Site icon

আম উৎপাদনে সফলতার শীর্ষে বাংলাদেশ

আম উৎপাদনে


নিতাই চন্দ্র রায়

আম উৎপাদনে ঃ গত ১০ বছরে বাংলাদেশে আম চাষে ঘটে গেছে এক বিস্ময়কর বিপ্লব। উৎপাদন বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।আজ থেকে ১০ বছর আগে দেশে আমের উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন। আর ২০১৮-১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টনে। আম উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে মাথাপিছু বার্ষিক ভোগের পরিমাণ। স্বাদে. গন্ধে ও পুষ্টিগুণে আম অতুলনীয়। তাই আমকে বলা হয় ফলের রাজা। আমের সাথে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক । ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন, পলাশীর আ¤্র কাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল , স্বাধীনতার সেই সূর্য আবার উদিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আ¤্র কাননে।


দেশের ফল থেকে আসা পুষ্টি চাহিদার একটা বড় অংশের জোগান দেয় আম। জাতিসংঘের খাদ্যও কৃষি সংস্থার হিসেবে গত ১৮ বছরে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে আমের চাষ বেড়েছে। বছরে ১৬ শতাংশ হারে ফলটির উৎপাদন বাড়ায় মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগে বিশ্বে আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। আমের নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন, সারা দেশে চাষ সম্প্রসারণ , কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যহারের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে।
আগে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরার মতো কয়েকটি জেলাতেই আম চাষ সীমাবদ্ধ ছিল। আ¤্রপালি, বারিআম-৪ ও মল্লিকা Ñ এসব উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোর কারণে আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ফলের রাজা আম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থান করে নিয়েছে দেশের ৩০ টি জেলায় । আম চাষ বিস্তৃতি লাভ করেছে দেশের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলে। বৃহত্তর সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহের লাল মাটি অঞ্চলেও হচ্ছে সুস্বাদু আমের চাষ। আম চাষের এ বিপ্লবের পেছনে যে জাতটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পালন করে -তার নাম আ¤্রপালি ( বারিআম-৩)। বিদেশ থেকে জাতটি সংগ্রহ করে আমাদের দেশের জলবায়ুতে চাষ উপযোগীতা যাচাই করার পর ১৯৯৬ সালে সারা দেশে চাষের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। এ জাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- প্রতিবছরই এ জাতের গাছে আম আসে।গাছের আকার মাঝারি। অল্প জমিতে অনেক বেশি চারা লগানো যায়। চারা লাগানোর ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। ফলের রঙ ও আকার আকর্ষণীয়। স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমাণ উৎকৃষ্ট। ফলের শাঁস গাঢ় কমলা রঙের। ফলের গড় ওজন ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। মৌসুমে শেষে আষাঢ়ের তৃতীয় সপ্তাহে ফল পাকে, যখন অন্যান্য জাতের আম শেষ হয়ে যায়। ফলে কৃষক এ জাতের আম অনেক বেশি দামে বিক্রি করার সুযোগ পান।
পুষ্টি ও ভেষজগুণে আমের সাথে অন্য ফলে কোনো তুলনা নেই।কাঁচা আমে আছে প্রচুর ভিটামিন-সি। ভিটামিন-সি ত্বককে মসৃন করে। দাঁতের মাড়িকে মজবুত করে। সর্দিকাশি থেকে রক্ষা করে।পাকা আমে পাওয়া যায় প্রচুর ভিটামিন-এ । চোখের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি ও রাতকানা রোগ নিরাময়ে যার কোনো জুড়ি নেই। আমের রয়ছে নানা রকম ভেষজ গুণ। পাকা আম কিডনি, পরিপাকতন্ত্র ও ত্বকের জন্য উপকারী। শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে আম বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের নেতারা বলেন, এবার চাঁপাইনবাগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোর- এই চার জেলায় ৬৭ হাজার হেক্টর আম বাগান থেকে ৮ থেকে ৯ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হবে। আগামী চার মাস ধরে চলবে আম বাণিজ্য। এ বছর আমের দাম মোটামোটি সন্তোষজনক। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এই চার জেলায় এবার কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকার আম বিক্রি হবে । এ আম বাণিজ্যের সাথে প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। আম পাড়া, আম প্যাকিং, আম পরিবহন, আমের ঝুড়ি তৈরি, আম বেচা-কেনা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আম ব্যবসায়ীদের থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন কাজে এই এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে ফলের রাজা আম। অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, এবছর রংপুর জেলায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙ্গা জাতের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। এই পরিমাণ জমি থেকে এবার ১৫ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হবে এবং শুধু হাঁড়িভাঙ্গা জাতের আম বিক্রি করে ২০০ কোটি টাকা আয় করবেন এখানকার কৃষক।
আম উৎপাদনে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জকে পেছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের আর এক জেলা নওগাঁ। দেশের মোট উৎপাদিত আমের সিংহভাগই আসছে এখন নওগাঁ থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে সারা দেশে মোট আমের উৎপাদন ছিল ২৩ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে নওগাঁ থেকে আসে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪৮৬ টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসে ২ লাখ ৭৫ হাজার এবং রাজশাহী থেকে আসে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪২৬টন। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও নওগাঁতে আমের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৯১০ টন। সে বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপন্ন হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার টন আর রাজশাহীতে উৎপন্ন হয় ২ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন। জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের এক ফসলি জমিতে ধান চাষের চেয়ে আম চাষই বেশি লাভনক। সেখানে আমন মৌসুমে বিঘায় ১০ থেকে ১৪ মন ধান পাওয়া যায়। খরচ বাদ দিয়ে ধান চাষে তেমন লাভ হয় না। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে বছরে আয় হয় মাত্র ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে এক বিঘা জমিতে ৩০ টি আম গাছের চারা লাগানো যায়। চারা লাগানোর ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে প্রতিটি গাছ থেকে দেড় থেকে দুই মন আম পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতি বিঘা জমির আম বাগান থেকে বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার আম বিক্রি করা যায়। এ কারণে প্রতিবছর নওগাঁ জেলায় গড়ে ২ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আম বাগান গড়ে উঠছে। এই জেলাতে ল্যাংড়া, ফজলি, নাগফজলি, ক্ষীরসাপাতি, মোহনভোগ, গোপালভোগ, আশ্বিনা, আ¤্রপালি, মল্লিকা, গৌড়মতি, বারি আম-৪ ও বারি আম-১১ জাতের চাষ হচ্ছে বেশি। অন্যান্য জাতের চেয়ে উৎপাদন ও দাম বেশি হওয়ায় কৃষক বর্তমানে আ¤্রপালি , বারিআম -৪ ও বারিআম-১১চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। আজ থেকে সাত বছর আগে নওগাঁ জেলায় মাত্র ৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমের বাগান ছিল। সেখানে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত আমের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসরণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা থেকে ২০১৭ সালে ৩১ দশমিক ৮৩ মেট্রিক টন এবং ২০১৮ সালে ২৭ মেট্রিক টন নিরাপদ ও বালাইনাশকমুক্ত আম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তনি হয়। গত বছর ইসলাম এন্টার প্রাইজ লিমিটেড, এন আর ইন্টারনেশনাল, এন এইচ করপোরেশনসহ ১৪টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসব আম রপ্তানি করে। ২০১৫ সাল থেকে কৃষকের সঙ্গে সাতক্ষীরায় আম রপ্তানিতে কাজ করে যাচ্ছে সলিডারিডাড। এ বছর যাতে আরও বেশি পরিমাণ বিষমুক্ত আম রপ্তানি করা যায় সেজন্য বেশি সংখ্যক কৃষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়।
ম্যাংগো ড্রিংক, জুস ও ম্যাংগোবারসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী তৈরি করতে প্রতিবছরে ন্যায় এবারও আম সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু করেছে দেশের সর্ববৃহৎ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান প্রাণ । চলতি বছর ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রাণ গ্রুপ। প্রাণ কারখানায় ২৮ শে মে থেকে গুটি আম সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে, যা চলবে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এর পর আশ্বিনা আম থেকে পাল্প সংগ্রহ শুরু হবে। চলতি মৌসুমে নাটের, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্চ ,নওগাঁ, দিনাজপুর, মেহরপুর এবং সাতক্ষীরা থেকে আম সংগ্রহ করবে প্রাণ। সংগ্রহের পর এসব আম পাল্পিংএর জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে রাজশাহী ও নাটোরের কারখানায়। এ পাল্প থেকেই সারা বছর তৈরি করা হবে ম্যাংগো ড্রিংক, জুস ও ম্যাংগো বারসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী। প্রাণের মতো দেশের আম উৎপাদনকারী বিভিন্ন এলাকা আরও আম কেন্দ্রিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠুক এবং উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তনি হোক -এটাই আম চাষিদের প্রত্যাশা।
আমের অনিষ্টকারী পোকা-মাকড় ও রোগবালই দমনের জন্য এদেশে কৃষক মাত্রাতিরিক্ত বালাই নাশক ব্যবহার করেন। কখনো কখনো অপরিপক্ক আম পাকানোর জন্য মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হয় । আম রপ্তানি ও পরিভোগের ক্ষেত্রে Ñএটি একটি বড় অন্তরায়।তাই নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য আমাদেরকে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ ফাঁদ ও ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। ফ্রুটব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহারে একদিকে যেমন গুণগত মানের বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করা যায়, অন্যদিকে আমের উৎপাদন খরচ ও হ্রাস পায়। এছাড়া ব্যাগিং করা আম সংগ্রহের ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায় এবং আমের রঙও থাকে উজ্জ্বল- আকর্ষণীয়।
চাাঁপইনবাবগঞ্জের ক্ষীরসাপাতি আম সম্প্রতি দেশের তৃতীয় জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় এই আমে আলাদা স্টিকার ব্যবহার করা যাবে। ক্ষীরসাপাতি বিশেষ আমের জাত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দাম পাওয়া যাবে। জিআই সনদ অর্জনের ফলে দেশে ক্ষীরসাপাতি আম উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আম কেন্দ্রিক অর্থনীতি জোরদার হবে এবং দেশ- বিদেশে এ আমের ব্যাপক চাহিদা ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আম চাষের ক্ষেত্রে- এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্জন ও গৌরবের বিষয় ।
লেখকঃ
সাবেক মহাব্যস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
গোপালপুর , নাটোর

Exit mobile version