Site icon

ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচের চাষ

মিষ্টি মরিচের চাষ

মো. রফি উদ্দিন: Red capsicumমিষ্টি মরিচ (Capsicum annuum) এদেশে একটি সম্ভাবনাময় মূল্যবান সবজি। বড় বড় শহরের আশেপাশে এর চাষ হয় যা পাঁচতারা হটেলে বিক্রি হয়। মিষ্টি মরিচের রপ্তানী সম্ভাবনাও প্রচুর। বিশ্বে টমেটোর পরে দ্বিতীয় গুরুত্ব সবজি হচ্ছে মিষ্টি মরিচ

পুষ্টিমান
প্রতি ১০০ গ্রাম মিষ্টি মরিচে ১.২৯ মিলিগ্রাম আমিষ, ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৮৭০ আইহউ ভিটামিন – এ, ১৭৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন – সি, ০.০৬ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ০.০৩ মিলিগ্রাম রিভোফ্লেভিন এবং ০.৫৫ মিলিগ্রাম নায়াসিন রয়েছে।

জলবায়ু ও মাটি
মিষ্টি মরিচ চাষের জন্য ১৬-২৫সেঃ তাপমাত্রা ও শুষ্ক আবহাওয়া প্রয়োজন। রাতের তাপমাত্রা ১৬সেঃ এর উপরে গেলে ফুল ঝরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে এবং ফল ধারণ ব্যাহত হয়। সুনিষ্কাশিত দোঁআশ বা বেলেদোঁআশ মাটি মিষ্টি মরিচ চাষের জন্য উত্তম এবং মাটির অম্ল ক্ষারত্ব ৫.৫-৭.০ এর মধ্যে থাকা প্রয়োজন।

জাত
বাংলাদেশে আবাদকৃত জাত গুলোর মধ্যে প্রধান হচেছ– California Wonder, Tender Bell (F1) Ges Yellow Wonder ইত্যাদি । এ গুলোর বীজ আমদানী করতে হয়। তবে এদেশেও California Wonder, এর বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।

জীবন কাল
জাত ও মৌসুম ভেদে মিষ্টি মরিচের জীবনকাল ১২০ – ১৪০ দিন।

বীজ বপনের সময়
অক্টোবর – নভেম্বর মাস।

বীজের মাত্রা
এক গ্রামে প্রায় ১৬০ টি বীজ থাকে। প্রতি হেক্টর জমিতে মিষ্টি মরিচ চাষের জন্য ২৩০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন ও চারার সংখ্যা ৩০ হাজার। প্রতি শতাংশ জমির জন্য বীজের প্রয়োজন ১ গ্রাম ও চারার সংখ্যা ১২০ টি।

চারা উৎপাদন
 প্রথমে বীজগুলো ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
 বীজ তলায় মাটি মিহি করে ১০২ সেমি দূরে বীজ বপন করে হালকা ভাবে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
 বীজতলায় প্রয়োজনানুসারে ঝাঝরি দিয়ে হালকা ভাবে সেচ দিতে হবে।
 পটিং মিডিয়াতে ৩ঃ১ঃ১ অনুপাতে যথাক্রমে মাটি, কম্পোষ্ট এবং বালি মিশাতে হবে।
 বীজ গজাতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। বীজ বপনের ৭-১০দিন পর চারা ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট হলে ৯১২ সেমি আকারের পলি ব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে।
 পরে পলিব্যাগ ছায়াযুক্ত স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।

জমি তৈরি ও চারা রোপণ
 ভাল ভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে যাতে জমিতে বড় বড় ঢিলা এবং আগাছা না থাকে।
 মিষ্টি মরিচ চাষে প্রতি শতাংশে গোবর ৪০ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ১.৪ কেজি, এমপি ১ কেজি , জিপসাম ০.৪৫ কেজি, এবং জিংক অক্সাইড ০.০২ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
 জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকী অর্ধেক গোবর , টিএসপি, জিংক অক্সাইড, জিপসাম এবং ১/৩ ভাগ ইউরিয়া এবং এমপি পরবর্তীতে দুই ভাগ করে চারা লাগানোর ২৫ এবং ৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
 সাধারণত ৩০ দিন বয়সের চারা ৪৫ী৪৫ সেমি দূরত্বে রোপণ করা হয়।
 মাঠে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করতে হবে। প্রতিটি বেড প্রস্থে ৭৫ সেমি এবং লম্বায় দুটি সারিতে ২০ টি চারা সংকুলানের জন্য ৯ মিটার হতে হবে। দুটি সারির মাঝখানে ৩০ সেমি ড্রেন করতে হবে।
 চারা রোপণের পর গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে।
 চারা বিকেল বেলা রোপন করা উওম । চারা রোপনের পর পরই গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে।
 নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা অনেক কমে যায় এ সময় গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । কাজেই গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পলিথিন ছাউনিতে গাছ লাগালে রাতে ভিতরের তাপমাত্রা বাহির অপেক্ষা বেশী থাকে এবং গাছের দৈহিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়।
সেচ প্রয়োগ
 মিষ্টি মরিচ খরা ও জলাবদ্ধতা কোনটিই সহ্য করতে পারে না।
 জমিতে প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে এবং অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

খুঁটি
ফল ধরা অবস্থায় প্রয়োজনে খুঁটি দিতে হবে যাতে গাছ ফলের ভারে হেলে না পড়ে।

আগাছা দমন
নিড়ানী দিয়ে প্রয়োজনীয় আগাছা দমন করতে হবে যাতে জমি আগাছা মুক্ত থাকে।

ফসল তোলা
 মিষ্টি মরিচের সাধারণত পরিপক্ক সবুজ অবস্থায় মাঠ থেকে উঠানো হয়। ফলের রং সবুজ থেকে লালচে হওয়ার পূর্বেই সংগ্রহ করতে হবে।
 ফল সংগ্রহের পর ঠান্ডা অথচ ছায়াযুক্ত স্থানে বাজার জাত করণের পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে।
 ফল সংগ্রহের সময় প্রতিটি ফলে সামান্য বোঁটা রেখে দিতে হবে।

ফলন
উত্তম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মিষ্টি মরিচ চাষ করলে জাত ভেদে শতাংশ প্রতি ৪০-৫০ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব (১০-১২ টন/হেক্টর)।

পোকা মাকড়

জাব পোকা
 প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক জাব পোকা দলবদ্ধ ভাবে গাছের পাতার রস চুষে খেয়ে থাকে। ফলে পাতা বিকৃত হয়ে যায়, বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও নীচের দিকে কোঁকড়ানো দেখা যায়।
 জাব পোকার শরীরের পিছন দিকে অবস্থিত দুটি নল দিযে মধুর মত এক প্রকার রস নি:সরণ করে। এই রস পাতা ও কান্ডে আটকে গেলে তাতে “সুটি মোল্ড” নামক এক প্রকার কালো রংয়ের ছত্রাক জন্মায়, এর ফলে গাছের সবুজ অংশ ঢেকে যায় এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বিঘিœত হয়।

দমন ব্যবস্থাপনা
 প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা যায়।
 নিম বীজের দ্রবন (১ কেজি পরিমাণ অর্ধভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) বা সাবান গুলা পানি (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ গুড়া সাবান মেশাতে হবে) স্প্রে করেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়।
 লেডীবার্ড বিটলের পূর্ণাঙ্গ পোকা ও কীড়া এবং সিরফিড্ ফ্লাই এর কীড়া জাব পোকা খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে দমন করে। সুতরাং উপরোক্ত বন্ধু পোকাসমূহ সংরক্ষণ করলে এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কম হয়।
 আক্রমণের মাত্রা বেশী হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে অথবা পিরিমর ৫০ ডিপি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। পিরিমর মৌমাছি পরাগায়নে সাহায্যকারী পোকাদের জন্য অনেকটা নিরাপদ।

থ্রিপস পোকা
 পূর্ণাঙ্গ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক থ্রিপস পাতা থেকে রস চুষে খায়।
 পাতার মধ্যশিরার নিকটবর্তী এলাকা বাদামী রং ধারণ করে ও শুকিয়ে যায়।
 নৌকার খোলের ন্যায় পাতা উপরের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা
 পাঁচ গ্রাম পরিমাণ গুড়া সাবান প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
 ক্ষেতে সাদা রঙের ৩০  ৩০ সেমি আকারের বোর্ডে পাতলা করে গ্রীজ বা আঠা লাগিয়ে কাঠির সাহায্যে ৩ মিটার দূরে দূরে আঠা ফাঁদ পেতে থ্রিপস পোকা আকৃষ্ট করে মারা যায়।
 এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি স্প্রে করা।
 আক্রমণের হার বেশী হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২মিলি পরিমাণ) স্প্রে করা।

লাল মাকড়
 লাল মাকড় পাতার নীচের পৃষ্ঠ-দেশে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিম পাড়ে যা খালি চোখে দেখা যায় না।
 লাল মাকড়ে খাওয়া পাতায় হলুদাভ ছোপ ছোপ দাগের সৃষ্টি হয়।
 যখন এই ধরণের আক্রমণ পাতার নীচের দিকে মাঝখানে বেশী হয় তখন প্রায় ক্ষেত্রেই পাতা কুকড়ীয়ে যেতে দেখা যায়।
 ব্যপক আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ পাতা হলুদ ও বাদামী রং ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত পাতা ঝরে পরে।

দমন ব্যবস্থাপনা
 নিমতেল ৫ মিলি + ৫ মিলি ট্রিকস্ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
 এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।
 আক্রমণের হার বেশী হলে উমাইট বা টলস্টার (প্রতি লিটার পানিতে ২মিলি পরিমাণ) স্প্রে করা।
রোগ বালাই

এ্যানথ্রাকনোজ
 পাতায় বসানো দাগহয়। ফলেও এ দাগ দেখা যায়। পাতা ঝরে পড়ে এবং ফল পচে যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা
 ব্যাভিস্টিন ২ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে গুলে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করা।

উইল্টিং
 গাছ আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে এবং মারা যায়।

দমন ব্যবস্থাপনা
 জমিতে প্লাবন সেচ না দেয়া এবং আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে।

Exit mobile version