Site icon

অর্থকরী ফসল চা-এর নানা প্রকার রোগ ও তার প্রতিকার

চা-এর নানা প্রকার রোগ

চা-এর নানা প্রকার রোগ

ড. কে, এম, খালেকুজ্জামান

চা-এর নানা প্রকার রোগ ঃপাটের পরেই চা বাংলাদেশের সব থেকে রপ্তানী হওয়া অর্থকারী ফসল। এ ফসলটি সিলেট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ হয়ে থাকে। চা চাষ করে বর্তমানে আমাদের কৃষকেরা অনেক লাভবান হচ্ছেন। কিন্ত চায়ের মোট উৎপাদন এবং হেক্টর প্রতি ফলন অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে অনেক কম। কম উৎপাদনের কারণগুলির মধ্যে রোগবালাই এর আক্রমণ অন্যতম। চায়ের কয়েকটি রোগ বিশেষ ক্ষতিকর করে থাকে। চা ফসলের রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। চা ফসলের প্রধান প্রধান রোগ এবং তাদের প্রতিকার নি¤েœ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১। রোগের নাম ঃ লাল মরিচা রোগ

রোগের কারণ ঃ সেফালিউরোস প্যারাসাইটিকাস এবং সেফালিউরোস মাইকোইডিয়া  (Cephaleuros parasiticus and Cephaleuros mycoidea) নামক শৈবালের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তারঃ শৈবাল আক্রান্ত অংশে স্পোরাঞ্জিয়াম উৎপন্ন করে। স্পোরাঞ্জিয়াম দুই ফ্লাজেলাবিশিষ্ট ডিম্বাকৃতি জুওস্পোর উৎপন্ন করে। জুস্পোার পানির মধ্যে বিচরণ করে এবং গাছের সংস্পর্শে এসে অংকুরিত হয়ে গাছকে আক্রমণ করে। বৃষ্টির দিনে এ রোগের প্রকোপ খুব বেড়ে যায়। গাছের উপর প্রখর রৌদ্র পড়লে রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

রোগের লক্ষণ ঃ
ক্স প্রথমে পাতার উপরিভাগে ছোট ছোট মরিচা রোগের ন্যায় দাগ পড়ে।
ক্স দাগগুলি প্রথমে ধূসর সবুজ রং বিশিষ্ট হয়ে থাকে।
ক্স তবে পরবর্তীতে লালচে বাদামী রং ধারণ করে।
ক্স দাগগুলো ক্রমশঃ বড় হতে থাকে এবং গোল আকার ধারণ করে।
ক্স দাগগুলি সামান্য উচু হয়ে থাকে এবং দাগের মধ্যে অবস্থিত শৈবাল দেহ অনেকটা মখমলের মত কোমল মনে হয়
ক্স শৈবাল পাতার উপত্বক ভেদ করে ভিতরের কোষে প্রবেশ কবে এবং পরভোজীর মত পাতা থেকে খাদ্য গ্রহণ করে।
ক্স পাতার আক্রান্ত অংশের কোষগুলো মরে যায়।
ক্স প্রচুর পরিমান লাল মরিচা দাগে পাতা আবৃত হলে সালোক-সংশ্লেষনে অসুবিধা হয়।
ক্স এতে গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে এবং ফলন কম হয়।
ক্স লাল মরিচা দাগ পত্রদন্ড, কচি ডাল ও কান্ডেও দেখা যায়।

রোগের প্রতিকার ঃ
ক্স রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন চায়ের জাত চাষ করতে হবে।
ক্স রোগাক্রান্ত ঝরা পাতা সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলতে হবে।
ক্স চা পাতা সংগ্রহের সময় আক্রান্ত পাতা তুলে ফেলতে হবে।
ক্স অপেক্ষাকৃত বেশী দূরত্বে গাছ লাগিয়ে শৈবালের আক্রমন এড়ানো যায়।
ক্স চা বাগানের ভিতর বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্স গাছের উপর ছায়ার ব্যবস্থা করে এই রোগ অনেকটা দমন করা যায়।
ক্স নির্ধারিত সারের মাত্রার চেয়ে সামান্য পরিমানে একটু বাড়িয়ে দিতে হবে।
ক্স বাগানে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ট্রাই ব্যাসিক কপার সালফেট গ্রুপের ঔষধ (যেমন-কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা কপার অক্্িরক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-সানভিট ৫০ ডব্লিউপি বা সালকক্স ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ৩-৪ বার পাতার উভয় পৃষ্ঠায় স্প্রে করতে হবে।

২। রোগের নাম ঃ গ্রে ব্লাইট রোগ

রোগের কারণ ঃ পেস্টালোশিয়া থিয়া (Pestalotia theae) নামক ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তারঃ ছত্রাক গাছের পরিত্যক্ত অংশে মাটিতে বেঁচে থাকে এবং নতুন গাছে রোগ সংক্রমণ করে। আর্দ্র আবহাওয়ায় কনিডিয়া গাছের সংস্পর্শে এসে অংকুরিত হয়ে গাছের কোষে অনুপ্রবেশ করে।

রোগের লক্ষণ ঃ
ক্স প্রথমে পাতার উপর ছোট ছোট বাদামী রংয়ের দাগ উৎপন্ন হয়।
ক্স ক্রমশ: দাগ সংখ্যায় ও আয়তনে বাড়তে থাকে এবং ধূসর বর্ণ ধারণ করে।
ক্স অনেক সময় একাধিক দাগ যুক্ত হয়ে পাতার উপর আঁকা-বাঁকা কিনারাযুক্ত বড় আকারের দাগ উৎপন্ন করে।
ক্স পাতার উপরের দাগের চারিদিকে গাঢ় রংয়ের বৃত্তাকার দাগ পড়তে দেখা যায়।
ক্স ধীরে ধীরে আক্রান্ত পাতা মরতে থাকে এবং তাতে ঝাড়ের গাছের প্রভ’ত ক্ষতি সাধন হয়।
ক্স এই রোগ প্রথমে ঝাড়ের একদিকে হয় এবং পরে তা সকল গাছে ছড়িয়ে পড়ে।
ক্স ছত্রাক বয়স্ক পাতার উপর কালো কালো বিন্দুর মতে এসারভ’লাস উৎপন্ন করে।

রোগের প্রতিকার ঃ
ক্স রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন চায়ের জাত চাষ করতে হবে।
ক্স শীতকালে আক্রান্ত অংশ ভালভাবে ছেঁটে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ক্স বায়োকন্ট্রোল এজেন্ট যেমন-ট্রাইকোডার্মা চা-এর বাগানে প্রয়োগ করতে হবে।
ক্স বাগানে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে থায়োফেনেট মিথাইল গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-টপসিন এম ৭০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা কপার অক্্িরক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-সানভিট ৫০ ডব্লিউপি বা সালকক্স ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ৩-৪ বার পাতার উভয় পৃষ্ঠায় স্প্রে করতে হবে।

৩। রোগের নাম ঃ ব্লিস্টার ব্লাইট রোগ

রোগের কারণ ঃ পেস্টালোশিয়া দি (Exobasidium vexans) নামক ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তার
এ ছত্রাক ব্যাসিডিওস্পোর উৎপন্ন করে এবং বাতাসের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে পাতার উপর পড়ে অংকুরিত হয়। পরে গাছে অনুপ্রবেশ করে মাইসেলিয়াম উৎপন্ন করে। আর্দ্র আবহাওয়ায় (৮৪%-এর বেশী) এ রোগ দ্রুত বিস্তারলাভ করে। তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রী সেঃ-এর বেশী হলে রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।

রোগের লক্ষণ ঃ
ক্স পাতার উপর ছোট ছোট গোল অথবা ডিম্বাকৃতি গোলাপী রংয়ের দাগ সৃষ্টি হয়।
ক্স কোনো কোনো সময় দাগগুলো লাল বর্ণ ধারণ করে।
ক্স আক্রান্ত পাতার উপরিভাগ সাদাটে এবং নীচের দিক ধোয়াটে অথবা সাদাটে মনে হয।
ক্স পাতার দাগগুলো কিছুটা নীচু মনে হয় এবং উল্টাদিকে ফোস্কার মতো ফুলে উঠে।
ক্স দাগ বেশী হলে পাতা কুঁচকিয়ে বিকৃত হয়ে পড়ে।
ক্স কচি ডগা বেশী আক্রান্ত হয়।
ক্স ছত্রাক মাইসেলিয়াম হতে হস্টোরিয়াম উৎপন্ন করে এবং এর সাহায্যে গাছ থেকে খাদ্য আহরণ করে।

রোগের প্রতিকার ঃ
ক্স রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন চায়ের জাত চাষ করতে হবে।
ক্স ডালপালা সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে ছাঁটতে হয়।
ক্স আক্রান্ত পাতা ও ডালপালা ছেঁটে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ক্স ডালপালা ছাঁটার পর কচি পাতা সংগ্রহ করে ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ক্স বাগানে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ট্রাই ব্যাসিক কপার সালফেট গ্রুপের ঔষধ (যেমন-কিউপ্রোক্স্যাট ৩৪৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা কপার অক্্িরক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-সানভিট ৫০ ডব্লিউপি বা সালকক্স ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর ৩-৪ বার পাতার উভয় পৃষ্ঠায় স্প্রে করতে হবে।

লেখকঃ উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব)
মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই,শিবগঞ্জ, বগুড়া, বাংলাদেশ।

Exit mobile version