কৃষিবিদ মো. হামিদুল ইসলাম
আমাদের দেশে কীটনাশক প্রয়োগে ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা বা পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুয়েপমেন্টের বিষয়টি এখনো চাষিদের নিকট একপ্রকার অবহেলিতই রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য সমস্যায় কীটনাশকের সংস্পর্শ বা কন্টাক্ট অব পেস্টিসাইড – ঠিক কী কী ক্ষতিকর ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে অনেক চাষি জানেই না অথবা জানলেও অনেকে মানে না। এই না জানা কিংবা না মানার কারণে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। এমনকি কীটনাশক প্রয়োগের সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ না করা কিংবা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের কারণে মৃত্যুও হতে পারে। কীটনাশকের কন্টেইনার, বোতল অথবা মোড়কের গায়ে বা লেবেলে ঠিক যে ধরণের সতর্কতা বা সুরক্ষা ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া থাকে, ঠিক তেমনিভাবে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা মেনে চলা উচিত। পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অন্তর্ভুক্ত পেন স্টেট এক্সটেনশন বিভাগ তাদের পেস্টিসাইড এডুকেশন চ্যাপ্টারে উল্লেখ করেছে, While the primary reason to wear a respirator is use to protect your health, a secondary reason is that some pesticides product labels specify that a respirator be worn. Applicators are familiar with the phrase – the label is the law. You are legally required to follow all Personal Protective Equipment (PPE) instructions on the label. আবার ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব লেবার -এর অধীনস্ত সরকারি সংস্থা অক্যুপেশনাল সেফটি এন্ড হেলথ এডমিনিস্ট্রেশন (ওএসএইচএ) সুরক্ষা বিষয়ে সতর্ক করেছে ঠিক এভাবে, STOP HEALTH HAZARDS BEFORE THEY STOP YOU. অতি সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রতিবছর কীটনাশকজনিত বিষক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে ক্রণিক ডিজিজ বা দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভোগে সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। আর কৃষিতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিষয়ে অসচেতনতা, অবহেলা ও অনিচ্ছার কারণে কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে মৃত্যুর এই মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কীটনাশকজনিত মৃত্যুর হার বেশি – যেখানে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কৃষি নির্ভর দেশগুলো নতুনভাবে চিহ্নিত হচ্ছে। সুস্বাস্থ্যের প্রশ্নে বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার কারণ অনেকটায় বাড়িয়ে দেয়।
কৃষিতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও ফসল রক্ষার্থে আইপিএম বা ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্টের সর্বশেষ ধাপে স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম মেনে অতি স্বল্পমাত্রার কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। কীটনাশক প্রয়োগের সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে মাস্ক, গ্লাভস, হার্ড হ্যাট, গগলস, ফেস শিল্ড, অ্যাপ্রোন বা রেইন কোর্ট, গামবুট ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। কিন্ত আমাদের দেশে চাষিদের নিকট এসব উপাদান তেমনতর সস্তা কিংবা সহজলভ্যও নয়। তাই এসবের বিকল্প সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কীটনাশক প্রয়োগের সময় ভিন্ন ভিন্ন আকারের কয়েকটিমাত্র পলিথিন ব্যাগ দ্বারা নিজেকে সহজেই সুরক্ষিত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঢিলেঢালা একটি স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগ বা ট্রান্সপারেন্ট পলিব্যাগ মাথায় ঢুকিয়ে গলা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। দেখতে সমস্যা মনে হলে চোখে একটি স্বচ্ছ চশমা বা গগলস পরিয়ে নিতে হবে। আবার কীটনাশকজনিত কারণে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা মনে হলে নাকেমুখে কয়েক পর্দার একটি মাস্ক পরিয়ে নিতে হবে। কেননা ছিটানো কীটনাশকের ডাস্ট কিংবা স্প্রে করার সময় উৎপন্ন মিস্ট বা ক্ষুদ্র জলকণা ফিল্ট্রেশন করার কাজে মাস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে পলিব্যাগ মাথা বরাবর টাইট ফিটিং বা সেঁটিয়ে দিতে হবে এবং মাস্কের উপরে হরাইজনটালি বা সমান্তরালে পরপর তিনটি (এক বর্গইঞ্চির ছোট) ছিদ্র করতে হবে। কেননা, পেন স্টেট এক্সটেনশন তাদের রেসপিরেটরি প্রোটেকটিভ ডিভাইস ফর পেস্টিসাইডস আর্টিকেলে আরো জানিয়েছে, For many toxic chemicals, the respiratory (breathing) system is the quickest and most direct route of entry into the circulatory system. From the blood capillaries of the lungs, these toxic substance are rapidly transported throughout the body. অতঃপর একটি বড় আকারের পলিথিনের বস্তার (লং পলিব্যাগ) যে পাশে আটকানো থাকে সেই পাশে মাঝ বরাবর সামান্য বৃত্তাকারে বা রাউন্ড কাট দিয়ে নিতে হবে যাতে মাথা সহজেই ঢুকানো যায়। রাউন্ড কাটের পাশে তিন থেকে চার ইঞ্চি রেখে বস্তার কোনা বা কর্ণার থেকে লম্বা বরাবর ছয় থেকে আট ইঞ্চি পর্যন্ত স্লানটিং কাট বা আড়াআড়িভাবে কেটে নিতে হবে। এবার পলিব্যাগটি মাথায় ঢুকিয়ে গলা থেকে নিচের দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে যেন হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢেকে যায়। আরামদায়ক করার জন্য পলিথিন বস্তার যেপাশ পিছনে থাকে সেই পাশের মাঝ বরাবর ভার্টিক্যালি পরপর তিনটি ছিদ্র করে নেওয়া যেতে পারে। হলুদ বা নীল রঙের ফ্লোল্ডিং পলিথিন শীট দ্বারাও গলা হতে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে পলিথিন শীট শরীরের পার্শ্বীয় বরাবর খোলা থাকে। ইলাস্টিক ব্যান্ড বা পাটের রশি দ্বারা বুক ও কোমরে আটকিয়ে নিতে হবে। এবার দুইটি এক ফুট লম্বা পলিব্যাগ দিয়ে হাতের কবজি পর্যন্ত ঢেকে নিতে হবে যাতে সহজেই হাতের আঙ্গুলগুলো নাড়াচাড়া করা যায়। সুবিধামত দেড় থেকে দুই ফুট পরিমাণ পলিটিউবের সাহায্যে বা পলিব্যাগ টিউব আকারে কেটে দুই হাতের বাহু ঢেকে নিতে হবে। এবার লম্বা ঢিলেঢোলা একটি শার্ট বা লং স্লীভড শার্ট পরে নেওয়া যেতে পারে। কীটনাশক প্রয়োগের জন্য নির্বাচিত ফসলের মাটি শুকনো হলে পলিব্যাগ দ্বারা দুই পা ঢেকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে পায়ে পুরনো নষ্ট চটি বা কেডস পরলে পায়ের তলার পলিথিন ফেটে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। কাদাযুক্ত মাটিতে কয়েকটি পলিব্যাগ একত্রে পায়ে ঢুকিয়ে কাপড় বা পলিথিনের ফিতা দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে নিতে হবে। পায়ের গোড়ালি যাতে সহজে নাড়াচাড়া বা ঘোরানো যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। লম্বা পলিথিনের বস্তাটি পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে বারবার ব্যবহার করা যায়। তবে প্রথমবার ব্যবহারের সময় যে পৃষ্ঠ শরীরের বাহিরে ছিল দ্বিতীয়বার ব্যবহারের সময়ও সেই পৃষ্ঠায় বাহিরে রাখতে হবে। অর্থাৎ আপাদমস্তক পুরো শরীরটাকে পলিথিন দ্বারা পানিরোধী বা ওয়াটার প্রুফ করে নিতে হবে। আর ওয়াটার প্রুফের পরিবেশ সৃষ্টিতে যে কয়টি পলিব্যাগ ও পলিটিউবের প্রয়োজন পড়বে সেগুলো যদি আমরা আবার ফিরে দেখি বা রিভিউ করি তাহলে পাই-
১। মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পরার একটি পলিব্যাগ,
২। গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত একটি বড় পলিব্যাগ বা পলিবস্তা,
৩। সমস্ত আঙ্গুলসহ হাতের কবজি পর্যন্ত ঢাকবার দুটি পলিব্যাগ,
৪। দুই বাহুতে দুটি পলিটিউব। তবে কবজি পর্যন্ত ঢাকবার পলিব্যাগ দুটি বড় হলে পলিটিউবের প্রয়োজন হবে না।
৫। পায়ের গোড়ালিসহ হাঁটু পর্যন্ত ঢাকবার দুটি পলিব্যাগ।
যেহেতু এসব পলিথিন দ্বারা পুরো শরীরে একটি পানিরোধী বা ওয়াটার প্রুফ পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেহেতু এই সুরক্ষা ব্যবস্থায় অনেকটা বায়ুরোধী বা এয়ার টাইট পরিবেশও সৃষ্টি করে। সাধারণতঃ শীতের সময় এরকম সুরক্ষা ব্যবস্থা তেমনটা সমস্যার সৃষ্টি করে না। কিন্তু গরমের সময় বা বিকেল বেলার রৌদ্রে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে কদাচিৎ অস্বস্তি বা অতিগরম বা হিট ইনজুরি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। কোন অবস্থাতেই প্রখর রৌদ্রে কিংবা বৃষ্টিতে কীটনাশক প্রয়োগ করা ঠিক নয়। যদি অস্বস্থি বোধ হয় তবে অতি তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে কিংবা খুব বেশি খারাপ লাগলে কাজ বন্ধ করে দ্রুত সমস্ত পলিথিন শরীর থেকে ছাড়িয়ে ঠান্ডা বাতাসে বসতে হবে এবং পরিমাণ মতো টিউবয়েলের পানি পান করতে হবে। আবার স্বাভাবিক অবস্থাতেও কীটনাশক প্রয়োগ শেষ করার সাথে সাথে শরীরের সমস্ত পোশাক ছাড়িয়ে বা পরিবর্তন করে দ্রুত গোসল করা উচিত। কীটনাশক প্রয়োগ শেষে দ্রুত গোসল না করে অযথা দেরি করা কিংবা গল্পগুজবে কালক্ষেপণ অথবা অন্য কোন কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা মোটেও সমীচীন নয়। আবার শারীরিক দুর্বল প্রকৃতির মানুষ কিংবা যাদের শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসের সমস্যা আছে, তাদের কখনোই কীটনাশক নাড়াচাড়া, ফসলে প্রয়োগ করা অথবা প্রয়োগকৃত জমিতে প্রবেশ করা উচিত নয়। শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও গর্ভবতী মহিলাদেরকে কীটনাশকের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। ফসলে কীটনাশক প্রয়োগের পর অতিরিক্ত কিংবা অব্যবহৃত কীটনাশক ক্রপ প্রোটেকশন এজেন্ট বক্স বা সিপিএ বক্সে তালাবন্ধ করে রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- PESTICIDES MEANS ALWAYS HEALTH HAZARD ELEMENTS অর্থাৎ কীটনাশক মানেই স্বাস্থ্য ঝুঁকিকর উপাদান।
তাই সহজলভ্য, অর্থ সাশ্রয়ী এবং অতি সহজ উপায়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং আমাদের হতদরিদ্র চাষিদের কথা বিবেচনায় রেখে এই সুরক্ষিত পলিথিন পদ্ধতি বা প্রোটেকটিভ পলিথিন সিস্টেম (পিপিএস) বা পিপি সিস্টেম অবলম্বন করা যেতে পারে।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম