কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ
গরু মোটাতাজাকরণ খামার করার কৌশল
গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা খুব লাভজনক। অল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে গরু মোটাতাজা করে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা দূর করা যায়। অল্প সময়ে ষাঁড় বাছুর কে সুষম খাদ্য খাওয়ায়ে দৈহিক বৃদ্ধি করে গরু মোটাতাজা করা হয়। গরু মোটাতাজা করার সুবিধা হচ্ছে-
১. অল্প সময়ে (৪-৬ মাস) অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়।
২. মূলধন বা পুঁজি দ্রুত ফেরত আসে।
৩. আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি কম।
৪. খরচের তুলনায় লাভ বেশি।
৫. বেকারত্ব ও দারিদ্রতা দূর করা যায়।
৬. রোগব্যাধি কম হয়।
গরুমোটাতাজাকরণ পদ্ধতি
ঈদুল আজহার ৩/৪ মাস আগে গরু মোটাতাজা করার কাজ শুরু করলে লাভবান হওয়া যায়। গরু মোটাতাজা করার জন্য গরু নির্বাচন, গরুর বাসস্থান নির্মাণ, কৃমি মুক্তকরণ, গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্য খাওয়াতে হয়।
গরু নির্বাচন: দেড়-দু’বছর বয়সের সংকর জাতের ষাঁড় বাছুর নির্বাচন করা। ভালো জাতের গরু, ঘাড় খাটো, হাড়ের জোড়াগুলো মোটা প্রকৃতির, বুক চওড়া ও পাঁজরের হাড় চ্যাপ্টা, কোমরের দু’পাশ প্রশস্থ ও পুরু, কপাল প্রশস্থ, উচুঁ ও লম্বা, চামড়া ঢিলা, স্বাস্থ্যহীন ও রোগমুক্ত গরু নির্বাচন করতে হয়।
বাসস্থান নির্মাণ: প্রতিটি গরুর জন্য দৈর্ঘ্য ৮ ফুট, প্রস্থ ৬ ফুট ও উচ্চতা ৮ ফুট জায়গা প্রয়োজন। ঘরের ভেতর আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা। ঘরের মেঝে একদিকে ঢালু রাখা। ঘরের ভেতর খাদ্য ও পানি পাত্র থাকবে।
কৃমিমুক্তকরণ: গরু ক্রয় করার পরেই গরুর পেট থেকে কৃমি মুক্ত করতে হবে। অন্যথায় গরুর খাদ্যের বিরাট অংশ খেয়ে গরুকে পুষ্টিহীন ও রক্ত শূন্য করে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কৃমির ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা: গরু রোগাক্রান্ত কিনা ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। গরুর রক্ত, মল, জিহবা, পায়ের ক্ষুর, নাড়ীর স্পন্দন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে হবে। বিভিন্ন রোগের টিকা দিতে হবে।
সুষম খাদ্য খাওয়ানো: সঠিক পরিমাণে পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ালে ষাঁড় বাছুরের ওজন প্রতিদিন প্রায় এক কেজি পর্যন্ত বাড়ে। ১০০-১৫০ কেজি ওজনের একটি ষাঁড় বাছুরকে প্রতিদিন ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খড় ৩-৪ কেজি, সবুজ কাঁচা ঘাস ১০-১২ কেজি, চালের কুঁড়া ১ কেজি, গমের ভুসি ১.২৫ কেজি, তিলের খৈল ৪০০ গ্রাম, হাড়ের গুঁড়া ৫০ গ্রাম, লবণ ৫০ গ্রাম ও ঝোলাগুড় ২৫০ গ্রাম খাওয়াতে হয়। পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়াতে হবে। ইউরিয়া ও খড় প্রক্রিয়াজাত করার ৭ দিন পর খাওয়াতে হবে। অন্যথায় বিষাক্ততা দেখা দিবে। এক বছরের কম বয়সের বাছুর কে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না। অন্য কোনভাবে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না।
স্বাস্থ্য সর্তকতা
গরু মোটাতাজা করার জন্য গ্রোথ হরমোনের ইনজেকশন দেয়া হয়। এতে গরুর দেহের কোষ খুব দ্রুত বড় ও বৃদ্ধি হয়। ফলে গরু খুব তাড়াতাড়ি মোটা হয়। কিন্তু ওজন খুব বাড়ে না। পশু দুর্বল হয়। এই গরুর গোসতে গ্রোথ হরমোনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এই রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে চিকিৎসকরা বলেন। অপরদিকে, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য গরুকে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়। এই এন্টিবায়োটিকের রাসায়নিক পদার্থও জীবাণু প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘদিন মাংসে থাকে। এই রাসায়নিক পদার্থ মাংস ভক্ষণের সাথে মানুষের পেটে যায়। গ্রোথ হরমোন ও এন্টিবায়োটিক উভয়ের রাসায়নিক পদার্থ রান্নার তাপেও নষ্ট হয়না বলে মানবদেহে ফুসফুস, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন স্থানের কোষ নষ্ট করে ক্যান্সারের সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডস এর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সিলেক্ট কমিটির রির্পোটে বলা হয়, এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা পশুর গোসত ও দুধ মানুষ খেলে মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয় এবং স্যালমনেলাসহ বিভিন্ন অণুজীবঘটিত রোগ সৃষ্টি হতে পারে যা নিরাময় হয় না। গ্রোথ হরমোন দিয়ে মোটাতাজা গরুর দেহের মাসংপেশী ফোলা, নাদুস-নুদুস, দেহ দুর্বল হয় ও বেশি স্বাস্থ্যবান হয়। গরুর গোসতে ইন্টার সেলুলার ফ্যাট থাকায় মানবদেহে কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
কর্মসূচি চলাকালে নিয়মিত সারের ওজন নেয়া উচিত। ওজন যন্ত্র ছাড়াই সূত্রের সাহায্যে গরুর ওজন নির্ণয় করা যায়।
গোসত কতটুকু হবে মাপার জন্য সূত্র হচ্ছে: গরুর ওজন (কেজি) = ০.০০০১ Xদেহের দৈর্ঘ্য সেমি X {বুকের বেড় (সেমি)}২। গরুর কাঁধ থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দেহের দৈর্ঘ্য। বুক বরাবর পরিধি ফিতা দিয়ে মেপে বুকের বেড় পরিমাপ করা যায়। এই মান সূত্রে বসিয়ে হিসেব করে গরুর ওজন নির্ণয় করা যায়।
সময় : গরু মোটাতাজা করার উপযুক্ত সময় ডিসেম্বর/জানুয়ারী অথবা জুন/জুলাই। এ সময় আবহাওয়া একটু ঠান্ডা থাকে বলে রোগব্যধি কম হয়। তবে বর্ষাকাল ছাড়া যেকোন সময়ই করা যায়। ঈদুল আজহার ৩/৪ মাস আগে গরু মোটাতাজাকরণ শুরু করলে লাভবান হওয়া যায়। অনেকের ধারণা গরু মোটাতাজা করার জন্য বিশেষ কোন ঔষধের প্রয়োগ করতে হয়। আসলে এ কাজের জন্য গরুকে আলাদা কোন কিছু খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। একটা গরুর স্বাভাবিক যে পরিচর্যার প্রয়োজন হয় এক্ষেত্রেও তাই পালন করতে হবে। তাহলে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়ে গরু মোটাতাজা হয়ে যাবে। অনেকে বিশেষ ধরনের হরমোন ও স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ খাইয়ে থাকে যা কখনোই উচিত নয় এতে গরু হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যেতে পারে বা গরুর যকৃৎ স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং তলপেটে পানি জমতে পারে। এছাড়া এটা জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
…
লেখক: কৃষি প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, কৃষিশিক্ষা, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত লেখক।