বিজন বনের অপরাজিতা ফুল আছে যার নানা ভেষজ গুনাগুন

অপরাজিতা ফুল
মো. আব্দুর রহমান, বাকৃবি:
অপরাজিতা ফুল   ঃলাল, নীল, সাদা, বেগুনি, গোলাপি এমনি আরো কত রঙে রঙিন আমাদের পুষ্প-নিসর্গ! এর মধ্যে নীল ফুলের কথা বললে প্রথমেই আসে রূপসী অপরাজিতার নাম। লতানো গাছে সবুজ পাতার কোলে এক টুকরো প্রগাঢ় নীলের সম্ভাষণ ভাললাগার অনুভূতিকে নিমেষে ছুঁয়ে যায়। ফুলে কোনো গন্ধ নেই, তবু রঙের বাহার আর মিষ্টি শোভায় অনন্য সে অপরাজিতা

অপরাজিতা ফুলটি Popilionaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত যার ইংরেজি নাম বাটারফ্লাই পি। গাঢ় নীল ফুলটিকে ডাকা হয় নীলকণ্ঠ নামেও। নীল ছাড়াও চোখে পড়ে সাদা এবং হালকা বেগুনি রঙের ফুল। ফুলের ভেতরের দিকটা সাদা বা ঈষৎ হলুদ রঙের হয়ে থাকে। সাধারণত গাছের ডাল বর্ষা কালে স্যাঁত স্যাঁতে মাটিতে রোপন করতে হয়, ছোট ছোট ধূসর ও কালো বর্ণের বিচি রোদে শুকিয়ে নরম মাটিতে রোপন করতে হয়। বাড়ির আঙিনায়, টবে বা বাগানেও এ গাছ লাগানো হয়। আশেপাশের উঁচু গাছ বেয়ে এটি তরতর করে বেড়ে ওঠে, ফুলে-পাতায় বিকশিত হয়। হালকা সবুজ রঙের পাতার গড়ন উপবৃত্তাকার। ঝোপজাতীয় গাছে প্রায় সারা বছর ফুল ফোটে। বহুবর্ষজীবী এ লতা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।

আমাদের দেশে নীল, সাদা ও ক্বচিৎ বেগুনি-রঙের অপরাজিতা ফুল দেখা যায়। লতা জাতীয় গাছে এক পাপড়ি ও দুই স্তর পাপড়িতে এই ফুল হয়। পাশ্চাত্য উদ্ভিদবিদেরা বলেন, এই ফুল এসেছে মালাক্কা দ্বীপ থেকে। খুব প্রাচীনকালে এই দ্বীপ এশিয়াসহ অস্ট্রেলিয়া মিলে একটি মহাদেশে ছিল। টারনেটি বা মালাক্কা থেকে এসেছে বলে অপরাজিতার বৈজ্ঞানিক নাম ক্লিটোরিয়া টারনেটিকা। ক্লিটোরিয়া অর্থ যোনীপুষ্প। ফুলের ভিতরের আকৃতি দেখে এই নাম। কেরালায় একে বলে ‘শঙ্খপুষ্পী’। এই ফুলের বয়স অন্তত পাঁচ কোটি বছর। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, ঢাকায় রমনা পার্ক, শিশু একাডেমীর বাগান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, বলধা গার্ডেন ও কোনো কোনো অফিসের বাগানে এই ফুলের গাছ আছে।

নীল রঙের ফুল আমাদের দেশে ও বিশ্বে লাল, সাদা, গোলাপি, গাঢ় লাল ইত্যাদি ফুল থেকে কম। পৃথিবীর বিবর্তনের ধারায় নীল রং এসেছে সবার শেষে। আমরা এর নীল রঙের বৈভবে মুগ্ধ কিন্তু অপরাজিতা নামটিও সুপ্রাচীন ও মাধুর্যে অজেয় বা অদ্বিতীয়া। অপরাজিতা কেবল সৌন্দর্যে নয়, ওষুধি গুণেও অতুলনীয়। এর ফুল, পাপড়ি, মূল ও গাছের লতা নানা ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহার্য। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অপরাজিতা পবিত্র উদ্ভিদ। শারদীয় দুর্গোৎসবে ষষ্ঠীতে এবং বিজয়া দশমীর পুজোয় এ ফুল ব্যবহারের প্রচলন আছে। রূপকথার গল্পেও আছে অপরাজিতার নাম, পরিদের কাছে আংটি হিসেবে ছিল ফুলটির ব্যবহার। মূর্ছায়, শূল ব্যথায়, ভূতের ভয়ে উন্মাদে, গলগন্ডে, ঘন ঘন প্র¯্রাবে, মেধা বৃদ্ধিতে, স্বরভঙ্গে, শুকনো কাসিতে, আধকপালে বেদনায়, খোস-পাঁচড়ায়, মেহে ও শোথে অপরাজিতার মূল, পাতা বা ডাল ওষুধের কাজ করে। কবিরাজেরা এটা জানেন।

নীল অপরাজিতা বারো মাস ফোটে। তবে শীতে কমে যায়। নীল ফুলের গাছ যত তাড়াতাড়ি শাখা-প্রশাখা ছড়ায় সাদা তত তাড়াতাড়ি নয়। অপরাজিতা ফুল গুচ্ছে ফোটে না। পাতাভর্তি লতার ফাঁকে ফাঁকে এক একটি ফুল ফোটে, যেন এরা একা থাকতে ভালবাসে। আর তাতে আপনার ভাবুক মন আনমনে গেয়ে উঠতে পারে নজরুলের গান:

আমি বিজন বনের অপরাজিতা
আমার কথা কহি গানে…!

***************************

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *