুলে বাগান খানি জুড়ে ’- সুনন্দ বর্ণিল প্রজাপতি নিয়ে কাব্য সাহিত্যে আছে নানা বর্ননা। আমাদের প্রাণ প্রকৃতির অনুসঙ্গ এ প্রজাপতি মায়াবি মুগ্ধ পতঙ্গ প্রাণ। প্রজাপতি নামক পতঙ্গটি নিসর্গের অলংকার স্বরূপ। অনাবলি সৌন্দর্যের প্রজাপতি সৃষ্টিকর্তার নিজ হাতে গড়া শিল্পিত প্রাণ। প্রজাপতি তার অপরূপ রঙের বর্ণিল পাখনায় ভর করে উড়ে নিসর্গে বিচরণ করে। প্রজাপতি প্রাণ যে শুধু তার সৌন্দর্য দিয়েই আমাদের মন আনন্দে ভরে দেয় না। এর অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেমন প্রজাপতি ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে, অন্যরে খাদ্য হসািবে বাস্তুসংস্থানের খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রজাপতি বৃত্তান্ত
প্রজাপতি প্রাণীজগতের Arthropoda পর্বের Insecta শ্রেণীর Lepidoptera বর্গের অন্তর্গত একটি পতঙ্গ। এদের দেহ মাথা, বক্ষ ও উদর এই তিন খণ্ডে বিভক্ত। মাথার ওপরের দিকে এক জোড়া করে এন্টেনা, পুঞ্জাক্ষী, পাল্প ও একটি নলাকার প্রবোসসি থাকে। প্রবোসসি দিয়ে খাদ্য হিসেবে তারা ফুল থেকে ফুলে মধু সংগ্রহ করে । দুই জোড়া রঙিন পাখনা ও দেহের সংযোগস্থল বক্ষ এবং উদররের শেষে দুই বা তনি খণ্ডে প্রজাপতির যৌনাঙ্গ থাকে যার সাহায্যে সঙ্গমের সময় স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাতি মিলিত হয়। পাল্প ছাড়াও বিস্ময়কর সংবেদনী অঙ্গ হিসেবে কাজ করে এদের পা। পায়ের শেষ খণ্ডকে কমোরসেপ্টিরে থাকে যা কোন কিছু স্পর্শ করে এর স্বাদ বুঝতে সাহায্য করে। প্রবোসিসের সাহায্যে খাদ্য হিসেবে ফুলের মধু সংগ্রজ করে। তবে পুরুষ প্রজাপতি ভেজা মাটি, অতিরিক্ত পাকা ফল কিংবা পচাগলা জৈব পদার্থ থেকে পানি ও খনিজ লবণ সংগ্রহ করে থাকে। এই ঘটনাকে Puddling বলা হয়।
সারা পৃথিবীতে প্রজাপতির রাজ্যে প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির অস্তিত্ব রয়েছে । বাংলাদেেশ এ পর্যন্ত প্রায় ৩২৬ টি প্রজাতি রয়েছে। যদিও এর সংখ্যা ৫০০ এর নিচে হওয়ার কথা নয়। কার্যকর গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের সঠিক সংখ্যাটি এখনও জানার বাইরে রয়ে গেছে ।
গবেষণার তথ্যে দেখা গেছে, প্রজাপতি পাহাড়ি এলাকায় গুল্ম জাতীয় গাছের সময়মত পরাগায়ন ঘটিয়ে বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল হতে পাহাড়কে ধসের হাত থেেক রক্ষা করে । প্রজাপতির সঙ্গে গাছপালার একটা নিবিঢ় সম্পর্ক রয়েছে। গাছপালার বংশ বিস্তারের জন্য যেমন পরাগায়ন দরকার হয় তেমনি প্রজাপতির জীবনচক্রে গাছপালার একটা বড় আছে। প্রথমত একটি প্রাপ্তবয়স্ত প্রজাপতি একটি নির্দিষ্ট গাছে ডিম দেয় এবং এই ডিম থেকে শুটকীট বরে হয়ে এই গাছের পাতা খেয়ে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি উদ্ভিদে ডিম পাড়ে। শুককীট ধীরে ধীরে বড় হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। গাছের একটি শক্ত ডালের সঙ্গে নিজেকে আটকে রাখে চারদিকে একটি শক্ত আবরণ তৈরী হয়। যাকে ‘পিউপা’ বলা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর পিউপা ভেঙে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি প্রকৃতিতে মুক্ত ভাবে ডানা মেেল উড়ে বেড়ায়।
বাংলাদেশে অবস্থান
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী প্রজাপতির প্রজাতি বৈচিত্র্যতা দেখা যায় উত্তরপূর্ব এবং দক্ষিণপূর্বে অবস্থতি প্রাকৃতিকভাবে ভাবে গড়ে ওঠা গহীন বনে। উত্তরপূর্ব অঞ্চলে বেশ কিছু প্রাকৃতিক বন যেন লাওয়াছড়া , সাতছড়ি, রেমাকেলেঙ্গা জাতীয় উদ্যানে দেখা মেলে। এছাড়াও বেশ কিছু সংরক্ষিত বনে দেখা মেলে অপরূপ সৌন্দর্যের বিভিন্ন প্রজাপতি। দক্ষিণপূর্ব কাপ্তাই, কর্ণফুলি, দুধপুকুরিয়া জাতীয় উদ্যান, বান্দরবানের কেওকারাডং, লামা ও থানচিতে বৈচিত্র প্রজাপতির দেখা মেলে। আর ঢাকা মিরপুরের জাতীয় বোটানক্যািল উদ্যানে কয়েক প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মেলে। এই উদ্যানে প্রায় ১৩৩ প্রজাতির প্রজাপতির বিচরণ। ওটঈঘ এর সহায়তায় বাংলাদেেশ প্রাপ্ত প্রজাপতির প্রজাতি পরিচিতি জানতে সবচেেয় বড় পদক্ষেপ নেন বিখ্যাত লেপিডপ্টেরেস্ট Torben B. Larsen । ২০০৪ সালে প্রকাশতি Butterflies of Bangladesh- an notated checklist বইয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রজাপতি নিয়ে বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন।
প্রজাপতি প্রকৃতিক স্বাস্থ্যের প্রতীক
প্রজাপতির জীবন চক্রে প্রতিটি ধাপে পরিবেশের বিশেষ প্রভাব লক্ষণীয়। এজন্য প্রজাপতিকে পরিবেশের বায়ো ইন্ডিকেটর বলা হয়। পরিবেশগত বিভিন্ন গবেষণায় প্রজাপতিকে একটি একক হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া আমাদের পাশ্ববর্তী মুক্ত প্রজাপতি উদ্যান প্রতিষ্ঠা করে প্রজাপতি সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশ পর্যটন ব্যবসার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। সচতনেতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলাদেশে কিছু প্রজাপতি বিলুপ্তির পথে। এর মূল কারণ মূলত নির্দিষ্ট প্রজাতির লাভার খাদ্যের যোগানকারী নির্দিষ্ট গাছের অভাব, নির্বিচারে বন উজার করে বাসস্থান তৈরী, বনর ওপর মানুষের দৌরাত্ম ও ধংসের আগ্রাসন,শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অসচতনেতা এবং অপরকল্পিতভিাবে কীটনাশক ব্যবহারে পতঙ্গনাশ । প্রজাপতি সবচেেয় সফল পরাগায়ণ হিসেবে পরিচিত। আর এজন্য প্রজাপতি পরিবেশের প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যেরে প্রতীক। পৃথিবীর সব প্রাণীই খাদ্যরে জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। তাই মানুষের জীবনপ্রবাহের জন্যই প্রজাপতিকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
বাটারফ্লাই বাংলাদেশ
বাটারফ্লাই বাংলাদশে মূলত সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক ভিত্তিক একটি গ্রুপ । কতিপয় প্রকৃতিপ্রাণ মানুষ মিলে ২০১২ সালের এ গ্রুপটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য মানুষের ও প্রাণ বৈচিত্র্যের জীবন প্রবাহকে বাঁচানো। সে লক্ষে প্রজাপতির প্রজাতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে এমন সুনন্দ প্রাণকে বাঁচানোর উদ্যোগে মানুষকে উদ্যোগী করা। দুইজন আলোকচত্রীির ভাললাগা থেকে ফেসবুকে এ সাইটির জš§ । এতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক বেশ কিছু প্রজাপতি গবষকে এতে যুক্ত রয়েছেন। পেইজটিতে প্রতিদিন নানা বর্ণিল প্রজাপতির পরিচিতি, জাত আর জীবনধারা নিয়ে ছবি পোস্ট হয়। এসব প্রজাপতি নিয়ে চলে নানা আলোচন। এ এই গ্রুপরে সদস্য সংখ্যা এখন ৯০০০ হাজার ছড়িয়েছে। শুধু দেশে নয় প্রজপতি মনের জানালা ছড়িয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। এই গ্রুপে বাংলাদশ ছাড়াও ভারত,নেপাল, ভূটান,সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড,ফিলিপাইন, রোম, মালয়েশিয়া থেকেও গ্রুপের সদস্যরা নিয়মিত প্রজাপতির ছবি পোস্ট ও শেয়ার করেন।
বাটারফ্লাই বাংলাদেশ গ্রুপের সদস্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত কুমার নিয়োগী জানান, বাটারফ্লাই বাংলাদেশ (ফেসবুক ভিত্তিক) নামে গ্রুপ পেইজটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মো. সাবু আনোয়ার, ওয়াহদুিরজামান সোহেল ও বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা হাসান মাসুদ । গ্রুপটির পেইজ অনেকটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালনা হচ্ছে । পেইজে প্রজাপতি নিয়ে আলোচনা করে থাকেন অভিজ্ঞরা । ফলে এক ধরনের বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও ব্যাখ্যা চলে এখানে। বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও ব্যাখ্যার জন্য সাহায্য করেন দেশী বিদেশী প্রজাপতি বিশেষজ্ঞরা। তাই পেইজটি সবসময়ই প্রজাপতি মনে প্রাণবন্ত হয়ে থাকে । নবীণ ফটোগ্রাফার থেকে শুরু করে অ্যামচোর প্রকৃতি প্রেমী সবার জন্যই এটি একটি প্রজাপতির জ্ঞানভান্ডার হিসেবে কাজ করছে।
পেইজটির অন্যতম উদ্যোক্তা আলোচিত্রী ও পরিবেশ কর্মী মো. সাবু আনোয়ার জানান,নে এটি IUCN এর অনলাইন কন্ট্রিবিউিটর হিসেবে কাজ করছে । বাংলাদশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রজাপতি প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা Butterfly Bangladesh সবসময় সোচ্চার ভূমিকা পালনে সচেষ্ট। প্রজাপতি সংরক্ষণের অংশ হিসেবে এ গ্রুপের পক্ষ হতে তিনটি ফটোওয়ার্ক ও একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েেছ । যার মূল উদ্দশ্যে ছিল মানুষরে মধ্যে প্রজাপতি সংরক্ষণে সচতনেতা বাড়ানো । এছাড়া গ্রুপ থেকে Butterfly Race নামে একটি ইভেন্ট পরিচালনা করে। এ পেইজে ২৫০ টিরও বেশি প্রজাতির ৫ হাজার ৬০০টি (৫৬০০) প্রজাপতির ছবি পোস্ট দেওয়া হয়েেছ । এতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২৭টির মত প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান মিলেছে। এর সন্ধান লাভ ও সনাক্তকরণ গ্রুপটির মাধ্যমে করা হয়েেছ । গ্রুপটি ৯ জন কার্যনির্বাহী সদস্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও ১০ জন প্রজাপতি গবেষকের সার্বক্ষণিক তদারকিতে গ্রুপের সদস্যরা প্রজাপতির পরিচয় পেয়ে থাকেন।
প্রজাপতি নিয়ে ৫ দিনের আলোকচিত্র প্রদর্শনী
বাংলাদেশে প্রজাপতি নিয়ে বড় পরিসরে আলোকচিত্র প্রদর্শণী এ পর্যন্ত হয়নি। তবে প্রজাপতি বাংলাদেশ এবারই দেশে এবার প্রথম বড় পরিসরে প্রজাপতি নিয়ে আলোচিত্র প্রদর্শণীর অনুষ্ঠিত হল জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারীতে। গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর গ্যালারীতে পাঁচ দিন ব্যাপী এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রজাপতি প্রাণ সুরক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে এ মহতি আয়োজন করেছিল বাটারফ্লাই বাংলাদেশ নামে সংগঠনটি। সারাদেশে প্রকৃতিপ্রেমী আলোকচিত্র গ্রাহকরা এ প্রদর্শনীর জন্য ছবি জমা দেন। বাছাই শেষে ৯২ জন আলোকচিত্রী ছবি চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয় আয়োজক কর্তৃপক্ষ । প্রায় দেড় শতাধিক প্রজাপতির ছবি এ প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়। এছাড়া প্রাণ ও পরিবেশ বিষয়ক প্রকাশিত বই,পোস্টারও এ প্রদর্শনীতে স্থান পায়। শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভাসহ প্রজাপতি নিয়ে ছিল নানা আয়োজন। জাতীয় জাদুঘরের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতায় এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে এ প্রজাপতির ছবি উৎসবে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন ও চ্যানেল আই ।
এ বিষয়ে বাটারফ্লাই বাংলাদেশ গ্রুপের অন্যতম উদ্যোক্তা বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা ও আলোকচিত্রী হাসান মাসুদ বলেন,আমাদের জীবন প্রবাহকে বাঁচাতে প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা অতি গুরৃত্বপূর্ণ। প্রজাপতি আমাদের নিসর্গের শুধু সৌন্দর্য বাড়ায় না নিসর্গের বিস্তার ঘটায়। প্রজাপতি সে অর্থে প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যের প্রতীক । প্রজাপতি আমাদের প্রাণ প্রকৃতি থেকে অনেক হারাতে বসেছে। তাই একে সচেতনভাবেই বাাঁচাতে হবে।
লেখক
মফস্বল সম্পাদক
কালের কণ্ঠ
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা
বারিধারা,ঢাকা।