Site icon

খামারে মুক্তা চাষ: দেশীয় ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদনে আশার আলো

Pearl Culture Pic-1মো. আব্দুর রহমান: মুক্তা সৌখিনতা ও আভিজাত্যের প্রতীক। মুক্তা অলংকারে শোভিত অতি মূল্যবান রতœ। মুক্তার প্রধান ব্যবহার অলংকার হলেও কিছু কিছু জটিল রোগের চিকিৎসায় এবং ঔষধ তৈরিতে মুক্তা ও মুক্তাচূর্ণ ব্যবহার হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, মুক্তা ধারণে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। এছাড়া মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের খোলস নানা ধরণের অলংকার ও সৌখিন দ্রব্যাদি তৈরি এবং ক্যালসিয়ামের একটি প্রধান উৎস-যা হাঁস-মুরগী, মাছ ও চিংড়ির খাদ্যের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের মাংস মাছ ও চিংড়ির উপাদেয় খাদ্য হিসাবেও ব্যবহ্নত হয়। অনেক দেশে ঝিনুকের মাংস মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহ্নত হয়। বাংলাদেশের মিঠাপানির জলাশয় মুক্তা বহনকারী ঝিনুকে পরিপূর্ণ। জলবায়ুও মুক্তা চাষের উপযোগী। প্রায় ১০ মাস উষ্ণ আবহাওয়া থাকায় ঝিনুকের বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের পরিবেশও অনুকূল এখানে। চীন, জাপান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্যান্য দেশে প্রণোদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদন এবং চাষ করা হয়ে থাকে। চীন ও জাপান দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিক গবেষণায় মুক্তা চাষে পেয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বাংলাদেশও প্রণোদিত উপায়ে মুক্তা উৎপাদনে সফল হয়েছে। এই সাফল্যকে বাণিজ্যিকভাবে বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে দেশের প্রথম মুক্তা গবেষণাগার। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) স্থাপিত এ গবেষণাগার মুক্তা উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঝিনুক ও শামুক জাতীয় অমেরুদন্ডী জলজপ্রাণী থেকে তৈরি হয় মুক্তা। মূল্য নির্ধারিত হয় আকার, আকৃতি ও রঙ দেখে। ইতিমধ্যে দেশীয় ঝিনুকে মুক্তা চাষের পদ্ধতি উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন বাংলাদেশের গবেষকরা। তারা বলছেন, উদ্ভাবিত এ মুক্তা ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। হৃদরোগ ও চোখের অসুখে এটা কাজে লাগে। এর আকার ৫ মিলিমিটার। তবে দেশীয় ঝিনুক আকারে ছোট হওয়ায় এখনও বাজার উপযোগী আকারের (১০ মিলিমিটার) মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। তবে গবেষণা অব্যাহত রাখলে বাংলাদেশের অনুকূল পরিবেশে বিপুল পরিমাণ মুক্তা উৎপাদন সম্ভব। ঝিনুক থেকে মুক্তা তৈরির কলা-কৌশল আয়ত্ত, ঝিনুকের প্রজননকাল শনাক্তে হিস্টোলজিক্যাল স্টাডি এবং মুক্তা তৈরির নিমিত্ত ঝিনুক চাষের আধুনিক কৌশল উদ্ভাবনের জন্য ময়মনসিংহে স্থাপিত প্রথম মুক্তা গবেষণাগারে রাখা হয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। গত ২৬ ডিসেম্বর এই গবেষণাগার উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক।
মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনর রশিদ বলেন, আমাদের দেশে পূর্বে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণ মুক্তা উৎপাদিত হতো। এসব বিষয় বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট স্বাদুপানিতে মুক্তাচাষের পরীক্ষামূলকভাবে গবেষণা পরিচালনা শুরু করে। পরে ২০১২ সালের জুলাই মাসে ১৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের অধীনে মুক্তা গবেষণাগার, কক্সবাজারে একটি ল্যাবরেটরি সংস্কার, গবেষণা পুকুর সংস্কার ও রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে এ প্রকল্পে ২৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।
বিএফআরআই এর বিজ্ঞানীরা জানান, গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী জরিপ চালিয়ে এ পর্যন্ত স্বাদু পানির ৫ ধরনের মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ঝিনুক থেকে সর্বোচ্চ ১২টি মুক্তা তৈরি হয়। ছয় মাসে সর্বোচ্চ ৫ মিলিমিটার এবং গড়ে ৩ মিলিমিটার আকারে মুক্তা তৈরি হয়। এর আগে এই আকারের মুক্তা তৈরিতে সময় লেগেছিল ১২ থেকে ১৮ মাস। এ পর্যন্তা কমলা, গোলাপি, সাদা, ছাইথ এই ৪টি রঙের এবং তিন আকারের (গোল, রাইস, আঁকাবাঁকা) মুক্তা পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ৮ মাসে পূর্ণাঙ্গ ইমেজ মুক্তা (চ্যাপ্টা আকৃতি) তৈরিতে সফলতা এসেছে। মুক্তা উৎপাদনকারী অপারেশনকৃত ঝিনুকের বেঁচে থাকার হার ৭৬% এবং মুক্তা তৈরির হার ৮২%। মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকের বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা প্রয়োজন। জলাশয়ের পানির রং হলুদাভ সবুজ এবং স্বচ্ছতা ৩০ সেমি ঝিনুক চাষের জন্য উপযোগী। এরূপ রং না থাকলে সেখানে দৈনিক ২০০-৩০০ গ্রাম গোবর, ৪-৫ গ্রাম ইফরিয়া এবং ৩ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া নদীর কুলবর্তী এলাকা যেখানে পানির প্রবাহ থাকে সেখানে মুক্তা চাষ করা যায়। পুকুরে সামান্য পানি প্রবাহ সৃষ্টি করা গেলে ভাল। মুক্তা চাষের জলাশয়ে প্রতি মাসে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
তবে মুক্তা বিজ্ঞানী ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহসেনা বেগম তনু জানান, ঝিনুকের ম্যান্টলের নিচে একটি ইমেজ প্রবেশ করিয়ে দিলে সেই ইমেজের উপর মুক্তার একটি প্রলেপ পড়ে যা দেখতে খুবই সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। মুক্তার প্রলেপযুক্ত এই ইমেজকে ইমেজ মুক্তা বলা হয়। মুক্তা চাষ গবেষণা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এরই মধ্যে তারা ‘ইমেজ মুক্তা’ (চ্যাপ্টা আকৃতি) উৎপাদনে সফল হয়েছেন। ইমেজ মুক্তা উৎপাদন প্রযুক্তি তুলনামূলক সহজ এবং বাণিজ্যিকভাবে করা সম্ভব। কিন্তু দেশীয় ঝিনুকের আকার ছোট হওয়ায় বড় ও সুন্দর আকৃতির মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় মুক্তা চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য বিশ্বের মুক্তা উৎপাদনকারী দেশসমূহ থেকে উন্নত প্রজাতির ঝিনুক আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন মোহসেনা বেগম।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মুক্তার চাহিদা যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারেও মুক্তার চাহিদা উলে¬খযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রচুর পুকুর-দীঘি, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় নদী-নালা আছে যা মুক্তাচাষ উপযোগী। মুক্তা উৎপাদনের জন্য চাষকৃত ঝিনুক ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলাশয়ের পরিবেশ উন্নত করে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে দেশে মুক্তাচাষে বিরাট সফলতা অর্জন করা সম্ভব-যা দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
তিনি আরো বলেন, মুক্তা চাষ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প। যেহেতু চীন থেকে উন্নত প্রজাতির ঝিনুক নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না, তাই ভিয়েতনাম বা অন্য কোনো মুক্তা উৎপাদনকারী দেশ থেকে ঝিনুক নিয়ে আসা যায় কি-না এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তা চাষ প্রকল্পকে সফলতা দিতে মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন বিষয়ে বিএফআরআইর বিজ্ঞানীদের বিদেশ থেকে মুক্তা চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

Exit mobile version