Site icon

কৃষিতে আবশ্যক বায়োটেকনোলজির ব্যবহার ও প্রভাব

Bio technology
কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদঃ
বায়োটেকনোলজি বা জৈব প্রযুক্তি কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরনে বায়োটেকনোলজির বিকল্প নেই। ফসলের ফলন বৃদ্ধি, কাঙ্খিত জাত উদ্ভাবন, পোকামাকড় রোগবালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, লবনাক্ততা সহ্য ক্ষমতার জাত, বন্যা-খরা-শৈত্য প্রবাহ সহ্য ক্ষমতা জাত উদ্ভাবন, বড় আকৃতির ফলফুল, সবজি-মাছ-পশু পাখি উৎপাদন, অল্প সময়ে লাখ লাখ চারা উৎপাদন, চাহিদামত জাত উদ্ভাবনসহ কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজির ভূমিকা অপরিসীম। বিজ্ঞানীদের ধারনা- বায়োটেক ফসলই একমাত্র বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করতে পারে। ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের দারিদ্রের হার অর্ধেক কমিয়ে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। বায়োটেকশস্য নিয়ে বির্তকেরও সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজির প্রয়োগ হচ্ছে।
বায়োটেক ফসলের বিস্তার
বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে বায়োটেক’র (জিনের পরিবর্তিত শস্য উৎপাদন প্রযুক্তি) একদশক পূর্ণ হয়েছে ২০০৫ সালে। ১৯৯৬-২০০৫ সালে বিশ্বে বায়োটেক ফসলের চাষ ৫০ গুণ বেড়েছে এবং ৬টি দেশ থেকে ২১ টি দেশে ৯০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ৮.৫ মিলিয়ন কৃষক চাষ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের ৫০ ভাগ বায়োটেক ফসল চাষ হয়। ১৪ টি দেশ প্রত্যেকে ৫০ হাজার হেক্টর বা বেশি জমিতে বায়োটেক ফসল চাষ করছে। দেশগুলো হলো – আমেরিকা, চীন, আর্জেন্টিনা, কানাডা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ভারত, দক্ষিন আফ্রিকা, উরুগুয়ে, অষ্ট্রেলিয়া, রোমানিয়া, মেক্সিকো, স্পেন ও ফিলিপাইন। এসব দেশের বায়োটেক শস্যের প্রতি দ্রুত আর্কষন দেখে মনে হয়, বাণিজ্যিক এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র উভয় প্রকার ভোক্তা, কৃষক এবং উৎপাদনক্ষমতা, পরিবেশ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, এবং সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বায়োটেক ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গম, সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, তেলবীজ ফসল, শাক-সবজি, ফল ইত্যাদি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং হাইব্রিডাইজেশন পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের বিরুদ্ধে অনেকেই সোচ্চার। মাঝে মাঝেই এর বিরুদ্ধে বির্তক আন্দোলন ও প্রতিবাদের খবর পাওয়া যায়। বায়োটেকে দশক পূর্তিতে প্রায় একশ’ দেশের বিজ্ঞানী কৃষিবিদ, কৃষক, খামারের মালিকরা ফিলিপাইনে একত্র হয়ে এর প্রতিবাদ জানায়। তাদের কথা-জেনেটিক ও হাইব্রিড খাদ্য পরিবেশ সম্মত না, মাটির উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করবে। স্বাস্থ্যহানিকর, এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর। এই প্রযুক্তি কৃষকের বীজ শিল্পকে ধ্বংস করবে।

গুরুত্ব ঃ
১) অল্প সময়ে উন্নত জাত উদ্ভাবন করা যায়। ২) কাঙ্খিত জাতের ফসল উদ্ভাবন করা যায়। ৩) অল্প সময়ে প্রজাতির মধ্যে বিভিন্নতা আনা যায়। ৪) বড় বড় সবজি ও ফলের জাত উদ্ভাবন করা যায়। ৫) রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা যায়। ৬) লবনাক্ততা , খরা, বন্যাসহনশীলতা জাত উদ্ভাবন করা যায়। ৭) যেকোন ফসল বছরের যে কোন সময়ে চাষ করা যায় এমন জাত উদ্ভাবন করা যায়। ৮) অল্প সময়ে অল্প জায়গায় লাখ লাখ চারা উৎপাদন করা যায়। ৯) যে সব ফসল, ফল, ফুল, সবজির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায় না সেসব গাছের চারা উৎপাদন করা যায়। ১০) বছরের যেকোন সময় চারা উৎপাদন করা যায়, মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ১১) বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদের জাত সংরক্ষন করা যায়। ১২) উদ্ভিদ প্রজননের জন্য হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করা যায়, ১৩) পশুপাখির টিকা আবিষ্কার করা যায়। ১৪) পশুপাখির রোগের এন্টিবায়োটিক ঔষধ তৈরি করা যায়। ১৫) নাইট্রোজেন সংবন্ধন ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা যায়। যা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহন করে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমান বাড়িয়ে মাটিকে উর্বর করে।

সফলতা
অল্প কয়েক বছর বায়োটেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করে কৃষিতে বেশ সফলতা এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো – টিস্যু কালচার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, টিকা, এন্টিবায়োটিক ইত্যাদি। এগুলোর প্রায়গিক দিক এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

টিস্যু কালচারঃ এ প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোন উদ্ভিদ থেকে একটু টিস্যু নিয়ে দ্রুত এবং স্বল্প পরিসরে অনেক চারা উৎপাদন করা যায়। বর্তমানে ফসল, উদ্ভিদ, ফুল, ফল ও কাষ্ঠল উদ্ভিদের চারা উৎপাদন করা যায়। বর্তমানে ফসল, উদ্ভিদ ফুল, ফল ও কাষ্ঠল উদ্ভিদের চারা উৎপাদনে ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশেও অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে আলু, কলা, অর্কিড, ফুলসহ বিভিন্ন উদ্ভিদের চারা উৎপাদন করছে। যেমন ১) মাইক্রো প্রপাগেশন পদ্ধতিতে একটিমাত্র উদ্ভিদাংশ থেকে ছয় মাসের মধ্যে ১০ লাখ চারা উৎপাদন করা যায়। ২) উদ্ভিদ প্রজননের ক্ষেত্রে জেনেটিক পরিবর্তনের জন্য ক্যালাস কালচার দ্বারা চারা উৎপাদন করা যায়। ৩) আন্ত প্রজাতি সংকরের ক্ষেত্রে ভ্রুণ পূর্নতা লাভ না করলে সংকর উদ্ভিদ পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে সংকরায়নের পর ভ্রুণ কালচার করা হয়। ফলে ভ্রুণ আর নষ্ট হয় না। পরবর্তীতে এ ভ্রুণ বিকাশ লাভ করে পূর্ণাঙ্গ সংকর উদ্ভিদ উৎপাদন করে। এভাবে উৎপাদিত সংকর উদ্ভিদের সাহায্যে উন্নত জাত উদ্ভাবন হচ্ছে। ৪) মেরিষ্টেম কালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস রোগমুক্ত চারা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। ৫) যেসব উদ্ভিদের বীজ উৎপাদন সম্ভব না (যেমন-কলা) সেসব উদ্ভিদের ক্ষেত্রে টিস্যু কালচার করে চারা উৎপাদন করা যায়। ৬) পরাগরেণু এবং পরাগধানী কালচারের মাধ্যমে হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করে কম সময়ে হোমোজাইগাস লাইনের দ্বারা ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন সম্ভব। যেমন- ধানের পরাগধানী কালচার করে উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ৭) প্রোটোপ্লাস্ট কালচার প্রযুক্তির সাহায্যে দুটি ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের দেহ কোষের মধ্যে সংকরায়ন সম্ভব। যে সমস্ত উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে পর-পরাগায়ন দ্বারা সংকরায়ন সম্ভব হয় না সেসব ক্ষেত্রে এই সংকরায়নে বাধা দুর করার জন্য প্রোটোপ্লাস্ট ফিউশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ৮) দুটি ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যসমুহ একত্রে আনার জন্য সংকরায়ন করা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না সংকর বীজ পরিণত না হওয়ার কারণে। এই সংকর বীজের ভ্রুণ পূর্নাঙ্গ হয় না। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে অপূর্ণ সংকর ভ্রুণের বৃদ্ধি করিয়ে পূর্ণাঙ্গ সংকর উদ্ভিদ উৎপাদন করা সম্ভব। ৯) অর্কিড, কলা, বিভিন্ন ফুল ও কাষ্ঠল বৃক্ষের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। ১০) ডাল জাতীয় ফসল ও বাদামের টিস্যু কালচার করা হয়েছে। ১১) আলুর রোগমুক্ত বীজ উৎপাদন করা হয়েছে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জিন ট্রান্সফরমেশন করে কাঙ্খিত ফসলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। এই প্রযুক্তি প্রায় সম্পুর্ণ টিস্যু কালচারের উপর নির্ভরশীল। টিস্যু কালচারের মধ্যে কাঙ্খিত জিন প্রবেশ করিয়ে দ্রুত কাঙ্খিত জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। যেমন ১) ভিটামিন ‘‘এ’’ এর অভাব পূরনের জন্য ভিটামিন ‘‘এ’’ সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। সুইডেনের একদল বিজ্ঞানী Japonica টাইপ ধানে ড্যাফডিল থেকে বিটা ক্যারটিন তৈরির চারটি জিন এবং অতিরিক্ত আয়রন তৈরির তিনটি জিন প্রতিস্থাপন করেন। ২) তুলার বোলওর্য়াম পোকার প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ব্যাকটেরিয়া থেকে একটি জিন নিয়ে। ৩) টমেটো কৃত্রিমভাবে পাকানোর জন্য ইথিলিন ব্যবহার করা হয়। যা খরচ বেশি এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এন্ডোজেনাস জিন প্রাকৃতিকভাবে টমেটো পাকাতে সাহায্য করে। ৪) খরা, লবণাক্ততা ও বন্যা সহ্যকারী জাত উদ্ভাবনের জন্য তিনটি জিন চিহ্নিত করে গম ও ভুট্টায় প্রবেশ করানোর পর সফলতা পাওয়া গেছে। ৫) ভেড়ার খাদ্যে সালফার বেশি থাকলে লোম উন্নত মানের হয়। সুর্যমুখীর সালফার এমিনো এসিড সৃষ্টিকারী জিন ব্যকটেরিয়ার প্লাজমিড DNA এর মাধ্যমে ক্লোভার ঘাসে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঐ ঘাস ভেড়া খেলেই সালফার খাওয়ানোর প্রয়োজন হয় না। ৬) জোনাকি পোকার আলো সৃষ্টিকারী জিন তামাক গাছে স্থানান্তর করায় অন্ধকারে তামাক গাছ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়। ৭) বায়বীয় নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ব্যাকটেরিয়া হতে নিফ জিন ব্যাটেরিয়াতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাকটেরিয়া বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে মাটিতে যোগ করবে। ফলে নাইট্রোজেন জাতীয় কোন সার জমিতে দিতে হবে না। ৮) পশু পাখির রোগ প্রতিরোধের জন্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দিয়ে টিকা তৈরি করা হয়েছে। যে রোগ যে জীবানু দ্বারা সংক্রমিত হয় সেই রোগের টিকা সেই জীবানু দিয়ে তৈরি হয়। ৯) ধানের কান্ড ছিদ্রকারী পোকা, পামরি পোকা ও বাদামী গাছ ফরিং প্রতিরোধের জন্য ব্যাসিলাস টক্সিন জিন ধানে স্থানান্তর করা হয়েছে। ১০) বাদামী গাছ ফড়িং প্রতিরোধী ধানের জাতে ব্যাসিলাস ব্যাক্টেরিয়ার জিন স্থানান্তর করা হয়েছে। ১১) ধানের টুংরো রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে কোট প্রোটিন ঢুকিয়ে। ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে DNAএ পরিবর্তনের মাধ্যমে। ধানের পাতা ঝলসানো রোগ প্রতিরোধের জন্য ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। ১২) মসুর ডালের ছত্রাক রোগ প্রতিরোধের জন্য চিটিন্যাজ ও গ্লুক্যান্যাজ এনজাইমের এর জন্য জিন প্রয়োজন। এই এনজাইম ছত্রাকের কোষ প্রাচীর নষ্ট করে মেরে ফেলে। ১৩) পাটের মাকড় ও ছত্রাক প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাক্টেরিয়া ব্যাসিলাস ব্যবহার করা হয়। ১৪) লবনাক্ত সহ্য ক্ষমতা ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে DNAমার্কারের মাধ্যমে ক্রসবিডিং করে। এখানে কিছু উদাহরন দেয়া হলো। এরকম সব ফসলের কাঙ্খিত জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। এ নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা হচ্ছে।

বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজির যেমন সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে তেমনি অনেক সমস্যা রয়েছে। প্রধান সমস্যা হলো – কাঙ্খিত জিন খুঁজে বের করা, জিন প্রবেশ করানো, পরীক্ষাগার, পরীক্ষাগারের যন্ত্রপাতির অভাব, দক্ষ লোকের অভাব, আর্থিক সংকট ইত্যাদি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের জন্য বায়োটেকনোলজি একটি টেকসই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির উন্নয়ন হলে কৃষির উন্নতি হবে। চারা উৎপাদন, রোগবালাই দমনসহ ফসল উৎপাদন খরচ কম হবে। ফলে কৃষক লাভবান হবে এবং ভোক্তারাও কম দামে খাদ্য খরচ হলেও প্রচুর চারা উৎপাদন করা যায় বলে ব্যবসায় ভালো লাভবান হওয়া যায়। ইতোমধ্যেই বাণিজ্যিকভাবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা বিক্রি করে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে বায়োটেকনোলজির প্রসার করতে হলে বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, সরকার, কৃষকসহ সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম 


 

Exit mobile version