Site icon

গদখালীর ফুল যার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে দেশে ও বিদেশে

 

বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বন। ফলে বছরজুড়েই থাকে ফুলের চাহিদা। তবে আসন্ন বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের বাজার ধরতে আগেভাগেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী এলাকার ফুলচাষিরা। তাদের আশা, এবার বিশ্ব ভালবাসা দিবসেও গদখালীর ফুল সুবাস ছড়াবে সারা দেশে। এবার গদখালীতেই অন্তত ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে জানালেন তারা।

চলতি মৌসুমে গদখালী এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার কৃষক দেড়হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ করেছেন। গদখালী এলাকার মাঠের যে প্রান্তে চোখ যায়, শুধু ফুল আর ফুল। রঙ-বেরঙের ফুলের সমারোহ গদখালী এলাকায় এখন অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি দিচ্ছে। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে। কেননা, এ তিনটি উৎসবে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয়।

গদখালী এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠজুড়ে জারবেরা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকা ফুল হাতছানি দিচ্ছে। স্থানীয় কয়েকজন চাষি জানান, বাংলাদেশে ফুলের চাহিদার কমপক্ষে ৭০ শতাংশ গদখালী থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। আসছে ১৪ ফেব্র“য়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও ২১ ফেব্র“য়ারি মহান ভাষা দিবসে এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছে। স্থানীয় একাধিক চাষি বলেন, প্রতিবছর বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও মাতৃভাষা দিবসে ফুলের বাজার ধরতে এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগামী ১৪ ফেব্র“য়ারি ফুলের বাজার ধরতে বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে ফুলচাষিরা মহাব্যস্ত সময় পার করছেন। এ প্রসঙ্গে গদখালী ফুলচাষি সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও মহান ভাষা দিবসকে সামনে রেখে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছে চাষিরা। তিনি আরও বলেন, এ তিনটি দিবসে অন্তত ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট তাদের। সে মোতাবেক ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা ও ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ক্রেতারা গদখালীর চাষিদের বায়নার টাকা দিয়েছেন। ১১-১২ ফেব্র“য়ারি থেকে ফুল কাটা শুরু হবে বলেও জানান তিনি।

স্থানীয় কৃষকদের একমাত্র পেশা ফুল চাষ

১৯৯৫ সালের আগে এ অঞ্চলের যে কৃষকরা ধান কিংবা সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন তারা পুরোপুরিই ফুল চাষের ওপর নির্ভরশীল। অন্য ফসলের তুলনায় ফুল চাষ লাভজনক হওয়ায় গদখালীসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে অন্য কোনো ফসল চাষ হচ্ছে না।

সরকারি সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ফুলচাষিরা

যশোরের গদখালী ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তেমন কোনো সহায়তা করেন না চাষিদের। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ফুল ক্ষেতে বিভিন্ন রোগবালাই হলে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। অন্যদিকে স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের খেয়াল-খুশিমতো মাসে হয়তো একবার বেড়াতে আসেন। গদখালীতে উৎপাদিত ফুল সংরক্ষণের জন্য একটি আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের দাবি চাষিদের। তারা সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি জানিয়ে এলেও দাবি পূরণ হয়নি।

গড়ে উঠেছে ফুলের হাট গদখালী

স্থানীয় চাষিদের উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গদখালী নামক স্থানে গড়ে উঠেছে বিশাল একটি ফুলের হাট। এ হাটে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে ফুল বেচাকেনা।

ফসলের তুলনায় অধিক লাভজনক ফুল চাষ

স্থানীয় ফুলচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য যে কোনো ধরনের ফসলের তুলনায় ফুল চাষ অধিক লাভজনক। স্থানীয় পুটপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে গোলাপ কিংবা গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ করতে খরচ হয় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। এরপর চারা গাছে একবার ফুল ধরলে তা কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ফুল দেয়। এতে বছরে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা আয় আসে। তিনি আরও জানান, তিনি বিঘাপ্রতি বছরে ১২ হাজার টাকা হিসেবে চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফুল চাষ শুরু করেন। বর্তমানে তার প্রতিটি গাছে ফুল ধরেছে। এতে প্রতি বছরে তিনি কমপক্ষে দুই লাখ টাকা আয় করছেন।

ফুল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন কৃষক

১৯৮৩ সালের দিকে স্থানীয় হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক ফুল চাষ শুরু করলে তাদের সাফল্য দেখে অনেকেই ফুল চাষের দিকে ঝুঁঁকে পড়েন। একপর্যায়ে ১৯৯৫ সাল থেকে অধিকাংশ কৃষক ফুল চাষ শুরু করেন। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কৃষক আয়ের উৎস হিসেবে ফুল চাষকে বেছে নিয়েছেন। সরেজমিন এলাকা ঘুরে জানা যায়, যেসব কৃষক গত ১০ বছর আগে পরিবার-পরিজন নিয়ে দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খেতেন, ফুল চাষের মাধ্যমে তারা এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। প্রত্যেকেই পাকা বাড়ি করেছেন। ঘুচে গেছে অভাব-অনটন।

বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের গদখালী পরিদর্শন

ফুলের রাজধানীখ্যাত গদখালী পরিদর্শনে এসেছেন দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এরই মধ্যে ২০১৪ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজীনা, তার স্ত্রী গ্রেস মোজীনা ও চ্যানেল আইয়ের বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজসহ কয়েকজন বিশিষ্ট মার্কিন নাগরিক। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আতিকুর রহমান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন, তৎকালীন কৃষিবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শওকত মোমেন শাহজাহান, তৎকালীন কৃষিসচিব ও খুলনা বিভাগীয় কমিশনার গদখালী এলাকার মাঠের পর মাঠ ফুল চাষ দেখে মুগ্ধ হন। এছাড়াও প্রতি বছর ফুল মৌসুমে বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা গদখালী বেড়াতে আসেন। সুত্রঃ আমাদের সময়।।

Exit mobile version