Site icon

মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালি গ্রামের ইসমাইলের ‘মাল্টাস্বপ্ন’

ইসমাইলের ‘মাল্টাস্বপ্ন’

কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল

ইসমাইলের ‘মাল্টাস্বপ্ন’ ঃ মেহেরপুর জেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিনে মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালি গ্রাম। গ্রাম পার হয়ে রশিকপুর সড়কের দিকে গেলেই হাতের ডানে দেখা মিলবে মাল্টা বাগান। প্রতিটি গছে থরে থরে সাজানো সবুজ রঙের মাল্টা ফলগুলো দেখে থমকে যেতে হবে। ১২ কাঠা (প্রায় ২০ শতক) জমিতে ৪৮টি মাল্টা গাছের সবগুলোর অবস্থা একই রকম। এলাকায় মাল্টার বাগান এই প্রথম হওয়াতে পথচারি সবাই একটি বার হলেও বাগানটিকে দেখতে ভুলেন না।
নতুন এ বাগান নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন ওই গ্রামের প্রবাস ফেরত ইসমাইল হোসেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন ৫ বছর আগে। ৫ বছর ধরেই তিনি এ বাগানটিকে পরিচর্যা করে যাচ্ছেন। অপর একটি স্থানে নতুন করে ১০ বিঘা জমিতে প্রায় ৭৫০টি মাল্টা চারা লাগিয়েছেন।
গত তিন বছর ধরে প্রথম বাগান থেকে তিনি ফল বিক্রি করে ভাল আয় করেছেন। তার এই মাল্টা চাষ দেখে এলাকার চাষীরা অন্যান্য চাষের পরিবর্তে মাল্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এলাকায় ইতিমধ্যে প্রায় ৫টি মাল্টা বাগান গড়ে উঠেছে। প্রতিটি বাগানে ইসমাইল হোসেন চারা সরবরাহ করছেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, মাল্টা সিটরাস সিনেসিস নামক উদ্ভিদ জাতীয় ফল। এটি জাম্বুরা (বাতাবি লেবু) ও কমলা এই দুই ফলের শংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলাদেশে বারি-১ জাতের মাল্টার চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটির স্বাদ এবং ফলন দুটোই ভাল। সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে ফল ধরে এবং এটি পরিপক্ক ভাবে কমলা রং ধারণ করে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে। তখন এটি বাজারজাত করা হয়ে থাকে। এটি স্থানীয় বাজার ছাড়াও রাজধানীর বাদামতলী মার্কেটে বিক্রয় করা হয়।
মেহেরপুরে মাল্টা চাষের উদ্ভাবক ইসমাইল হোসেন জানান, ভালো থাকার স্বপ্ন নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে সাড়ে ৫ বছরের প্রবাস জীবন আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। দেশে ফিরে এসে নতুন কিছু করার ভাবনা থেকে মাল্টা চাষ শুরু করেছি। খোঁজ নিয়ে জানলাম মেহেরপুর জেলায় এই চাষ কেউ করেননি। অথচ অত্যন্ত লাভজনক একটি চাষ। এই চাষে ক্ষতির কোন আশংকা নেই। চাষ শুরু করার ২ বছর থেকে ফল আসা শুরু করে। চাষের প্রথম বছরেই এর মূল বিনিয়োগ করা লাগে। তার পর থেকে মাঝে মধ্যে সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা করলেই হয়। তিনি জানান, প্রথম ২য় বছরে ১২ কাঠার বাগান থেকে যে পরিমান ফলে এসেছিল তা বিক্রি করে প্রায় ২০ হাজার টাকা, পরে বছর ৭০ হাজার এবং গত বছরে বিক্রি করেছেন ১লাখ ২০ হাজার টাকা। তার এই বাগানটি তৈরি করতে প্রথম বছর খরচ হয়েছিল মাত্র ২০ হাজার টাকা। অন্য যে ১০ বিঘার যে বাগানটি করেছেন সেই বাগানে এ বছর ফল আসলেও সেগুলো তিনি ফেলে দিয়েছেন। যাতে গাছগুলি সঠিক মাত্রায় বেড়ে উঠতে পারে। আগামি বছর থেকে ওই ১০ বিঘা বাগানের ফল বিক্রি করবেন।

ইসমাইল হোসেন আরো জানান, বারি-১ জাতের মাল্টা চারা সুস্বাদু এবং ফলন ভালো হয়। মাল্টার উপরিভাগে পয়সার মত আকৃতি থাকে বলে এটিকে পয়সা মাল্টাও বলা হয়। তিনি জানান, মাল্টা চাষকে আরো বিস্তৃত করার লক্ষ্যে তিনি নিজেই এ জাতের চারা তৈরি করে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করছেন। ইসমাইল হোসেনের মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোনাখালি সহ এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষক মাল্টাচাষে ঝুঁকেছেন। তারমধ্যে মোনাখালী গ্রামের শফি উদ্দিন, মুকল শেখ, হাবেল উদ্দিন, খাদেমুল ইসলাম, বন্দরের রাকিবুজ্জামান রাব্বি ও মজনু শেখ মাল্টা চাষ শুরু করেছেন। মেহেরপুর সদর উপজেলার বন্দর গ্রামের রাকিবুজ্জামান রাব্বি জানান, তার এক বিঘা জমিতে পেয়ারা চাষ আছে। ইসমাইল হোসেনের মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে পেয়ারা চাষের বদলে চলতি বছরে ওই জমিতে মাল্টা চাষ শুরু করেছেন।

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল কর্মকর্তা সজিব উদ্দিন স্বাধীন জানান, মাল্টা মূলত লেবু জাতীয় ফল। লেবুতে যে উপাদান রয়েছে মাল্টাতেও একই ভাবে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম এবং যথেষ্ট পরিমানে পটাশিয়াম রয়েছে। এতে মানব শরিরে এন্টি অক্সিডেন্ট তৈরি করে যার ফলে শরির থেকে বিষাক্ত পদার্থ নি:সরণ করতে সাহায্য করে। মাল্টা উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভুমিকা রাখে। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড.আখতারুজ্জামান বলেন, বাতাবি লেবু ও কমলা এই দুই ফলের সংকরায়নের মাধ্যমে মাল্টার উদ্ভাবন। বারি-১ জাতের মাল্টা স্বাদ এবং ফলন দুটোই ভালো। মেহেরপুরের মাটি মাল্টা চাষের জন্য উপযোগী। ইসমাইল হোসেন নামের এক প্রবাস ফেরত যুবক মাল্টা চাষে এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতা করা হচ্ছে। তার দেখাদেখি অনেক কৃষক মাল্টা চাষ শুরু করেছেন।

Exit mobile version