Site icon

কম্পোস্ট সার ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ছেঃ বদলে যাচ্ছে নকলার কৃষি চিত্র

জৈব সার
মোঃ মোশারফ হোসেন, নকলা (শেরপুর) :

বাসা বাড়ির পরিত্যক্ত বর্জ্য থেকে পরিবেশ বান্ধব কম্পোস্ট সার (জৈব সার) তৈরি ও ব্যবহার করে শেরপুরের নকলা উপজেলার কৃষক নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছেন। কম্পোস্ট সার ব্যবহারে লাভবান হচ্ছেন উপজেলার হাজারো কৃষক। এতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে, বেড়েছে পরিবেশ বান্ধব জৈব সারের ব্যবহার। এতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে, দূষন মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকছে পরিবেশ। বাড়ছে বিষমুক্ত কৃষিপণ্যের উৎপাদন। বাড়ছে উৎপাদন কমেছে উৎপাদন ব্যয়। দিন দিন বদলে যাচ্ছে নকলার কৃষি চিত্র।

গৌড়দ্বার ইউপির ৪০দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের সহযোগিতায় কম্পোস্ট সার তৈরী ও ব্যবহারের ভিত্তিতে উপজেলা সমন্বয় সভায় ইতোমধ্যে পূর্বলাভা ও পাইষকা গ্রামকে কম্পোস্ট গ্রাম হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। রাসায়নিক সার ব্যবহার হ্রাস করে কম্পোস্ট সারের প্রতি সার্বজনীন ভাবে কৃষক ঝুঁকে পড়ায় উরফা ইউনিয়নের তারাকান্দা, শালখা, উরফা পূর্ব, উরফা পশ্চিম, উরফা মধ্য পাড়া; হাসনখিলা ও পিছলাকুড়ি গ্রাম গুলো কম্পোস্ট গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এখন শুধু সমন্বয় সভার অপেক্ষা। এই গ্রাম গুলোতে কম্পোস্ট সার তৈরিতে সহযোগিতা করেছে তারাকান্দা রাবার ড্যাম প্রকল্প। উক্ত গ্রামের বাড়ি বাড়ি স্থাপিত কম্পোস্ট প্রদর্শনী সবার নজর কেড়েছে। রাবার ড্যাম প্রকল্পের সহযোগিতায় গত দুই বছরে তৈরী হয়েছে শত শত কম্পোস্ট প্রদর্শনী। এতে কৃষকরা লাভবান হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা নিজ উদ্যোগে তৈরী করেছেন আরো অন্তত সহস্রাধিক কম্পোস্ট স্তুপ বা গাদা। তাছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজী প্রোগ্রাম (এনএটিপি-২) ও রাজস্ব খাতের আওতায় বিভিন্ন এলাকায় আরো অন্তত অর্ধাশতাধিক কুইক কম্পোস্ট প্রদর্শনীসহ শতাধিক বিভিন্ন কম্পোস্ট প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। এতে করে প্রতি বছর উপজেলায় কমকরেহলেও ১৫ লাখ টাকার রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কম্পোস্ট সার ব্যবহারে বাচছে টাকা, বাড়ছে বিষমুক্ত ফসলের উৎপাদন। তাতে খুশি ক্রেতা সাধারণ ও হাজারো প্রান্তিক কৃষক, লাভবান সব শ্রেণির কৃষিজীবী পরিবার।

তারাকান্দা গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম, হামিদুল, আশরাফ, ছোহরাব, শাহাদত, নূর হোসেন ও কাদির; কবুতর মাররি ইকরামূল ও শরীফ; ভূরদীর ছাইদুল, ঈসমাইল ও মকুল; হাসখিলার মানিক ফরাজী, পিছলাকুড়ির কফিল, উরফার দুদু মিয়া, চাঁনু মিয়া ও আজাহার আলী; পশ্চিম উরফার কৃষাণি হানিফাসহ অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের তৈরী কম্পোস্ট সার প্রয়োগে একদিকে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে অন্যদিকে মাটির উর্ব্বরতা ঠিক থাকছে। কমেছে রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা।

ভূরদীর ছাইদুল জানান, বর্ষাকালে দেশের আনাচে কানাচে খাল-বিল, নদী-নালা, ডোবা, হাওর-বাওরে বিপুল পরিমান কচুরি পানা জন্মায়। কচুরি পানা কম্পোস্ট তৈরির উৎকৃষ্ট উপাদান। পানার সাথে বিভিন্ন আগাছা, শস্যের অবশিষ্টাংশ, লতাপাতা, জংলা, বাড়ির পালানের উচ্ছিষ্ট, ছাই, হাঁস মুরগির বিষ্টা, গোবর ইত্যাদি মিশিয়ে কম্পোস্ট তৈরি করতে পারলে ফল ভালো পাওয়া যায়। এই সার সব ফসলের জমিতে ব্যবহার করা যায়। তবে ধান, গম, ভূট্টা, শাক-সবজি, আলু, পাট ইত্যাদি ফসলে বিশেষ ফলদায়ক। বেলে ও বেলে দো-আঁশ মাটিতে এটি বেশি উপকারে আসে। এই সার জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে তার পর চাষ দেওয়া উত্তম। তাড়াতাড়ি না পচঁলে কম্পোস্ট স্তুপের ধাপে ধাপে ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া ও টিএসপি সার ছিটিয়ে দিলে দ্রুত পঁচে যায়। কম্পেস্টের রং ধুসর হলে তা জমিতে ব্যবহার উপযোগী হয়। বন্যার পানি উঠেনা এমন স্থানে গাদা বা স্তুপ করা উচিত। কম্পোস্ট গাদায় বা স্তুপে পানি গেলে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই উপরে চাল দিতে হয়। তবে কড়া রোদে শুকিয়ে গেল গরুর চেনা ও পানি মিশেয়ে তাতে পরিমিত পরিমাণে ছিটিয়ে দিলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, কম্পোস্ট সার দুই ভাবে তৈরি করা করা যায। বন্যা ও অতিবৃষ্টি প্রবন এলাকায় স্তুপ পদ্ধতিতে, অন্য এলাকায় গর্ত পদ্ধতিতে। উভয় পদ্ধতিতে স্তুপের ভিতরে বাতাস প্রবেশের জন্য এক সপ্তাহ পর পর কাঠি দিয়ে ছিদ্র করে দিতে হয়। ২ -৩ দিন পর ছিদ্র গুলো আবার বন্ধ করে দিতে হয়। কাঠিদিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে গাদার ভিতরের কম্পোস্ট শুকিয়ে গেল ওই ছিদ্র দিয়ে গরুর চেনা ও পানি দিতে হবে। এমনিভাবে সংরক্ষণের দুই মাসের মধ্যে উত্তম সারে পরিণত হয়, যা জমিতে ব্যবহার উপযোগী হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর বলেন, জৈব সার তৈরি ও সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রতিটি কৃষক ভাইদের আরো বেশি যত্নবান হওয়া উচিত। তাতে নিজস্ব সম্পদ কাজে লাগিয়ে প্রায় বিনা খরচে জৈব সার তৈরি করা সম্ভব। নিজস্ব শ্রম ও গৃহস্থালী থেকে প্রাপ্ত উচ্ছিষ্ট এবং গৃহপালিত পশু পাখির বিষ্টা পচিয়ে অতি উপকারী কম্পোস্ট সার তৈরি করা যায়। তাই ইচ্ছা করলে প্রতিটি কৃষক নিজস্ব পদ্ধতিতে ছোটখাটো একটিসার কারখানা গড়ে তুলতে পারেন। এতে করে মাটির উৎপাদিকা শক্তি ঠিক থাকবে, পাশাপাশি কিছুটা হলেও রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। এর জন্য কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন ওই কৃষি কর্মকর্তা।

Exit mobile version