ডঃ নীলুফার ইয়াসমিন শেখ:
১. ভূমিকা
কৃষিতে নারীর অবদান অপরিসীম ও অতুলনীয়। এক কথায় নারীর হাতেই কৃষির শুরু। শস্য উৎপাদনের জন্য বীজই হচ্ছে প্রধানতম নিয়ামক। আর বীজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটাই শুরু হয়েছিল নারীর হাত দিয়ে। অতএব কৃষিকাজ প্রবর্তনের সর্বপ্রথম দাবীদার নারী।
২. যেভাবে শুরু
মানব প্রজাতির বিবর্তনের প্রথম স্তরের দিকে পশু, মৎস্য ইত্যাদি শিকারের পাশাপাশি ফল, লতা, গুল্ম, বীজ ইত্যাদি আহরণ ও সংগ্রহ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। পরবর্তীকালে শিকারের প্রাপ্যতা কমতে থাকায় এবং ফলমূল, বীজ ইত্যাদি আহরণ কম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ঐগুলি আহরণের উপর বেশ খানিকটা নির্ভরশীলতা শুরু হয়। নারীকে যেহেতু প্রকৃতিগত ভাবেই নয় মাস দশ দিন সন্তনকে শরীরের ভিতরে ধারণ ও লালন করতে হয় এবং প্রসবের পর বেশ কয়েক বছর ধরে পালন করতে হয়, সেহেতু পুরম্নষদের শিকার ও আহরণ অভিযানে তাদের অংশগ্রহণ সম্ভব হয় নি। তারা ক্যাম্পে অবস্থান করেছে। শিকার ও আহরণ অভিযানের শেষে পুরুষেরা অস্থায়ী/আধাস্থায়ী ক্যাম্পে ফিরে আসার পর গোত্রের সবাই মিলে ভোজনশেষে উচ্ছিষ্ট ক্যাম্পের পাশেই ফেলে দিত। শস্য ও ফলের বীজ হতে ঋতুর শেষে পুনরায় গাছ হত। সেই গাছের ভিতর হতে দু চারটি চারা সবল ও সতেজ হত এবং শস্য বা ফলের ফলন বৃদ্ধি হত। অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান নারীরা ঐসব চারাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতো এবং তাদের বীজ আহরণ ও সংরক্ষণ করতো এবং মাটিতে রোপন করতো। একই কাজের ভিতর দিয়ে নারীদের দ্বারা কৃষির দুটি কর্মের সংযোগ ঘটতো, যথা সাধারণ কৃষির প্রচলন এবং উদ্ভিদ প্রজননের দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ, যথা নির্বাচন এখান থেকেই প্রারম্ভিক কৃষির শুরু (Shaikh, 2000)।
৩. পরবর্তী ধাপসমূহ
৩.১ শস্য উৎপাদন
শিকার ও আহরণ ধাপের পরে ক্রমান্বয়ে মানব প্রজাতি প্রায় ১২-১৫ হাজার বছর আগে নদীর তীরে স্থায়ী বসতি গড়তে শুরু করে এবং পুরুষেরা বীজ বপন থেকে শস্য কর্তন পর্যন্ত কার্যাদি সম্পন্ন করতে থাকে আর নারীর উপর শস্যের প্রক্রিয়াজাত করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ইউফ্রেটিস ও নীলনদের তীরে প্রায় দশ হাজার বছর পূর্বে আধুনিক কৃষির প্রবর্তন হয়। নারী তখন থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকায় কৃষির সঙ্গেঁ নানাভাবে জড়িত। বাংলাদেশের পুরুষেরা শস্যের প্রক্রিয়াজাত যথা মাড়াই, ঝাড়াই, বাছাই, শুকানো, গুদামজাতকরণ এমনকি বীজ সংরক্ষণের কাজেও নারীর উপর অনেকটা নির্ভরশীল।
৩.২ পশু সম্পদ ও মৎস্য উৎপাদন
বাংলাদেশের নারীরা এখন গাভী পালন, ছাগল পালন, মুরগী পালন, ছোট পুকুর ও ডোবায় মৎস্য পালন করছেন। দরিদ্র ও ভূমিহীন মহিলাগণ এসব কাজে নিয়োজিত রয়েছেন এবং অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন (Alam, 2008)। দারিদ্র বিমোচনে এসব কার্যক্রম বিরাট ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে অনেক নারী সংসারের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য এবং কিছু বাড়তি আয়ের জন্য নানাধরণের সবজি চাষ করছেন।
৪. নারীর অব্যাহত অগ্রগতি
কৃষিতে নারীর অবদানের ধরণ সময়ের সাথে সাথে অনেক পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে সঠিক উপাত্ত না থাকলেও বেশ অনেক আগেই লিখিত হয়েছে যে, উন্নতিশীল দেশ সমূহে ভক্ষণকৃত খাদ্যের কমপক্ষ অর্ধেকই নারীদের দ্বারা উৎপাদিত হয়ে থাকে; আফ্রিকাতে এই পরিমাণ ৮০% (কবির, ১৯৯৬)।
শস্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কার্যক্রমের পাশাপাশি এদেশের নারীগণ, বিশেষ করে দরিদ্র এবং ভূমিহীন পরিবারের নারীগণ প্রায় দুই দশক হতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। গ্রামীন ব্যাংক, ব্র্যাক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ গ্রহণ পূর্বক বাড়ীর আঙ্গিঁনায় ফল ও সব্জীর উৎপাদন, পশুপাখি পালন, স্বল্প পরিসরে মৎস্য উৎপাদন এবং সমবায়ের মাধ্যমে অর্থের সঞ্চয় বাড়ানোর কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। (কুদ্দুস ও ভট্টাচার্য, ১৯৯৬)। অতি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, সেই ১৯৯৬ সালেই ৫,০০,০০০ ঋণ গ্রহিতার মধ্যে ৮৭ শতাংশই ছিলেন নারী (রহমান, ১৯৯৬)। নারীরা ঋণ গ্রহণ করেন এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্য বা প্রথা নয় কিন্তু গ্রামীন ব্যাংকের প্রচেষ্টায় ও সমর্থনে এদেশের নারীগণ এ প্রথা ভেঙ্গেঁছেন (ইউনুস ও জোলিস, ২০০০)। পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর এই বিবর্তন অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের জনক বাংলাদেশ পলস্নী উন্নয়ন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ডঃ আখতার হামিদ খান বলেছিলেন, ‘‘আমাদের গাঁয়ের মেয়েরা জানে না যে, দুনিয়ায় কি হচ্ছে। ওরা পুকুরের ব্যাঙের মত ছিল। যা অসম্ভব বলে মনে হত, তাই আমরা কুমিলস্নায় সম্ভব করতে চেষ্টা করেছি। এখন আমরা দেখছি মেয়েরা নিজেরাই তাদের জীবনে পরিবর্তন চায়, এটা দেখে আমি খুব আনন্দ অনুভব করছি’’ (খান, ২০০১)। সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশের নারীদের এই উত্থান সত্যিই বিস্ময়কর।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমীর সভাপতি, সাইন্টিষ্ট এমিরিটাস-বাংলাদেশ ও কৃষি গবেষণায় জাতীয় পুরষ্কারে ভূষিত ডঃ কাজী এম. বদরুদ্দোজার উৎসাহে এবং উক্ত একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক ডঃ গুল হোসেনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঝিনাইদহ জেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের নারীগণ উন্নত প্রজাতির কেঁচোর মাধ্যমে ভার্মিকম্পোষ্ট নামের জৈবসার প্রস্ত্তত এবং বিক্রি দ্বারা অনেকগুলি গ্রামে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন এবং মাটির উর্বরাশক্তি বহুলাংশে বৃদ্ধির করেছেন। এই জৈবসার ব্যবহারের ফলে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ ছাড়াই শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে (হোসেন, ২০১১)। উলেস্নখ্য যে, ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরী প্রযুক্তিটি বেশ পুরাতন হলেও কয়েকটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ব্যতীত কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান এটির প্রসারে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করেনি। সারাদেশে এই নারীদের দ্বারা প্রদর্শিত পন্থায় ভার্মিকম্পোষ্ট তৈরী ও বাজরজাতকরণের পদ্ধতি প্রসার করাতে পারলে একদিন দেশের প্রতিটি কৃষকের বাড়ীতে এই সার তৈরী হবে এবং ফলে দেশ প্রতি বৎসর চার হাজার কোটি টাকার রাসায়নিক সার আমদানী বন্ধ করতে সক্ষম হবে (হোসেন, ২০১১)। এই নারীগণ দেশের মানুষের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা পাবার অধিকারী।
৫. উপসংহার
উপরোক্ত তথ্য ও উপাত্ত থেকে কৃষিতে এবং কৃষি সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এদেশের নারীদের অবদানের শুধু একটি খন্ডেত চিত্র পাওয়া যায়। আসলে তাঁরা খাদ্যের যোগান দিতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদানের অধিকারী, যার পরিমাপ শুধু সুষ্ঠু গবেষণার মাধ্যমে বের করা যেতে পারে। জয়তু নারীগণ !!
—-
লেখকঃ উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জৈবপ্রযুক্তি বিভাগ,
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম