আমরা হয়ে গেছি ভেজাল চক্রের বলির পাঁঠা

ভেজাল চক্রের বলির পাঁঠা

ভেজাল চক্রের বলির পাঁঠা

বশিরুল ইসলাম

ভেজাল চক্রের বলির পাঁঠা
আমার মেয়ে জন্মগ্রহণ করেছে একমাস হলো। তার জন্মে পর থেকে আমার মনে একটা আতষ্ক কাজ করছে, সে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে কি? আমার এ আতষ্কে অন্যতম কারন হচ্ছে- খাদ্যে ভেজাল। আসলে খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এর ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে তাতে আতষ্কিত না হয়ে উপার আছে? যেদিকে তাকাই আর হাত বাড়াই ভেজাল আর ভেজাল। ভেজাল যেন এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। আইন বা নৈতিকতা কোনটাই খাদ্যে ভেজাল মেশানোকে রোধ করতে পারছে না। বরং দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে এ সমস্যা বেড়েই চলছে।

সংবাদ মাধ্যমের কল্যানে প্রতিদিনই ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভেজাল বিরোধী অভিযানে খাবারে ভেজাল মেশানো , মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য বিক্রির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি ভ্রাম্যমান আদালত কারওয়ান বাজারে কার্বাইড মিশ্রিত ৪৮৬ কাদি কলা, ৪০০ মন আম ধ্বংস করা খবর নতুন নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দায়ে স্বপ্ন’র একটি শাখাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। এসব খবর প্রায়ই আমরা পাচ্ছি, তবুও যেন টনক নড়ছে না অসাধু ব্যবসায়ীদের। মাছ, মাংস, তরিতরকারি থেকে শুরু করে তৈরি খাবার, ফলমূল এমনকি শিশুখাদ্যে পর্যন্ত ভেজালের ভয়ঙ্কর দৌরাত্ম্য!

আমার মনে হয়, আমাদের দেশ ছাড়া পৃথিবীতে এমন কোন দেশ পাওয়া যাবে না যারা খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মেশায়। খাবারের জন্য যে সব দেশে জনগণ হাহাকার করে সে সব দেশের ব্যবসায়িকরাও বোধ হয় এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় না। শুধু সামান্য কয়েকটি টাকার লোভে আমরা আমাদের সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিচ্ছি। লোকমুখে গল্প শুনেছি, এক লোক মনের দুঃখে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পুরো এক বোতল বিষ খেয়েও তিনি মারা গেলেন না। পরে জানা গেল ওই বিষের মধ্যেও ভেজাল ছিল। বস্তুত ভেজালের জালে বন্দী বাংলাদেশ, সময়মতো মুক্তি না পেলে হয়ে যাবে সব শেষ। ভেজালের এই মহোৎসবের পেছনে রয়েছে একশ্রেণীর অসাধু মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যারা সাধারণ মানুষকে বলি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বলা যায়, এ একরকম নীরব মানবহত্যা। তরমুজ, লিচু খেয়ে দেশে অনেক শিশু মৃত্যুর খবর বেশ আলোড়ন তুলেছিল। দিনাজপুরে লিচু খেয়ে ১৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।

দুধে পানি মেশানোর কথা বহুকাল আগে থেকেই শুনছি। এখন পানি মেশানো ছাড়াও গরুর শরীরে পিটুইটারি ইনজেকশন দিয়ে দুধের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এটাও একরকম ভেজাল। শাকসবজি কপার সালফেট পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় টাটকা তাজা দেখানোর জন্য। মৌসুমি ফল আম, লিচু, জামে দেওয়া হয় কারবাইড ও ফরমালিন। ফল গাছে থাকতেই ছিটানো হয় হরমোন ও কীটনাশক। সিরিঞ্জ দিয়ে তরমুজের ভেতরে দেওয়া হয় তরল পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট। এর ফলে তরমুজের ভেতর থাকে লাল টকটকে। ক্যালসিয়াম কারবাইড দিয়ে পাকানো হয় কলা। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণের জন্য মাছে দেওয়া হয় ফরমালিন। কফি পাউডারের সঙ্গে তেঁতুলের বিচির গুঁড়া, মসলায় ইটের গুঁড়া, হলুদে লেড ক্রোমেট বা লেড আইয়োডাইড মেশানো হয়। মুড়িকে ধবধবে সাদা, আকারে বড় করার জন্য বিষাক্ত হাইড্রোজ ও ইউরিয়া মেশানো হচ্ছে। দীর্ঘক্ষন মচমচে রাখার জন্য জিলেপি , চানাচুর তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে পোড়া মবিল। আকর্ষনীয় করার জন্য কাপড় ও চামড়ায় ব্যবহৃত রং ব্যবহার হচ্ছে সস্তা মানের আইসক্রিম, বিস্কুট, সেমাই, নুডলস এমনকি মিষ্টি তৈরিতে । এর ওপর অধিকাংশ ফলের রস তৈরি হচ্ছে ফল ছাড়াই, একে ফলের রস না বলে কেমিক্যালের রস বলাই বোধ হয় যুক্তিযুক্ত। আবার শোনা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে মানসম্মত খাবার আনার নামে মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার এনে নতুন স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করা হয়।

বাজার থেকে কোন ফল কিনে বাসায় রেখে দিলে কয়েকদিনের মধ্যে পঁচে নষ্ট হওয়ার কথা থাকলেও তা নষ্ট হচ্ছে না। দোকানে দেখা যায় আমসহ অন্যান্য ফল শুকিয়ে কুঁচকে যায় তবুও কোন এক যাদুর গুনে তা পঁচে না। এ সবই ফরমালিনের কারিশমা। ভেজালের ব্যপ্তি যেন বলে শেষ নেই। এসব ভেজাল, দূষিত খাদ্য গ্রহণের ফলে ব্যক্তিপর্যায়ে পুষ্টির অভাব থেকে ভোক্তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। জাতীয় জীবনের অর্থনীতিকেও মন্থর করে দিতে পারে ব্যক্তি পর্যায়ের এ পুষ্টিহীনতা এবং তা থাকে উদ্ভূত কর্মদক্ষতার অভাব। তাই বিষয়টি এখন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

একবার ভাবুন তো, আগে ক্যান্সার, হার্টঅ্যাটাক কতজন মারা যেত , আর এখন কতজন মারা যায়? একটু চিন্তা করে দেখুন, আপনার আমার পরিচিতজনদের এখন হরহামেশা কতজন ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে ? ক্যান্সারের ঝুঁকি কেন এত বেড়ে গেছে বলতে পারেন? কারণ এখন হাত বাড়ালেই ভেজাল খাবার পাওয়া যায়। না চাইলেও ভেজাল খাবার আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আমরা খাদ্যদ্রব্য হিসেবে বিষ খাই। এই বিষ আমাদের শরীরে ক্যান্সারসহ একগাদা খারাপ অসুখের বাসা বাঁধছে।

আমাদেরকে স্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে মারা হচ্ছে। মারা হচ্ছে বললে ভুল বলা হবে। বলা উচিত গণহত্যা করা হচ্ছে ! এত ঠান্ডা মাথায় সবার চোখের সামনে দিয়ে গণহত্যা করার নজির বোধহয় বিশ্বে আর কোথাও নেই। আমাদের দেশে আমরা খাদ্য খাইনা, বরং বিষ খাই। একজন খুনী কাউকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেললে যত বড় অপরাধ হয়, এভাবে প্রকাশ্যে একটা জনগোষ্ঠীকে বিষ খাওয়ানো কী রকম বড় অপরাধ হতে পারে ? একবার চিন্তা করে দেখুন !

আসলে কোনটা যে ভেজাল আর কোনটা যে ভেজালমুক্ত ভালো খাবার তার পার্থক্য করা এখন জটিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ থেকে পরিত্রানের কী কোন উপার নেই? নাকি অস্বাভাবিক মৃত্যুই পরিত্রানের উপায়। সবাই হয়তো সমস্বর এ বলে উঠবেন এ দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়- এর জন্য যা প্রয়োজন সেটা হল সচেতনতা এবং সকলের আন্তরিক উদ্যোগ। একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একটি সুস্থ ও প্রানোচ্ছল আগামী প্রজন্ম। তাই আগামী প্রজন্মকে বাঁচানোর স্বার্থে আমাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করতে হবে। নতুবা জাতি ক্রমেই মেধাশূন্য হয়ে যাবে।

কাজেই খাদ্যে বিষ ও ভেজাল মিশ্রনের বিরুদ্ধে সরকারকে যেমন দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে তেমনি জনতাকেও তাদের নিজস্ব স্বার্থে জন-স্বার্থবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এটাই সকলের প্রত্যাশা এবং প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত।

লেখকঃ
জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত)
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *