গাভীর মিল্ক ফিভার এর কারণ , লক্ষণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা

milk fever
মোস্তাফিজুর রহমান

উন্নত জাতের গাভী এবং উচ্চ দুধ উৎপাদনে সক্ষম গাভী বাচ্চা প্রসব করবে অথবা করেছে। এমন অবস্থায় খামারীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন তার গাভী বাচ্চা প্রসব করার পরে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন মারা গেছে, হাত পা ছেড়ে দিয়েছে। তখন দ্রুত অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের স্বরনাপন্ন হয়। পরে চিকিৎসায় গাভী সুস্থ হয়ে উঠে। এই রোগের নাম মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধ জ্বর। এটিই কেবল মাত্র একটি রোগ যার নামেই ফিভার (জ্বর) উল্লেখ্য আছে কিন্তু আসলে এই রোগে কোন জ্বর দেখা যায়না। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এই রোগ খুবই পরিচিত। বিশেষত যারা উন্নত জাতের এবং ভালো মানের সংকর জাতের গাভী লালন পালন করেন। প্রতিবার বাচ্চা প্রসবের সময় বা আগে পরে না হলেও প্রায়ই ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা যায়। যার কারণে কিছু মানুষ গাভী পালনে ভয় পায়। এই রোগ একটি মেটাবোলিক রোগ, যা সাধারনত ক্যালসিয়ামের অভাব জনিত কারনেই হয়ে থাকে।
রোগের কারনঃ এটা পুষ্টি উপাদান ঘাটতি জনিত রোগ। শরীরের সঠিক ভাবে কার্য সম্পাদন করতে যে পরিমাণ ক্যালসিয়াম প্রয়োজন তার অভাব হলে এই রোগ হয় । বাচ্চা প্রসবের সময় ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয় অনেক বেশি পরিমাণে। যার কারনে গাভী হঠাৎ পড়ে যায় এবং ঘাড়ের মাথা দিয়ে বসে থাকে।

রোগের কারনঃ
ক) রক্তে ক্যালসিয়াম কমে গেলে এই রোগ হতে পারে। সাধারনত ১০০ সি সি রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমান থাকতে হয় ৯ মিলিগ্রামেরও বেশি। কোন কোন বিশেষ কারণে এই মাত্রা উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমে যেতে পারে, এমনকি তা ৩/৪ মিলিগ্রামে নেমে আসে। আর তখনই এই রোগের সৃষ্টি হয়।
খ) বাচ্চা প্রসবের সময় জরায়ুতে যদি ফুল আটকে থাকে বা কোন কারনে যদি জরায়ু বাইরের দিকে চলে আসে, কিংবা জরায়ুর কোন স্থানে যদি বাচ্চা আটকে থাকে ,তাহলেও এই মিল্ক ফিভার হতে পারে।
গ) কিছু হরমোনের বৈরি কার্যক্রমের কারনেও হতে পারে। যেমন এড্রেনালিন গ্রন্থির রস নিঃসরণের তারতম্যের কারণেও এই রোগ হতে পারে।
ঘ) গাভীর দেহে বিভিন্ন খনিজের ঘাটতির ফলে স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া ব্যহত হওয়ার জন্যেও এই রোগ হতে পারে।
ঙ) বাচ্চা প্রসবের পর পালান একবারে খালি করে দুধ দোওয়া হলেও এই রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
গাভী গর্ভকালীন সময়ে নিজের রক্ত থেকে ক্যালসিয়াম বাচ্চার( ফিটাসের ) দেহে পাঠায়। প্রায় প্রতি ঘন্ঠায় ০২৫ বা প্রতিদিন ১০ গ্রাম এবং বাচ্চা প্রসবের ২৪ ঘন্টা মধ্যে প্রতিঘন্ঠায় ১ গ্রাম বা সারাদিনে সর্বোচ্চ ৩০ গ্রাম ক্যালসিয়াম প্রসব কালীন দুধে বের হয়। এই কারণেই গর্ভকালীন এবং প্রসবোত্তর উপযুক্ত পরিমানে ক্যালসিয়ামের সরবরাহ না থাকলেই এই রোগ বেশি হয়।
আরো কিছু কারণে এই ক্যালসিয়াম হ্রাস পায় যথা-

প্রথমত: গাভীর পাকান্ত্র থেকে শোষিত ও অস্থি থেকে বের হয়ে আসা ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ফিটাস ও কলোস্ট্রামের চাহিদার পরিমাণ অপেক্ষা অধিক কম হলে এই রোগ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় এবং কলস্ট্রাম পিরিয়ডে পাকান্ত্রে সুষ্টভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত না হলে। আর যেসব কারনে সুষ্ট ভাবে হয় না তা হতে পারে-
ক্স খাদ্যে ক্যলসিয়ামের অভাব
ক্স ক্ষুদ্রান্তে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম অক্সালেটের সৃষ্টি
ক্স অন্ত্র প্রদাহ
ক্স ক্যালসিয়াম ফসফরাসের অনুপাতের তারতম্য
ক্স ভিটামিন ডি এর অভাব ইত্যাদি।

এপিডেমিওলজিঃ
ক) প্রি-ডিসপোজিং ফ্যাক্টরস (pre disposing factors- ):
বয়সঃ সাধারণত বয়স্ক গাভিতে বেশি দেখা যায়। ৪/৫ বাচ্চা প্রসবের পর এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। কারণ বৃদ্ধ বয়সে একদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হ্রাস, অন্যদিনে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণ হ্রাস পায়। উচ্চ ফসফরাস যুক্ত খাদ্য ভিটামিন ডি কে তার মেটাবলাইটে বাধা প্রদান করে ফলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ
জাতঃ জার্সি জাতের গাভী এরোগ বেশি আক্রান্ত হয়। আকারে ছোট কিন্তু বেশি দুধ দেয় বলেই এই সমস্যা হতে পারে।
পুষ্টিঃ একটানা ৪৮ ঘন্ঠা অনাহারে বা নিম্ন মানের খাবার পরিবেশন করলে ক্যালসিয়ামের অভাবে হতে পারে।
সময়কালঃ ঘাস খাওয়ানোর চেয়ে ঘরে বেধে খাওয়ালে এই সমস্যা বেশি হতে পারে।
হরমোনঃ প্রসব ও ইস্ট্রাস পিরিয়ডে ইস্ট্রোজেন হরমোন বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ক্যালসিয়াম বেটাবলিজমে বাধা পায়।

প্রাদুর্ভাব ও সংবেদনশীলতা (Occurance & susceotibility))ঃ
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সব দেশেই অধিক দুধ উতপাদনকারী গাভী এবং অনেক সময় ছাগী, ভেড়ী ও মহিষেরও এই রোগ হয়।
দুদ্ধ জ্বর বিক্ষিপ্ত প্রকৃতির রোগ তবে খামার ভুক্ত গাভীর এই সমস্যা ২৫-৩০ ভাগ হওয়ার ইনিহাস রহিয়াছে।
প্রাদুর্ভাবের পর্যায়ঃ সাধারণত তিন পর্যায়ে রোগটির লক্ষন প্রকাশ পায়-১। গর্ভাবস্থার শেষ কয়েকদিন,২। প্রসবকালীন ও ৩। প্রসবোত্তর ( ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত)।

অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
 এই রোগের ফলে গাভীর সাময়িক দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে খামারী অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
 দ্রুত চিকিতসা নিলে ভাল হয়ে যায় , তবে যদি বেশি দেরি করা হয় তাহলে যে কোন সমস্যা হতে পারে।
 এই রোগে মৃত্যুর হার কম।
রোগের লক্ষণঃ এই রোগের নামে জ্বর থাকলেও আসলে জ্বর হয়না। তবে নিম্নোক্ত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়।
গাভীর তাপমাত্রা হ্রাস পায় অনেক সময় স্বাভাবিক থাকে।
দুদ্ধ জ্বরে আক্রান্ত গাভীর উপসর্গ গুলোকে তিন ভাবে ভাগ করা যায়-
প্রথম পর্যায়ঃ
 মৃদু উত্তেজনা ও অনৈচ্ছিক পেশী খিঁচুনি।
 স্নায়ুবিক দুর্বলতা ,অতিসংবেদনশীলতা, ক্ষুধা মন্দা ও দুর্বলতা।
 ভাগীর হাটতে ও খাদ্য গ্রহণে অনিচ্ছা ,পরবর্তীতে পিছনের পা দ্বয় শক্ত হয় এবং টলমল করে হাঁটে।
 হ্রদ গতি বৃদ্ধি পায় এবং দেহের তাপমাত্রা সামান্য কিছু বৃদ্ধি পায়।
 এসব উপসর্গ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য থাকে এবং অলক্ষিতভাবে চলে যায়।
 এপর্যায়ে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে (৭৫ /) নেমে আসে
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ
 গাভী মাটিতে সুয়ে পড়ে এবং আর উঠে দ্বাড়াতে পারেনা।
 গাভী শুয়ে মাথা ও ঘাড় বাকিয়ে ফ্লাঙ্কের উপর রাখে।
 আংশিক পক্ষাঘাত() ও অবসাদ প্রকাশ পায় এবং রক্তে ক্যালসিয়াম অধিক মাত্রায় হ্রাস পায়।
 সুক্ষ পেশী কম্পন ও ও গভীর ও দ্রুত হ্রদ গতি থাকে।
 গাভীর দেহের প্রান্ত বিশেষ করে কান ও নাক ঠান্ডা থাকে এবং দেহের তাপমাত্রা ৯৬-১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকে।
তৃতীয় পর্যায়ঃ
ক্স প্রাণী অবসাদ গ্রস্থ থেকে দেহের এক পাশে মাথা গুজে শুয়ে থাকে। এই বিশেষ ভঙ্গী দুগ্ধ জ্বরের বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য।
ক্স পেট ফেঁপে যায়।
ক্স চিকিৎসা বিহীন ভাগীর মৃত্যু ঘটে।
ক্স রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমান সর্বনিম্নে নেমে যায় (১ mg/dl) ।
প্রসব পুর্ব ও প্রসবকালীনঃ
প্রসবের পুর্বে দুদ্ধজ্বর হলে প্রসব আরম্ভ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
বাচ্চা প্রসবের জন্য কোন কোথ দেয়না।
জরায়ুর নিস্ক্রিয়তার ফলে প্রসবে বিঘ্ন ঘটে।
বাচ্চা প্রসব হলে হাইপোক্যালসেমিয়ায় জরায়ুর নির্গমন ঘটে।
রোগ নির্নয়ঃ সাধারন্ত নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর নির্ভর করে রোগ নির্নয় করতে হয়।
ক) রোগের ইতিহাস নিয়ে এবং এর উপর ভিত্তি করে-
১. গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের ইতিহাস , প্রাপ্ত বয়স্ক ভাগী বিশেষ করে ৫-৯ বছর বয়সে এই রোগ বেশি হয়।
২. সাধারণত বাচ্চা প্রসবের ১৫ মিনিট পরে গাভী , ৩০ মিনিট পরে বকনা, এবং প্রসববিঘ্ন যুক্ত গাভী ৪০ মিনিট পর দাঁড়ায় । এই সময়ের মধ্যে বাচ্চা প্রসবের পর না দাঁড়ালে মিল্ক ফিভার রোগ সন্দেহ এবং পরিক্ষা করা প্রয়োজন।
৩. রোগের লক্ষনের সাথে প্রকাশিত উপসর্গ মিলিয়ে রোগ নির্নয় করা হয়।
৪. রক্তের ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম নির্নয় করেও এরোগ নির্নয় করা হয়।
চিকিৎসাঃ
রোগের লক্ষন প্রকাশের সাথে সাথে অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের পরামর্শ নিন। তাহলে দ্রুতই এই রোগের সমাধান করা যাবে। যেমন চিকিৎসা দেয়া হয়-
১। যত দ্রুত সম্ভব ক্যালসিয়াম বোরো গ্লুকোনেট সলুশন ইনজেকশন দিতে হবে। প্রা ৪৫০ কেজি দৈহিক ওজনের গাভীকে ৫০০ মিলি ক্যালসিয়াম বোরো গ্লুকোনেট যার মধ্যে প্রায় ১০৮ গ্রাম ক্যলসিয়াম থাকে, অর্থেক মাত্রা ত্বকের নিচে এবং বাকী অর্থেক শিরায় ৫-১০ মিনিট ধরে দেয়া হয়।
২। সঠিক ভাবে সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম রক্তে গেলেই গাভী দ্রুত সাড়া প্রদান করে সুস্থ্য হয়ে উঠবে। তবে প্রায় ১৫ গাভীকে আলাদা করে চিকিৎসা বা ছাটায়ের জন্য রাখা হয়।
৩। যদি মাত্রা অপর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম সলুশন দিয়ে চিকিৎসা করলে গাভী সুস্থ্য ও হয়না এবং দাড়াতেও পারেনা। অথবা সাময়িক ভাবে পশু সুস্থ্য হলেও পুনরায় একই সমস্যার সম্মুক্ষীন হয়। অপর দিকে ক্যালসিয়াম সলুশন অতিরিক্ত মাত্রায় এবং দ্রুত শিরায় দিলে প্রানীর মৃত্যুর আশংখ্যা থাকে।
বর্তমানে ক্যালসিয়াম , ফসফরাস এবং ম্যাগনোসিয়াম গ্লুকোজ সমন্বয়ে সলুশন বাজারে পাওয়া যায়। দুদ্ধজ্বরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা হ্রাস পায় কিন্তু ম্যাগনেসিয়াম মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই দুদ্ধ জ্বরের চিকিৎসার ওষুধ নির্বাচনের জন্য সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ এ উত্তম। দুই ভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়-
১। খাদ্য সংশোধন(Feed correction)
২। প্রি ডিস্পোজিং ফ্যাক্টরস সংশোধন  ( Predisposing factors correction)
প্রথমতঃ খাদ্য সংশোধন , হতে পারে এমন-
গাভী শুষ্ক অবস্থায় ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করা।
তবে শুধু ক্যালসিয়াম দেয়া যাবেনা ঐ সময়- কারণ
দেহকে সম্পর্ণ পাকান্ত্রের ক্যালসিয়াম শোষনের উপর নির্ভরশীল করে তুলে। অতে অস্থির ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। প্রসব ও কলস্ট্রামের প্রচুর ক্যালসিয়াম প্রয়োজনে অস্থি থেকে দ্রুত ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হতে পারেনা।
খাদ্যে পরিমাণ মত ফসফরাস সরবরাহ।
গাভীর কনসেন্ট্রেট খাদ্যে শতকরা ১৫ ভাগ মনো সোডিয়াম ফসফেট মিশিয়ে খাও্যালে এই রোগ প্রতিহত হয়।

দ্বিতীয়তঃ প্রি ডিস্পোজিং ফ্যাক্টোরস সংশোধন-
বয়সঃ বয়স্ক গাভির প্ররযাপ্ত পরিচর্যা নিতে হবে।
জাতঃ জার্সি জাতের এই রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশেষ যতœ ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
গাভীর শুষ্ক ও প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সুষম পুষ্টির ব্যবস্থা করা।
একটু সচেতন হয়ে আমরা গাভীর ব্যবস্থাপনা করলেই এই রোগ হতে সহজেই আমাদের প্রানীকে রক্ষা করতে পারবো। আর রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত সুস্থ করা যায়। ফলে আমাদের দুদ্ধ উৎপাদন ও স্বাভাবিক থাকবে আমরা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারব।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *