ড. মো. শরফ উদ্দিন
সারাদেশে বাড়ছে আমের আবাদ। চাষীরাও লাভবান হচ্ছেন আমের চাষ হতে কিন্তু ভোক্তারা তাদের পছন্দমত আম খুজে পাচ্ছন না বাজারগুলোতে। বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ফলে নিরাপদ ও রপ্তানিযোগ্য আম খুজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। ভালোমানের আম উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় রেখে উদ্ভাবন করা হয়েছে ফ্রুট বাগিং প্রযুক্তি। তবে ভালো ফলাফল পেতে সময়মতো নিয়মকানুন মেনেই ব্যাগিং করতে হবে। আবহাওয়াগত পরিবর্তন ও অক্ষাংশ জনিত পার্থক্যের কারণে আম সংগ্রহে তারতম্য হয়। দেশের সকল স্থানে ব্যাগিং করার সময় একই নয়। সর্ব প্রথমে ব্যাগিং শুরু হবে সাতক্ষীরা জেলায় এবং গোবিন্দভোগ জাতে। এরপর হিমসাগর/খিরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, বারি আম-৩ (আম্রপালি), বারি আম-৪ এবং আশ্বিনা জাতে। জেলার ক্রমানুসারে পাহাড়ি জেলাগুলোতে, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলায় ব্যাগিং শুরু হবে এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ হতে, ঝিনাইদাহ, মেহেরপুর জেলায় এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ হতে, নাটোর ও রাজশাহী জেলায় ২০ তারিখ হতে এবং সবশেষে অর্থাৎ এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলায়। তবে একটি গাছে কিছু আম এই সময়ের সপ্তাহখানেক আগেই ব্যাগিং করার উপযুক্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে যে কোন একটি চিহ্ন ব্যবহার করে ব্যাগিং আরম্ভ করা যাবে। নিম্নের আলোচনায় ব্যাগিং প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো।
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি কি?
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা বয়সে বিশেষ ধরণের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায়। ব্যাগিং করার পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত গাছেই লাগানো থাকে ব্যাগটি। আমের জন্য দুই ধরণের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। রঙিন আমের জন্য সাদা ব্যাগ আর অন্যান্য জাতের জন্য বাদামি রং এর ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। সুতরাং নির্দিষ্ট জাতের জন্য নির্দিষ্ট ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে।
ফ্রুট ব্যাগিং কেন প্রয়োজন?
আমের কাঙ্খিত ফলন নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ফলে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্রেকজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্প্রে করার প্রকৃত কারণ, ব্যয়, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকার কারণে আমচাষীরা এক মৌসুমে বহুবার স্প্রে করে থাকেন যা কোনভাবেই কাঙ্খিত নয়। আমচাষীরা আম সংগ্রহ করার পর থেকে পরের মৌসুমে আম সংগ্রহ করা পর্যন্ত ১৫-৬২ বার বালাইনাশকের ব্যবহার করে থাকেন। একইভাবে অন্যান্য ফল ফসলে বালাইনাশকের ব্যবহার বহুগুনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণার ফলাফল হতে দেখা গেছে, আমের উৎপাদনের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ২-৫ বার ¯েপ্র করলেই ভাল আম সংগ্রহ করা সম্ভব। মাত্রাতিরিক্ত স্প্রে যেমন জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি ফসলের উৎপাদনকেও ব্যয়বহুল করে তোলে। শুধু তাই নয় অতিরিক্ত স্প্রে করার ফলে উপকারী ও বন্ধু পোকার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে আমের কাঙ্খিত পরাগায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে।
এখন মুলত: আম উৎপাদনে বালাইনাশক স্প্রে করা হয় দেখাদেখি করে। প্রয়োজন থাকুক বা নাই থাকুক সেটি মুখ্য বিষয় নয়। অতীতেও ফল-ফসলে স্প্রে করা হতো কিন্তু বর্তমানে এর পরিমান অনেকগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জনজীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, প্রতিনিয়ত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে জানা-অজানা জটিল রোগে। এই অবস্থায় বিভিন্ন ফল উৎপাদনে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে বালাইনাশকের ব্যবহার অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে। গবেষণায় দেখা গেছে ব্যাগিং করা আম দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। আমকে সংরক্ষণ করতে প্রয়োজন হয় না ফরমালিন নামক বিষাক্ত রাসায়নিকের। এছাড়াও আমকে বাইরের বিভিন্ন ধরনের আঘাত, পাখির আক্রমণ, প্রখর সূর্যালোক এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে সহজেই রক্ষা করা সম্ভব। আমের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে আমের ফলছিদ্রকারী ও মাছি পোকা। এই পোকা দুইটি আমের বর্ধনশীল পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। যদি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগিং করা হয় তাহলে কোন স্প্রে ছাড়াই এই ক্ষতিকর পোকা দুইটির হাত থেকে আম ফলকে রক্ষা করা সম্ভব। ব্যাগিং প্রযুক্তিতে উৎপাদিত হবে বিষমুক্ত আম, কমবে আমের উৎপাদন খরচ, কমবে পরিবেশ দুষনের মাত্রা এবং বাড়বে আমের গুনগত মান।
আম উৎপাদনে ব্যাগিং প্রযুক্তি
আমে ব্যাগিং করার উপযুক্ত সময় ও পদ্ধতি ঃ
প্রত্যেক জাতের আমের জন্য ব্যাগিং করার সময় এক নয়। যেমন বারি আম-১, ২, ৬, ৭, খিরসাপাত এবং ল্যাংড়া জাতের আমে ব্যাগিং করা হয় ৪০-৫৫ দিন বয়সের গুটিতে। আমের অন্যান্য জাতগুলি যেমন বারি আম-৩, ৪, ৮, ফজলি ও আশ্বিনা জাতে ব্যাগিং করা হয় গুটির বয়স ৬০-৬৫ দিন হলে। এই সময়ে আম জাতভেদে মার্বেল আকারের বা এর চেয়েও বড় আকারের হয়ে থাকে। অর্থাৎ আগাম ও মধ্যম জাতের ক্ষেত্রে আগাম ব্যাগিং করতে হবে এবং নাবী জাতের ক্ষেত্রে একটু দেরীতে ব্যাগিং করতে হবে। আমের প্রাকৃতিক ঝরা বন্ধ হলে এবং ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্বেই ব্যাগিং করতে হয়। ব্যাগিং করার পূর্বে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালভাবে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ঠিক নয়। আমের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ তিনটি স্প্রে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন প্রথমবার আম গাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে, দ্বিতীয়বার মুকুল আসার পর অর্থাৎ আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি লম্বা হলে এবং আম যখন মটর দানারমতো হবে তখন একবার। সুতরাং এর পরপরই আমে স্প্রে করে ব্যাগিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আমে ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহারের নিয়মকানুনঃ
ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য কিছু অবশ্যই মেনে চলা জরুরী। অন্যথায় কিছু সমস্যা আসতে পারে। ফলে আমের বাজার মূল্য কমে যেতে পারে।
১. নির্দিষ্ট বয়সে ব্যাগিং আরম্ভ করতে হবে। একটি পুষ্মমঞ্জুরীতে অনেকগুলো আম থাকলে প্রথমেই ফল পাতলা করতে হবে। এরপর সবচেয়ে ভালো, দাগমুক্ত একটি অথবা দুটি আমে ব্যাগিং করতে হবে। তবে বড় জাতের আমের ক্ষেত্রে প্রতি পুষ্মমঞ্জুরীতে একটির বেশি ফল রাখা উচিৎ নয়। গায়ে মরা ও শুকনা আম, উপপত্র, মুকুলের অংশবিশেষ লেগে থাকলে বা ব্যাগিং করতে অসুবিধার সৃষ্টি করলে তা পরিষ্কার করতে হবে।
২. সময়মত প্রয়োজনীয় ব্যাগ সংগ্রহ করা এবং প্রয়োজনীয় শ্রমিকের ব্যবস্থা করা। চেয়ার বা টুল বা মই সঙ্গে থাকলে ভাল হয়। ব্যাগিং করার পূর্বে শুধু আমকে একটি কীটনাশক ও একটি ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে ভালোভাবে ¯েপ্র করতে হবে। এরপর আমগুলো শুকালে ব্যাগিং আরম্ভ করতে হবে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ব্যাগিং করা উত্তম। আম ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ও খোলা উচিৎ নয়।
৩. ব্যাগের উপরের অংশ দুই পার্শ্ব হতে ভাঁজ করতে করতে মাঝ বরাবর আসতে হবে। এরপর সংযুক্ত তার দ্বারা ভালোভাবে মুড়িয়ে দিতে হবে যেন কোন অবস্থাতেই পানি, পিপড়া, মিলিবাগ প্রবেশ করতে না পারে।
৪. রঙিন আমের জন্য একস্তর যুক্ত সাদা ব্যাগ এবং অন্য যে কোন জাতের জন্য বাদামি ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, দুই স্তর যুক্ত বাদামি রঙের ব্যাগ যে কোন আমকে রঙিন করতে পারে অর্থাৎ হলুদ করতে পারে।
৫. ব্যাগিং শুরু করার পূর্বে হাতে-কলমে শিখে নেওয়া ভালো। ব্যাগ ব্যবহার করার পর ছিড়ে গেলে বা নষ্ট হলে একত্রে করে পুড়িয়ে ফেলুন। পানিতে ডুবিয়ে রাখলেও পচে নষ্ঠ হবে।
ব্যাগিং প্রযুক্তির প্রধান সুবিধাগুলো হলো
নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের একমাত্র উপায়
বালাইনাশকের ব্যবহার ছাড়াই শতভাগ রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণমুক্ত আম পাওয়া সম্ভব
যে কোন জাতের আমকে রঙিন করা যায় এবং আমের সংরক্ষণকাল বাড়ানো যায় যেটি রপ্তানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন (সংরক্ষণকাল জাতভেদে ১০-১৪ দিন পর্যন্ত)
বালাইনাশকের ব্যবহার কমবে ৭০-৮০ ভাগ
ভালোমানের নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য আমচাষীরা এই প্রযুক্তিটি নিঃসন্দেহে ব্যবহার করতে পারেন। সঠিক সময়ে ও নিয়মকানুন মেনে ব্যাগিং করলে সবচেয়ে কম খরচে দাগমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করা যাবে। আম রপ্তানির ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট সকলকে এক সাথে কাজ করতে হবে। আম রপ্তানির ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ পরিহার করে দেশীয় স্বার্থকেই প্রধান্য দিতে হবে তবেই দেশের সুনাম অক্ষুন্ন থাকবে। এই প্রযুক্তিটির ব্যবহার মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণ সম্ভব হলে খুব সহজেই নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
লেখকঃ, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আ.উ.গ.কে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ