কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
সাম্প্রতিক বন্যায় শস্যভান্ডার বলে খ্যাত রংপুর কৃষি অঞ্চলে সদ্য রোপন করা রোপা আমন ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘ খরার পর ভারী বর্ষণে ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ধানের ক্ষেতগুলো ফিরে পেয়েছে সতেজতা। এমনকি তিস্তার চরাঞ্চলসহ এই অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের আমন ধানে শীষ বের হতে শুরু করেছে। প্রচলিত ধানের ক্ষেতের মাঝে উঁকি দিয়ে সদ্য বের হওয়া শীষ জানান দিচ্ছে সোনালী ধানের আগমনী বার্তা। এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে কৃষকদের মাঝে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি রোপা আমন মৌসুমে এই অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার ৯২৩ হেক্টর জমিতে চারা লাগানো সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রংপুরে এক লাখ ৬৩ হাজার ৯১৫ হেক্টর, গাইবান্ধায় এক লাখ ২১ হাজার ৮৮০ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৯৭ হাজার ২৮৫ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৮৪ হাজার ৮৪৮ হেক্টর এবং নীলফামারীতে এক লাখ ১২ হাজার ১৯৫ হেক্টর। কিন্তু অবিরাম বর্ষণসহ সাম্প্রতিক বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় মৌসুমের শুরুতে রোপণ করা পাঁচ হাজার ৫৪৮ হেক্টর জমির ধান ক্ষেত।
অন্যদিকে মৌসুমের শেষ দিকে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমিতে রোপন করা আমন ক্ষেতগুলো সজীবতা ফিরে পেয়েছে। আগাম রবি ফসল চাষের লক্ষ্য নিয়ে কৃষকরা এমন জমিতে প্রতি বছর স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের ধান চাষ করে থাকেন। অন্যান্য বছর এসব জমিতে বাড়তি সেচের প্রয়োজন হলেও এবারে ভারী বর্ষণে সেচ ছাড়াই আশানুরুপ ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি বিভাগ জানায়, রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলায় স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের ধানের মধ্যে রয়েছে ব্রিধান-৩৩, ব্রিধান-৩৯, ব্রিধান-৪৫ ও বিনা-৭। প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এই ধান চাষ করা হয়েছে। এছাড়া হাইব্রিড জাতও রয়েছে। এসব ক্ষেতে এখন শীষ বের হতে শুরু করেছে বলেও সূত্র জানায়।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সবুজ আমন ক্ষেতের (প্রচলিত বিআর-১১, স্বর্ণা জাত) মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের সদ্য বের হওয়া ধানের শীষ। কয়েক বছর ধরে ব্রি-৩৩ ও বিনা-৭ জাতের আগাম ধানের চাষ করেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘন্টা ইউনিয়নের হাবু গ্রামের কৃষক তৈয়ব আলী। তিনি জানান, প্রচলিত ধানের এক থেকে দেড় মাস আগে এ ধান কাটা যায়। এ অঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক মাসের অভাবের সময় (যখন এলাকায় কোনো কাজ থাকে না) এই ধান পাওয়া যায় বলে এলাকার মানুষ আগাম এ জাতের ধানকে ‘মঙ্গার ধান’ বলে থাকে। নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা, রনচন্ডি, গাড়াগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় চাষকৃত স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের আমন ধানে ব্যাপক শীষ বের হয়েছে। এখানকার কৃষকরা এই ধান কর্তনের পর আগাম আলু চাষ করেন। মাগুড়া গ্রামের কৃষক আকমল হোসেন দেড় বিঘা জমিতে আগাম ব্রি-৫৭ জাতের ধান চাষ করেছেন। ধানে শীষ বের হয়েছে। তিনি জানান, সরাসরি বপন করে ১০৫-১০৮ দিনের মধ্যে এ ধান কর্তন করা যায়। যেখানে অন্য যে কোনো জাতের ধান পাকতে সময় লাগে কমপক্ষে ১৪৫ দিন। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার রুদ্রেশ্বর এলাকার কৃষক আবু হোসেন বলেন, ‘হামার ধানোত শীষ বেড়াইছে বাহে…। আর কয়দিন পরে কাটা যাইবে। আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গা ঠেকা (মোকাবেলা) নাগবেতো!’ আগাম বিনা-৭ জাতের আমন ধানে শীষ বের হওয়ায় খুশিতে এমন অভিমত ব্যক্ত করে তিনি জানান, ওই জমিতে আগাম আলু চাষ করবেন। কৃষকরা জানান, স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের ধান চাষের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে যেমন অভাবের সময় ঘরে ফসল ওঠে তেমনি কৃষি শ্রমিকদেরও কর্মসংস্থান হয়। ধান কাটার পর ওই জমিতে আলুসহ পরবর্তী রবি ফসলও আগাম চাষ করা যায় বলে জানান তারা।
রংপুর অঞ্চলে মৌসুমের শেষ সময়ে কৃষক পরিবারে শুরু হয় টানাপোড়েন। প্রতি বছর আশ্বি—ন-কার্তিক মাসে (আমন ধানের কাটা মাড়াই শুরু না হওয়া পর্যন্ত) এখানকার কৃষি শ্রমিকদের হাতে কোন কাজ থাকে না। ফলে দেখা দেয় অভাব। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় মঙ্গা। এ সময় অভাবী মানুষজন গৃহস্থলী জিনিসপত্র বিক্রিসহ চড়াসুদে মহাজনী ঋণ গ্রহণ এবং আগাম শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন। কৃষি শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে ছুটতে বাধ্য হন এক জেলা থেকে আরেক জেলায়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত আগাম আমন ধান চাষ পদ্ধতি ও শষ্য বহুমূখীকরণের মাধ্যমে রংপুর অঞ্চলে মঙ্গা নিরসন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অভাবের সময় ঘরে তোলা যায় এমন আগাম ও স্বল্পমেয়াদী ধানের জাত সম্প্রসারনের লক্ষ্যে ২০০৪ সাল থেকে এ অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে সে উদ্যোগ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট (ব্রি) রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর এ অঞ্চলে মোট আমন আবাদের কমপক্ষে ২০ ভাগ জমিতে স্বল্পমেয়াদী ও আগাম জাতের ধান চাষ হয়। এতে নিজেদের খাবারের যোগানের পাশাপাশি গো-খাদ্যের সংকটও নিরসন হচ্ছে। এছাড়া আশ্বিন-কার্তিক মাসে (যে সময় কাজ থাকেনা) কর্মসংস্থান হচ্ছে কৃষি দিনমজুরদের।