নিতাই চন্দ্র রায়
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার
একটা সময় ছিল যখন দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষি কাজের সাথে জড়িত ছিল। দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়ণের কারণে বর্তমানে সে অবস্থা নেই। এখন দেশের মাত্র শতকরা ৪৮ ভাগ লোক কৃষি কাজের সাথে সরসরি জড়িত। বাকি ৫২ ভাগ লোক শিল্প ও সেবাখাতের সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমানে একজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরী ৩০০ টাকা। অন্যদিকে
একজন কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি বা রংমিস্ত্রি দৈনিক মজুরী পান ৫০০ টাকা। একজন রিক্সা-ভ্যানচালকও দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা উপার্জন করেন। তাহলে কৃষির মতো এত পরিশ্রমের কাজ কেন করতে যাবে মানুষ?এ দেশের শিক্ষার হার বাড়ছে।কারিগরি শিক্ষায়ও শিক্ষিত হচ্ছে অনেক যুবক ।কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকেরা কৃষির মতো কষ্টের কাজ পছন্দ করে না। তারা কৃষিযন্ত্রপাতি, যানবাহন, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, মোবাইল ফোন মেরামতের মতো অল্প পরিশ্রমের কাজকেই বেশি পছন্দ করে।আজকাল স্বল্প শিক্ষিত লোকজনও কৃষি কাজকে সম্মানের চোখে দেখে না। তারা এটাকে অশিক্ষিত গরীব মানুষের পেশা হিসেবে মনে করে। উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ফসলের মাঠে কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁরা ধান, রোপণ, ধান কাটা, ধান মাড়াই, আখ রোপণ, আগাছা দমন, আখ কাটা, আখ বাঁধা, ভুট্টা রোপণ, আলু রোপণ, আলু তোলা, ভুট্টা মাড়াইসহ এমন কোনো কৃষিকাজ নেই, যা পারেন না। বিভিন্ন রকম শাক-সবজি রোপণ , পরিচর্যা ও উত্তোলন কাজেও এসব নারী শ্রমিকদের দক্ষতার তুলনা হয় না। অনেকে পাট থেকে আঁশ ছড়ানো, আখ ও খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজও করেন। চালের চাতালেও কাজ করেন অনেক নারী শ্রমিক। উত্তরাঞ্চলে নারী শ্রমিকেরা কৃষি কাজ না করলে সেখানে শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষিকাজ বিঘিœত হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অনেক সময় ধান রোপণ বা ধান কাটার মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। তখন শ্রমিকের মজুরি অনেক বেড়ে য়ায়। ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। অনেক সময় কৃষি শ্রমিকের অভাবে সময় মতো ফসল রোপণ, পরিচর্যা করা যায় না। ফলে প্রত্যাশিত ফলন থেকে কৃষক বঞ্চিত হন। আজ থেকে ২০ বছর আগেও একজন কৃষি শ্রমিক সকাল আটটায় এসে কাজ শুরু করতেন এবং মাগরিবের নামাজের আগ পর্যন্ত কাজ করতেন। এখন তারা সকাল নয়টায়এসে কাজ শুরু করেন এবং জহুরের নামাজের আযান দেওয়ার সাথে সাথেই কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যান। এতে দেখা যায় একজন কৃষি শ্রমিক দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন না। শ্রমিক সংকটের কারণে বেশি জমির মালিকেরা এখন আর কোনো কৃষি কাজই করেন না। তারা বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে জমি লিজ দিয়ে সন্তানসন্ততি নিয়ে শহরে বসবাস করেন।যারা নিজেরা জমিতে কাজ করতে পারেন, বর্তমানে তারাই শুধু কৃষি কাজের সাথে জড়িত । কারণ শ্রমিক দিয়ে সব কাজ করে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে আসল টাকাও ঘরে তোলা যায় না। এ জন্য কৃষি কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে। এসব কারণে অনেকে কৃষি কাজ ছেড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গো-পালনের মতো পেশায় ঝুঁকছেন।এ অবস্থায় কৃষিকে টিকিয়ে আখতে হলে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।্ এ উদ্দেশকে সামনে রেখেই সম্প্রতি (১০.২.১৮) রাজধানী ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হলো তিন দিনব্যাপী ‘ জাতীয় কৃষি যন্ত্রপাতি মেলা-২০১৮’।এবারের মেলার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারে অর্থ-শ্রম-সময় বাঁচবে’। মেলায় সরকারি ও বেসরকারি মিলে ২১ টি প্রতিষ্ঠান অংশ গ্রহণ করে। ওই কৃষি যন্ত্রপাতি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার ও পল্লীউন্নয়ন মন্ত্রী খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন,‘ নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে কৃষি শ্রমিকেরা দিন দিন অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। যার ফলে কৃষি কাজে শ্রমিক সংংকট দেখা দিচ্ছে। কৃষি উন্নয়নের ধারাকে ধরে রাখতে হলে বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় ও ব্যবহারে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।’ আর কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মতে- আমাদের জমি ছোট। অনেক সময় বড়যন্ত্র ব্যবহার করা যায়না। তাই কৃষিকে লাভজনক করতে কৃষকের কথা মাথায় রেখে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ছোট ও কার্যকর যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের ধানের কিছু জাত আছে, যেগুলে নুইয়ে পড়ে। এ ধরনের ধান কাটার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি বা উদ্ভাবনের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জাতীয় কৃষি যন্ত্রপাতি মেলার বিশেষ কয়েকটি আকর্ষণের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ‘সবজি ধৈৗত করণ যন্ত্র ’ টি ছিল অন্যতম। যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেন, ওই প্রতিষ্ঠানে ঊদ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর নূরুল হক। তার উদ্ভাবিত এ যন্ত্রদিয়ে গাজার, মূলা ও কচুর মতো মাটির নিচের সবজিগুলো ধুয়ে পরিস্কার করা যায় সহজে। ঈশ্বরদী, পাবনা, ঢাকা ও সাভারে বেশি গাজর উৎপন্ন হয়। কৃষক উৎপাদিত গাজর হাত ও পায়ের সাহায্যে ঘষে পরিস্কার ও চকচকে করেন। এতে কৃষকের খুব কষ্ট হয় । বেশি সময় ও অর্থের অপচয় হয়। অনেক সময় গাজর পরিস্কারকালে কৃষকের হাতে-পায়ে ফুসকা পড়ে । প্রচলিত পদ্ধতিতে হাত-পায়ে ঘষে গাজার পরিস্কারে কৃষকের প্রতি কেজিতে যেখানে খরচ হয় ৮০ পয়সা , সেখানে এই যন্ত্রদিয়ে পরিস্কারে প্রতিকেজিতে খরচ হয় মাত্র ২৫ পয়সা। এতে কৃষকের প্রতি কেজিতে ৫৫ পয়সা বেঁচে যায় অর্থাৎ ৬৬ ভাগ অর্থ সাশ্রয় হয়। ্এ ছাড়া স্বল্প সময়ে জমি তৈরি করে ফসল চাষের জন্য হাই স্পিড রোটারি টিলার, বীজবপন যন্ত্র, নালা তৈরির জন্য বারি ব্লেড প্লান্টার, বারি গুটি ইউরিয়া প্রয়োগযন্ত্র, বারি শুকনা জমি নিড়ানি যন্ত্র, বারি শস্য কর্তন যন্ত্র, বারি শস্য মাড়াই যন্ত্র, হস্ত চালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, আলু উত্তোলন যন্ত্র, শস্য ঝাড়াই যন্ত্র, আম পাড়া যন্ত্র, ফল শোধন যন্ত্র, হাইব্রিড ডায়ার, কমপোষ্ট সেপারেটরসহ মোট ৩৯টি নিজস্ব উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট । বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত শস্য মাড়াইয়ের জন্য ‘ ওপেন ড্রাম থ্রেসার’ যন্ত্রটিও দর্শকদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে।এ যন্ত্রটি শস্যের মাড়াইকালীন অপচয়, কমানো, ব্যয় ও শ্রম কমানো, মাড়াই দক্ষতা ও ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশে উদ্ভাবন ও প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাটের ফলন বৃদ্ধির জন্য এবং কৃষকের কল্যাণে ৯টি কৃষি যন্ত্র উদ্ভাবন করে। যন্ত্রগুলি এখনও প্রান্তিক কৃষকদের নিকট পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে অচিরেই পাট চাষিদের হাতে-নাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে যন্ত্রগুলি তাঁদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশ সুগার ক্রপ রিসার্স ইনস্টিটিউট মেলায় ৫টি কৃষি যন্ত্র প্রদর্শন করে। যন্ত্রগুলো হলো- কম চাষে আখের নালা তৈরির যন্ত্র, আগাছা নিড়ানি যন্ত্র, আখের চোখ তোলার যন্ত্র, আখের বীজখ- তৈরির যন্ত্র ও বর্জ্যপানি পরিশোধন করে সেচ কাজে ব্যবহারের যন্ত্র। যন্ত্রগুলি আখ চাষিদের মধ্যে এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহার না হলেও বাংলাদেশ চিনিও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বাণিজ্যিক খামারগুলিতে এসব যন্ত্রপাতির কয়েকটি ব্যবহার হচ্ছে। মেলায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ২৬ প্রকার কৃষিযন্ত্র প্রদর্শন করে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মেলায় বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরী কৃষি যন্ত্রপাতি মেলায় প্রদর্শন করে। এসব প্রতিষ্ঠানে মধ্যে রয়েছে- সিমিট বাংলাদেশ,্ আইডিই বাংলাদেশ, চিটাগাং বিল্ডার্স অ্যান্ড মেশিনারি লিমিটেড, আলিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং, এসিআই লিঃ ও হক করপোরেশন।এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চিটাগাং বিল্ডার্স অ্যান্ড মেশিনারি লিমিটেড মেলায় ৩০টির ও অধিক কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদর্শন করে। প্রতিষ্ঠানটির তৈরীকৃত প্রায় সব কৃষি যন্ত্রগুলোই কৃষকের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এবারের মেলায় ওই প্রতিষ্ঠানটির নতুন সংযোজন হলো কম্বাইন হার্ভেস্টার। অপরদিকে হক করপোরেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি দেশের বাজারেই বিক্রি করছে না, বিদেশেও রপ্তানি করছে। এপর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বিজ্ঞানিদের উদ্ভাবিত প্রায় ২০০টির অধিক কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি করে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। প্রতিষ্ঠাটি সাধারণত ভারত, কেনিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, মিয়ানমার ও তাঞ্জিনিয়াতে সুনামের সাথে কৃষি যন্ত্রপাতি রপ্তানি করছে।
দেশের বিভিন্ন কৃষিগবেষণা প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন হচ্ছে, কৃষকরে মাঠে সে পরিমাণে যন্ত্রপাতিগুলির ব্যবহার দৃশ্যমান হচ্ছেনা।এর কারণ হতে পারে- যন্ত্রগুলির ব্যবহার কৃষক জানেন না অথবা যন্ত্রগুলি কৃষকের কাছে সহজ লভ্য নয়। মাঠ পর্যায়ে উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতিগুলির ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষিকে লাভজনক করতে হলে প্রত্যেক উপজেলা ও ইউনিয়নে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর হাতে-নাতে চাষি প্রশিক্ষণ ও পদ্ধতি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। সুলভমূল্যে ও সহজে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলি বাংলাদেশে মাটি , আবহাওয়া, ফসল এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য উপযোগী হতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলির দাম কৃষকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকতে হবে এবং জ্বালানী সাশ্রয়ী হতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলো যাতে কৃষক সহজে চালাতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এসব ব্যাপারে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান , কৃষিম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় আরো জোরদার করতে হবে। আর কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সরকার কৃষকদের যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।এছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে কৃষিকে কোনো অবস্থাতেই লাভজনক, আকর্ষণীয় ও টেকসই করা যাবে না।
লেখকঃ
সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
৪৫/১ হিন্দু পল্লী , ত্রিশাল