এস এম মুকুল :
আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো ও সেমিনার
পোল্ট্রি শিল্প বর্তমান বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল একটি বহুমুখি শিল্প। গার্মেন্টসের পর পোল্ট্রিই দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শিল্পখাত। বলতে দ্বিধা নেই মেধাবী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠণে এবং পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে পোল্ট্রি শিল্প। এ খাত সংশ্লিষ্টদের নিরবিচ্ছিন্ন ভুমিকার ফলে দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মোট প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই জোগান দিচ্ছে এই শিল্পটি। এই শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যার সাথে কমবেশি ৬০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। আশার খবরটি হচ্ছে বর্তমান বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি দেশের ডিম ও মাংসের শতভাগ চাহিদাপূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদনও করছে এ শিল্পটি। বাংলাদেশে দ্রুত অগ্রসরমান পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনাকে সারাবিশ্বে জানান দিতে এবং বিশ্বেও পোল্ট্রি সায়েন্স জ্ঞান বিনিময়ের লক্ষ্যে বৃহৎ কলেবরে ১১তম আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো ও সেমিনার আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউ.পি.এস.এ) বাংলাদেশ শাখা এবং ‘বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি)। আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি সেমিনার অনুষ্ঠানটি হবে ২০১৯ সালের ৫-৬ মার্চ ঢাকার রিজেন্সি হোটেলেএবং আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো অনুষ্ঠিত হবে ৭-৯ মার্চ আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায়। আয়োজকদেও প্রত্যাশা এই আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের এই শিল্পের সম্ভাবনা সারাবিশ্বেও কাছে ছড়িয়ে পড়বে। পাশাপাশি সেমিনারের মাধ্যমে আমরাও পোল্ট্রি সায়েন্সেরা জ্ঝান-গবেষণা সম্পর্কে আরো সমৃদ্ধ হতে পারব। এবার ভিন্ন আঙ্গিকে এবং আরও জমকালোভাবে অনুষ্ঠিত হবে ১১তম আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো ও সেমিনার। পূর্বের বছরগুলোতে ‘পোল্ট্রি শো’ ও ‘সেমিনার’ একই সাথে অনুষ্ঠিত হলেও এবার ৫ ও ৬ মার্চ, ২০১৯ ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউ.পি.এস.এ) বাংলাদেশ শাখার উদ্যোগে ঢাকা রিজেন্সি হোটেলে ‘ইন্টারন্যাশনাল টেকনিক্যাল সেমিনার’ এবং ৭, ৮ ও ৯ মার্চ ডব্লিউ.পি.এস.এ বাংলাদেশ শাখা এবং ‘বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি) এর যৌথ উদ্যোগে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (আইসিসিবি) অনুষ্ঠিত হবে ‘ইন্টারন্যাশনাল পোল্ট্রি শো’। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের সাথে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানানো হয়।
একনজরে পোল্ট্রি শিল্প
বাণিজ্যিক খামারের সংখ্যা- ৬৫ থেকে ৭০ হাজার
জিপি অপর্ম- ৮টি কোম্পানির মোট ১৫টি
পিএস ফার্ম- ২০৫টি ( তথ্য : ডিপার্টমেন্ট অব লাইভস্টক সার্ভিস)
অনিবন্ধিত ফিড মিল : ১২৮টি (তথ্য : ডিপার্টমেন্ট অব লাইভস্টক সার্ভিস)
পোল্ট্রি বিষয়ক ওষুধ প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান : ৩০টির মতো।
বিনিয়োগ- ৩০০ বিলিয়ন টাকা
প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর্মসংস্থান- ৬০ লাখ
নারী কর্মসংস্থান : ৪০ ভাগ
দৈনিক মাংস উৎপাদন- ৪০০০ মেট্রিক টন ( সূত্র : bpicc-poultry.com)
দৈনিক ডিম উৎপাদন : ২ কোটি ৮০ লাখ।
বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। এছাড়াও আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ডিমের দৈনিক উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ। মাথাপিছু কনজাম্পশন ছিল প্রায় ৪১টি। ২০১৬ সালে ডিমের দৈনিক উৎপাদন ছিল প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ। মাথাপিছু কনজাম্পশন প্রায় ৫১টি। এই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে দৈনিক উৎপাদন হবে প্রায় ৪ কোটি ৫ লাখ ডিম। আর তখন মাথাপিছু কনজাম্পশন প্রায় ৮৬টিতে। পরিসংখ্যানে মুরগির মাংসের উৎপাদন ও কনজাম্পশন দেখানো হয়েছে, ২০১৪ সালে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন ছিল প্রায় ১,৫১০ মেট্রিক টন। তখন মাথাপিছু বার্ষিক কনজাম্পশন ছিল প্রায় ৩.৫ কেজি। ২০১৬ সালে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১,৮৫১ মেট্রিক টন। তখন মাথাপিছু বার্ষিক কনজাম্পশন ছিলো প্রায় ৪.২ কেজি। আর এ ধারাবাহিকতা থাকলে ২০২১ সালে হবে উৎপাদন হবে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ মেট্রিক। মাথাপিছু বার্ষিক কনজাম্পশন হবে প্রায় ৭ কেজি। এমন প্রেক্ষাপটে খাত সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০২০ সালের মধ্যে পোল্ট্রি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য রপ্তানি করা যাবে। আর এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হলে প্রাথমিক পর্যায়ে বছরে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব হবে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪’শ কোটি টাকা। এই শিল্পের সম্ভাবনা কত বড় তা সহজেই অনুমেয়।
ডব্লিউ.পি.এস.এ-বাংলাদেশ শাখা’র সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ অঞ্জন বলেন- পোল্ট্রি ব্যবসা এখন অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেছে। সাধারন খামারি থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রত্যেকেই লোকসানের জালে আটকা পড়েছে। কর ও শুল্কের বোঝা প্রতিবছরই বাড়ছে। এবছর আরও দু’টি নতুন প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে- একটি বিএসটিআই এর বাধ্যতামূলক মানসনদ এবং অপরটি হচ্ছে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড মোড়কীকরনে পাটের ব্যাগের বাধ্যতামূলক ব্যবহার। জনাব অঞ্জন বলেন, প্রান্তিক খামারিদের বাঁচাতে হবে এবং সেজন্য তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে হবে, তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে তাহলে আমাদের খামারিরাই অত্যন্ত উন্নতমানের ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদন করতে পারবে। মূলত: সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। তিনি বলেন- ঢাকা শো’টি এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় এবং কার্যকর শো। এবারের পোল্ট্রি শো’তে বিশ্বের ১০ থেকে ১৫ জন টপ মোস্ট রিসার্চারকে পেপার প্রেজেন্টেশনের জন্য আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এবারের স্লোগান ‘পোল্ট্রি ফর হেলদি লিভিং’। আমাদের দেশের স্বল্প শিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর খামারিদের অনেকেই বই পড়ে খামার ব্যবস্থাপনা বুঝতে পারেন না তাই এবার আমরা চিত্র-নির্ভর ম্যানুয়াল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এমনকি মডেল খামার তৈরির মাধ্যমে খামারিদের হাতে-কলমে শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি। জনাব অঞ্জন বলেন- মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই এই তিনটি ক্ষেত্রেই পোল্ট্রি শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ ছাড়াচ্ছে। পোল্ট্রি ফিডের উৎপাদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৪ সালে পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ছিল প্রায়: ২৫ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৬ সালে পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ছিল প্রায়: ৩৩ লাখ মেট্রিক টন। ২০২১ সালে পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন হবে প্রায়: ৫৫-৬০ লাখ মেট্রিক টন। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বে পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন ১০০ কোটি টন ছাড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ২০৫০ সালে তা বাড়াতে হবে ৬০ থেকে ৭০ গুণ।
ডব্লিউ.পি.এস.এ-বাংলাদেশ শাখার সাধারন সম্পাদক মাহাবুব হাসান বলেন- এবারের সেমিনারের পেপারগুলো যেন আরও বেশি প্রায়োগিক এবং বাংলাদেশের খামারিদের জন্য সহায়ক হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একই সাথে পোল্ট্রি মেলাতে এক্সিবিটররা যেন তাদের পণ্য ও সেবার সঠিক ডিসপ্লে ও প্রমোশন করতে পারেন, দেশি-বিদেশি ভিজিটররা যেন প্রতিটি স্টল ঘুরে দেখতে পারেন, দেশীয় খামারিরা যেন পোল্ট্রি ওয়ার্ল্ডের সর্বশেষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারেন, বিজনেস ডিল করতে পারেন সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই কাজ চলছে।
সূচনা বক্তব্যে জনাব আলী ইমাম বলেন- সেমিনার ও মেলা উভয়ক্ষেত্রেই পোল্ট্রি স্টেকহোল্ডারগণ যাতে পরিপূর্ণভাবে অংশ নিতে পারেন সে বিবেচনা থেকেই এবার সেমিনার ও মেলা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এবং ভেন্যুতে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জনাব সিরাজুল হক বলেন- দেশে পোল্ট্রি শিল্পের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ডব্লিউ.পি.এস.এ-বাংলাদেশ শাখা ১৯৯৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো ও সেমিনার আয়োজন করে আসছে। তবে এবারের আয়োজনটি পূর্বের যে কোন আয়োজন থেকে আরও বেশি নলেজ-বেজড এবং জমকালো হবে বলে।
জনাব তৌহিদ বলেন- ভিজিটরদের সুবিধা ও নিরাপত্তার কথা ভেবে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে শুধু মেলাই নয় এবার আরও থাকছে ডিম ও মুরগির মাংসের রেসিপি কনটেস্ট, ডিম-চিকেন সেলফি প্রতিযোগিতা, পোল্ট্রি র্যালি, মিডিয়া গেটকিপারদের সাথে মতবিনিময়সহ আরও বেশকিছু আয়োজন। জনাব তৌহিদ বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে অধিক সংখ্যক মানুষকে এ আয়োজনের সাথে সংযুক্ত করা। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয় পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করা, কাজের পরিধি বৃদ্ধি এবং সহজলভ্য ও স্বল্পমূল্যের নিরাপদ প্রোটিনের উৎস- ডিম ও মুরগির মাংসের প্রতি সাধারণ ভোক্তাদের আগ্রহ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন এক বাংলাদেশ এবং নতুন এক পোল্ট্রি শিল্প দেখবে বিশ্ব।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় দৈনিক, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং পোল্ট্রি ও কৃষি বিষয়ক ম্যাগাজিন-অনলাইনের প্রায় ৪০ জন সংবাদকর্মী। আয়োজকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডব্লিউ.পি.এস.এ-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি এবং বিপিআইসিসি’র সহ-সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ অঞ্জন, সাধারন সম্পাদক মো. মাহাবুব হাসান, নির্বাহী সদস্য মো. সিরাজুল হক, মো. তৌহিদ হোসেন, বিপ্লব প্রামানিক, মিডিয়া কমিটির আহ্বায়ক ডা. আলী ইমাম এবং প্রধান আহ্বায়ক কমিটির বিশেষ সদস্য ডা. এস.এম.এফ.বি আবদুস সবুর।