ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল
=======================================
ডাল বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশে যে ডাল উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক চতুর্থাংশ মাত্র। উপরুন্তু প্রতিবছর দেশে ডাল উৎপাদন কমছে কিন্তু বাড়ছে ডালের চাহিদা। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণার বিজ্ঞানীগণের উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টার অংশ হিসাবে মসুরের উন্নত জাত “ বিনামসুর-১০” উদ্ভাবন করেছেন। জাতটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রধান গবেষক ড. সিগ্ধা রায়, এসএসও বলেন, এটি উচ্চ ফলনশীল, খরা সহিষ্ণু এবং স্বল্প মেয়াদী। বীজাবরণ ধুসর বর্ণের। বীজের আকার প্রচলিত জাত হতে বড় ও চ্যাপ্টা এবং ১০০০ বীজের ওজন ২৪-২৫ গ্রাম। বীজে প্রোটিনের পরিমাণ ৩০-৩২% এবং বীজে ডালের পরিমাণ ৮৯%। জীবনকাল ৯৫-১০০ দিন। ডাল সহজে সিদ্ধ হয় এবং খেতে সুস্বাদু। মরিচা ও গোড়া পচাঁ রোগ সহ্য ক্ষমতা সম্পন্ন এবং দেরীতে বপন করলেও ভাল ফলন দেয়। যথোপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টর প্রতি খরা অবস্থায় ১.৫ টন এবং স্বাভাবিক অবস্থায় গড়ে ২.০ টন এবং সর্বোচ্চ ২.৫ টন ফলন পাওয়া যায়।
চাষ উপযোগী জমিঃ দো-আঁশ হতে এঁটেল দো-আঁশ মাটি উপযোগী। তবে বৃহত্তর ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোহর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ জেলায় যেখানে পানির অভাব রয়েছে সেখানে ভাল জন্মে।
জমি তৈরী ও সার গ্রয়োগঃ তিন-চারটি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে জমি তৈরী করতে হয়। জমি উত্তম ভাবে ঝুর ঝুরে করে নেয়া ভাল। একর প্রতি ১২-১৪ কেজি ইউরিয়া, ৩০-৩২ কেজি টিএসপি, ১২-১৪ কেজি এমপি সার শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়ার পরিবর্তে জীবানু সার ব্যবহার করা যায়।। জিংকের অভাব থাকলে একর প্রতি এক কেজি জিংক সালফেট ছিটাতে হবে।
বপনের সময়ঃ কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে অগ্রহায়নের প্রথম (অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্ববের দ্বিতীয় সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজ ধপনের উপযুক্ত সময়। বিলম্বে বীজ বপন করলে ফলন হ্রাস পায়। বিনামসুর-৮ জাতটি অগ্রহায়ন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যায় এবং সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়।
বীজ হার ও বপন পদ্ধতিঃ তিন থেকে চারটি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে জমি তৈরী করতে হয়। জমি উত্তমভাবে ঝুরঝরে করে নেওয়া ভাল। ছিটিয়ে বপন করলে একর প্রতি ১৪-১৬ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে সারিতে বপন করলে একর প্রতি দুই কেজি বীজ কম লাগে। সাধারনত: চাষ করা জমিতে বীজ ছিটিয়ে বোনার পর মই দিয়ে বীজ গুলো ঢেকে দিতে হবে। সারিতে বপন করলে পরিচর্যা সহজ হয়। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সে.মি (১ ফুট) এবং গাছ থেকে গাছের দূরন্ত ৫-৬ সেন্টিমিটার রাখতে হবে।
পরিচর্যাঃ চারা গজানো পর ২৫-৩৫ দিন পর নিড়ানীর দিতে হবে এবং নিড়ানীর সাথে বেশী ঘন গাছ পাতলা করে দিতে হবে। অতি বৃষ্ঠির ফলে জতিতে যাতে পানি জমে না থাকে সেজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। মসুরে সাধারণত: সেচের প্রয়োজন পড়ে না। তবে অতি খরা হলে একটি হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে।
রোগ ও পোকা মাকড় দমনঃ এ জাতটি গোড়া পচাঁ ও মরিচা রোগ সহ্য ক্ষমতা সম্পন্ন। গোড়া পচাঁ রোগ দমনের জন্য ভিটাভেক্স-২০০ প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০০ গ্রাম মিশিয়ে বীজ শোধন করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া এ জাতে পোকার আক্রমন তুলনামূলক খুবই কম। তবে পোকার আক্রমন দেখা দিলে কীটনাশক রিপকর্ড ১০ ইসি মাত্রা অনুয়ারী স্প্রেকরলে সুফল পাওয়া যায়। স্টেমফাইলামজনিত ঝলসানো রোগ দেখা দেওয়া মাত্র রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি নামক ছত্রাক নাশক (০.২%) ১০ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। মরিচা রোগ দমনের জন্য টিল্ট-২৫০ ইসি (০.০৪%) ১২-১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। জাবপোকার আক্রমণ দেখা দিলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি বা বাজারে প্রচলিত কীটনাশক মাত্রা অনুযায়ী স্প্রে করতে হবে।
ফলন সংগ্রহ, মাড়াই ও সংবক্ষল ঃ ফল পেকে গেলে গাছগুলো গোড়া থেকে তুলে অথবা কাঁচি দিয়ে কেটে দিতে হবে। গোড়া থেকে কেটে নিলে জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। গাছগুলো ভালভাবে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা গরু দিয়ে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। এই বীজ ডাল অথবা বীজ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। তবে বীজ হিসাবে ব্যবহার করতে হলে আরও ভালভাবে রোদে শুকিয়ে আদ্রতার পরিমাণ আনুমানিক ৯-১০% এর মত রাখলে ভাল হবে। তারপর বীজ বায়ুরোধী পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিক ড্রাম, টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসী অথবা বিস্কুটের টিনে সংরক্ষণ করতে হবে।
—————————————————————————
লেখকঃ প্রিন্সিপ্যাল সায়েন্টিফিক অফিসার, বিনা, ময়মনসিংহ।