Site icon

ইট ভাটায় ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি ও পরিবেশ ঃ সোচ্চার হতে হবে এখনই

নিতাই চন্দ্র রাBrick pollutionয়ঃ

অপরিকল্পিত নগরায়ন বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, মিল-কারখানা, অফিস-আদালত ও স্কুল-কলেজ নির্মাণের ফলে প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে শতকরা একভাগ কৃষি জমি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ভাঙ্গন ও স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণেও কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপকভাবে। কৃষি জমির উপরের জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।মাটির এই অংশেই সঞ্চিত থাকে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ও উপকারী অনুজীব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ইট তৈরির নামে প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমির উপরের উর্বর মাটি পুড়ে বিনষ্ট করছে। শুধু উর্বর জমি বিনষ্ট নয়; ইটভাটা থেকে যে দূষিত গ্যাস ও তাপ নির্গত হয় তা আশে-পাশের জীবজন্তু, গাছ-পালা এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং মানুষের স্বাস্থ্যহানির কারণ ঘটায়। ইট ভাটার জন্য অনেক সময় ফল গাছে কোনো ফলই ধরে না, বা ধরলেও তা অকালে ঝড়ে পড়ে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এক সময় দেশে কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাবে । খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ব্যাহত হবে। ইট ভাটায় কয়লার ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকলেও বেশি লাভের আশায় কয়লার পরিবর্তে অবৈধভাবে পুড়ানো হচ্ছে কাঠ। নিধন করা হচ্ছে বৃক্ষ। উজার করা হচ্ছে বনভূমি। এতে বিনষ্ট হচ্ছে আমাদের জীববৈচিত্র ও চিরচেনা প্রকৃতি ও পরিবেশ।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন ( নিয়ন্ত্রণ) আইন,২০১৩ তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ইট ভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি( টপ সয়েল) ব্যবহার করলে প্রথম বারের জন্য দুই বছরের কারাদ- ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয় বার ওই্ একই অপরাধের জন্য ভাটা কর্তৃপক্ষকে ২ থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে।অনুমোদন না নিয়ে ইট ভাটা স্থাপন করলে এক বছরের কারদ- এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। আবাসিক জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, বনভূমি, জলাভূমি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এলাকায় ইট ভাটা স্থাপন করলে একই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। ইট ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার করলে তিন বছরের কারাদ- এবং তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তি হতে পারে।এসব আইন সরকারের অফিস আদালতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে কৃষি , পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দেশের সচেতন নাগরিক, কৃষি বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ।
কৃষিজমি নষ্ট ও পরিবেশের ক্ষতি করে ইট তৈরি এবং উর্বর ফসলি জমির উপরের অংশ দিয়ে ইট বানানো বন্ধ করতে হবে। মাটির ইটের বিকল্প হিসেবে যে সব উপকরণ ও প্রয্ুিক্ত উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকারের যে সব বিভাগ অবকাঠামো নির্মাণ ও তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদেরকেও এব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়গুলুকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন, ২০১৩-এর সংশোধন করতে হবে। গত ৯ জানুয়ারি, প্রথম আলো ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত‘ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন(নিয়ন্ত্রণ) আইন,২০১৩ শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে বক্তরা এসব কথা বলেন। সরকারিভাবে দেশে বর্তমানে ৬ হাজার ৯০৩ টি ইটভাটা রয়েছে। বছরে দেশে ইটের চাহিদা দেড় হাজার কোটি। এই ইট প্রস্তুত করতে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির দরকার হয়, যার বেশির ভাগই উর্বর কৃষি জমির উপরিভাগ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ইট প্রস্তুত খাত দেশের গ্রিনহাউজ গ্যাসের বড় উৎস। এ খাতে বছরে ২২ লাখ টন কয়লা ও ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়, যা বছরে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টন গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে। ভারতে ইট ভাটার জন্য মাটি তুলতে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশে তার প্রয়োজন হয় না। কৃষিজমি থেকে মাটি নিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করে ও স্বাস্থ্য খাতের ক্ষতি করে যেভাবে ইটভাটাগুলুতে ইট তৈরি করা হচ্ছে, তা চলতে দেয়া যায় না। সরকারি বিভিন্ন কাজে ইটের বিকল্প হিসেবে প্রস্তুত হওয়া উপকরণ ব্যবহারের উপর জোর দিতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার ২০২০ সালের মধ্যে শূণ্যের কোটায় নাামিয়ে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী খনন থেকে উঠে আসা বালু দিয়ে তৈরি করা ইট দিয়ে অনেক উঁচু ভবনও নির্মাণ করা যায়। সরকার নিজস্ব প্রকল্পে ইটের বিকল্প উপাদান দিয়ে নির্মাণ শুরু করলে আন্যান্যরাও উৎসাহিত হবে। আর যারা ইটের বিকল্প উপাদান প্রস্তুত করেছে, তাদের পণ্য বিক্রি বাড়বে। সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে লাল ইটের বিকল্প হিসেবে বালু দিয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ইট প্রস্তুত করেছে দেশের বেশ কিছু ইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।কিন্তু তাদের সেই বিকল্প সাদা ইট বিক্রি হচ্ছেনা ।ইট ভাটার কারণে সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাতাস। ঢাকার আশেপাশে রয়েছে পাঁচশতাধিক ইট ভাটা। বায়ু দূষণের কারণে শুধু ঢাকা শহরে প্রতি বছর সাড়ে তিন হাজার মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ৩২ লাখ মানুষ মৃত্যু বরণ করছে। গবেষকরা বলছেন, ম্যালেরিয়া এবং এইডসের মতো রোগে প্রতি বছর বিশ্বে যত লোক মারা যায়, বায়ু দূষণে তার চাইতে ও অনেক বেশি লোকের মৃত্যু হচ্ছে। পরিবেশ থেকে দূষিত বায়ু গ্রহণের ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক এবং ফুসফুৃসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। বিজ্ঞনীরা বলছেন, আগুন, কয়লা, বিদ্যুত কেন্দ্র, ইট ভাটা ,যানবাহন , চাষাবাদ ও শিল্পকারখানা থেকেই দূষিত হচ্ছে বায়ু। এর ফলে শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে এগুলো আমাদের শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আর আমরা নিজের অজান্তেই হার্ট এ্যাটাক , স্ট্রোক, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন অসুখ এবং ক্যান্সারের মতো জটিল এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি।
ইট ভাটার কারণে রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারা দেশে মানুষের রোগ-বালাই বেড়ে গেছে। আম ও লিচুর ওজন ও স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ইট ভাটায় বায়ু দূষণ মুক্ত ইট তৈরির প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মাটির ইটের পরিবর্তে বিকল্প ইট তৈরি করতে হবে। এসব প্রযুক্তির ব্যবহার ও গুণাগুণ সব দিক দিয়েই যে উত্তম তা ব্যাপক প্রচার করতে হবে।
বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ( বিসিএসআইআর) এর সাবেক পরিচালক ড. নাসরিন ফারুক তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রচেষ্ঠায়, বিকল্প ইট উদ্ভাবন করেন। আমাদের দেশে দালানগুলোতে যে ইট ব্যবহার করা হয়, তা মূলত মাটি পুড়ে তৈরি করা হয়। আর বিকল্প ইট মাটি না পুড়িয়ে ধানের তুষের ছাইয়ের সাথে অন্যান্য পদার্থের মিশ্রন ঘটিে তৈরি করা হয়, যা ভূমিকম্প সহনশীল ও পরিবেশ বান্ধব। এই বিকল্প ইটের ওজন প্রথাগত ইটের চাইতে তূলনামূলকভাবে অনেক কম। প্রতিটি বিকল্প ইটের ওজন হবে প্রায় ২ কেজি। অন্যদিকে প্রচলিত ইটের ওজন হয় প্রায় ৩ থেকে ৩.৫ কেজি। প্রতিটি বিকল্প ইটের দাম পড়বে ৮ থেকে ৯ টাকা। তবে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করলে এর দাম হবে আরও কম। প্রথাগত পদ্ধতিতে ইট তৈরিতে ব্যবহৃত কাঠ ও কয়লা থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া বায়ু দূষণ করে, যা গ্রিন হাউজের মতো ক্ষতিকর। অপর দিকে বিকল্প ইট তৈরিতে কোনো কৃষি জমি নষ্ট হয় না এবং গাছপালা ও ফসল উৎপাদনের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না।বাংলাদেশের মতো একটি ভূমিকম্পপ্রবন দেশে নতুন উদ্ভাবিত এই বিকল্প ইটের ব্যবহার বৃদ্ধিতে প্রিন্ট , ইলেকট্রনিক মিডিয়া, স্থপতি ও প্রকৌশলীদেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সেইসাথে বিকল্প ইটে তৈরি ইমারত হোক টেকসই , মজবুত, মূল্য সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব এই প্রত্যাশা সকল সচেতন মানুষের।

Exit mobile version