বকুল হাসান খান, আবদুল কাদের
শেষ পর্ব
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বনসাই উপযোগী গাছ: উপরে উল্লিখিত গুনগুলির অধিকারী কয়েক জাতীয় গাছের নাম উদাহরণ স্বরুপ উল্লেখ করা হলো- (১) বট ( ফাইকাস বেঙ্গলিয়েনসিস), অশ্বত্থ (ফাইকাস রিলিজিওসা) , বকুল, শিমুল, ঝাউ, ক্রিয়েন্টা, বোগেনভিলা, ব্রাসিয়া, অ্যাকটিনি ফোলিয়া, ফাইকাস বেঞ্জামিনা প্রভৃতি। প্রতিকুল অবস্থার কারণেও অনেক সময় প্রকৃতি সৃষ্ট ভাল বনসাই গঠনের গাছ পাওয়া যায়। সযত্নে ধরণের গাছ সংগ্রহ করেও বনসাই গাছের সংগ্রহ বৃৃদ্ধি করা যায়। বনসাই প্রেমিকেরা ভাল গাছ পাওয়ার আশায় বনে-জঙ্গলে ও নানা দিকে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যায়। অবশ্য এই প্রচেষ্টায় খুব কম লোকেই প্রকৃত বনসাই রূপের গাছ পেয়ে থাকেন।
উৎপাদন পদ্ধতিঃ ‘ বনসাই ’ বীজ ও কলম উভয় প্রকার গাছের দ্বারাই করা যাবে। বীজ থেকে হওয়া গাছগুলো হলো অশ্বত্থ, পাকুড়, তেঁতুল, শিমুল, বাবলা, শিরীষ ইত্যাদি। কলমের গাছে ভাল হবে ফলের গাছ, ঝাউ, ক্রিসেন্টা, ক্রিউজেটা ও কয়েক রকমের ফাইকাস।
এই কাজ শুরু করতে হবে দু – এক বছর বয়সের গাছ দিয়ে, কারণ ছোট গাছের কান্ড, ডাল নরম থাকার জন্য তারের সাহায্যে নানাভাবে ডালের বিন্যাস ও কান্ডের পরিবর্তন করে সুন্দর রূপ প্রদান করা যায়। ডাল বেশী শক্ত হয়ে গেলে প্রয়োজন মতো আকৃতি তৈরী করা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে থাকে। অনেক সময় ডাল ভেঙ্গে গিয়ে বিরূপাকৃতি হয়ে ওঠে। অপেক্ষাকৃত বেশী বয়সের গাছের মূল শিকড় কাটার বিপদের ঝুঁকি বেশী। অল্প বয়সী গাছের কোন ডাল ভেঙ্গে গেলে পুনরায় তা গজানোর সম্ভাবনা থাকে ; যা বয়স হওযা গাছের ক্ষেত্রে আশা করা যায় না। সাধারণভাবে বনসাই করা গাছ ছোট পাত্রে বসানো হয়। প্রথম থেকে গাছকে ছোট পাত্রে বসানো হলে যে অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয় তা হচ্ছে- ছোট জায়গার অল্প খাবার খেয়ে গাছের বৃদ্ধি অনেক কম হয় ও কান্ড শেকড় মোটা হতে দেরী হয়। বৃদ্ধির অভাবে ডালের সংখ্যা কম হওয়ার ফলে ডালের বিন্যাস ঘটিয়ে গাছটিকে তৈরী করতে সময় অনেক বেশী লাগে। বনসাই পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা কোন গাছকে একই জাতীয় গাছের প্রতিকৃতি তৈরী করার জন্য করণীয় কাজগুলি যথাক্রমে মূল, শেকড় (ট্যাপরুট) কাটা, যথেচ্ছ ভাবে থাকা ডালগুলি যথাযথ বিন্যাস ও কান্ডের সরল সোজা গঠনের পরিবর্তন করে বয়স্ক চেহারার ছাপ নতুন গাছের উপর ফুটিয়ে তোলা, মূল শেকড় কাটার পূর্বে দেখে নিতে হবে গাছের সতেজতা। কমজোরী গাছের বৃদ্ধি এমনিতেই কম, শেকড় কাটা হলে তা আরও কমে যাবে। এই সব অসুবিধার কথা চিন্তা করে বনসাই শুরুর প্রথম দিকে ছোট পাত্রে গাছ না বসিয়ে অপেক্ষাকৃত বড় পাত্রে বসানো উচিত। বড় গাছের কান্ড বনসাই পদ্ধতি প্রয়োগের সাহায্যে স্ফীত ও ইচ্ছানুযায়ী আকৃতিতে গঠন করা সুবিধাজনক। ডালের সংখ্যা বেশী হয়। অপ্রয়োজনীয় ডাল কেটে বাকিগুলিকে ভাল ভাবে সাজিয়ে নিতে হবে। দু’ এক দিনের অযত্নে বড় পাত্রের গাছের মরে যাবার ভয় থাকে না। উপরোক্ত কারণে প্রথম দু’ বছর গাছকে বড় পাত্রে রাখা ভাল।
ভবিষ্যৎ রূপরেখা নির্ধারণ ঃ আগ্রহী ব্যক্তির উচিত বনসাই শুরু করার প্রথমেই বিভিন্ন পুস্তকে বর্ণিত ছবিগুলি মনের মধ্যে ভাল ভাবে এঁকে নেওয়া ও বনসাই এর আকার প্রকার সন্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণার জন্য প্রদর্শণীর নিদর্শনগুলি, রূপরেখা (স্টাইল) ঠিক করার জন্য দেখা। শুরু থেকেই ভবিষ্যৎ রূপরেখা মনে রেখে কাজ করা অনেক সহজ। নির্দিষ্ট রূপের আকার (স্টাইল) সন্বন্ধে চিন্তা করার পর দেড়-দু বছর বয়সের আধ ইঞ্চির মতো মোটা, এক ফুট উচ্চ শাখা সহ গাছ নিয়ে কাজ শুরু করা ভাল। মামে (ছোট) বনসাই ছয় ইঞ্চির মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছেই হবে।
বনসাই তৈরীর মাটি ঃ বনসাই করার আগে মাটির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য জেনে নেওয়া ভাল। ছোট পাত্রে গাছ বসানোর মাটির মিশ্রণ আলাদা হবে। দেশীয় গাছ বকুল, তেঁতুল, পাকুড়, বট ও অশ্বত্থ প্রভৃতি বনসাই করার কাজে বেশী মাত্রায় ব্যবহৃত হয় ও প্রায় সব রকম মাটিতে ভালভাবে বেঁচে থাকে। ছোট পাত্রে গাছ বসানোর মাটির মিশ্রণ আলাদা হবে। দেশীয় গাছ বকুল, তেঁতুল, পাকুড়, বট ও অশ্বত্থ প্রভৃতি বনসাই করার কাজে বেশী মাত্রায় ব্যবহৃত হয় ও প্রায় সব রকম মাটিতে ভালভাবে বেঁচে থাকে। ছোট পাত্রের গাছ তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাওয়া, মাটি শক্ত ঢেলার আকার ধারণ করা ও অতি বর্ষায় টবে জল দাড়ানো ইত্যাদি সমস্যা যাতে না দেখা দেয় তার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। গাছ বসানোর মাটি তৈরী করার সময় দোআঁশ মাটির সঙ্গে তিন ভাগের এক ভাগ গোবর সার বা পাতা পঁচা সারের যে কোনও একটি মেশানো হলে মাটির আর্দ্রতা ধারণ শক্তি বৃদ্ধি পেয়ে দ্রুত শুষ্ক হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম হবে।
পরিচর্যা ঃ বট গাছের কান্ডে থাকে থাকে ডাল বের হয না, ঝুরি নামে। পাইনাস থামবারজি পিরামিডের মতো সোজা হয়ে উপরের দিকে বাড়ে। কান্ডের গা দিয়ে পর পর থাকে ডাল বের হয়। জাপানিরা বনসাই করার সময় পাইনাস থামবারজির উপর যে ধরণের রূপরেখা আরোপ করেন বট গাছের বেলায় তা করা যাবে না। ধৈর্য সহকারে প্রয়োজনীয় পরের কাজগুলি যথাযথ সময়ে করে যেতে হবে। যেমন- সংগ্রহ করা গাছ টবে শাখাহীন লম্বা হতে থাকলে কঁচি আগাটি কেটে দিতে হবে। কারণ শাখাহীন গাছের বনসাই ভাল দেখাবে না। প্রখর দৃষ্টি ও কল্পনার স্বচ্ছতা কমবেশী হওয়ার উপর এই কাজের মাপ নির্ভর করবে। ছবির সাহায্য ছাড়া লেখার মাধ্যমে বিষয়টিকে সহজভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। সঠিক পদ্ধতিতে ডাল বিন্যাস করে বনসাই এর আকার তৈরী করাতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ডাল বিন্যাসের কাজ চলাকালীন সময়ের মধ্যেই মূল শেকড় (ট্যাপরুট) কাটার কাজটিও সম্পন্ন করতে হবে। মূল শেকড় কাটার পর গাছটিকে ওই একই টবে কিছুদিন রাখায় কোনও বাধা নেই। পরে গাছটিতে বনসাই রূপের প্রভাব লক্ষ্য করা গেলে সাধারণ পাত্র থেকে সঠিক মাপের বনসাই ছোট পাত্রে বদল করে নিতে হবে।
বীজে থেকে উৎপন্ন গাছেরই মূল শেকড় থাকে, কলমের গাছের মূল শেকড় না থাকার কারণ কলম করার সময়ে ডালটির চারিধার থেকে এক সঙ্গে অনেকগুলি শেকড় বেরোয়।
বিভিন্ন ডিজাইন তৈরীকরণ ঃ বনসাই করা গাছের আগার রূপ কয়েক রকম ভাবে করা যায়। গাছের আগার সমস্ত শাখা প্রশাখা এক দিকে বিন্যস্ত করে গাছটিকে সামান্য হেলানো অবস্থায় বসানো হলে ঝড়ে প্রভাবিত গাছের মতো দেখাবে। নীচ থেকে উপর পর্যন্ত ডালগুলিকে বাকিয়ে মোটা থেকে সরু মন্দিরের মতো রূাপ দেওয়া হলেও গাছটিকে সুন্দর দেখাবে। ফাইকাস জাতীয় গাছের সাধারণ ভাবে ঝুরি বের হয়। চারিদিকের বিস্তৃত ডাল থেকে প্রসারিত ঝুরিগুলিকে টবের চারিধারে স্থাপন করা হলেও গাছের সৌন্দর্য বৃুদ্ধি পাবে। অল্প বয়সী গাছের ঝুরির জন্য গুটি কলম (এয়ার লেয়ারিং) পদ্ধতির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। বনসাই করা গাছের সৌন্দর্য হানিকর অবাঞ্চিত শেকড় ও ডাল কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। এই কাজটি করতে হবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও নিজের বিচার বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে।
বনসাই বর্তমানে সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শিল্প। বনসাই এর সুন্দর নিদর্শন গুলির বেশীর ভাগ জাপানিদের দ্বারা তৈরী। তাঁদের দক্ষতা ও নিজস্বতার কোনও তুলনা হয় না। কিছু নমুনা ডিজাইন নিম্মে দেয়া হলো।
বনসাই রাখার স্থান ঃ বনসাই গাছ রাখার উপযুক্ত স্থান হচ্ছে সূর্যের আলো ও হাওয়া আসা উন্মুক্ত স্থানে। গ্রীষ্মে সামান্য ছায়ার ব্যবস্থা ও অতি বর্ষার সময় গাছ বসানো পাত্রগুলিকে কোনও আচ্ছাদনের নীচে রাখতে হবে।
রোগ ও পোকা-মাকড় দমন ঃ বনসাই গাছ অনেক দিন ধরে একই মাটিতে বসানো থাকার কারণে ছত্রাক রোগের আক্রমনের সম্ভাবনা থাকে। মাসে একবার চা চামচের এক চামচ ব্যভিস্টিন অথবা ব্লাইটক্স পাউডার আধা লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রেয়ারের সাহায্যে স্প্রে করে গাছকে ভিজিয়ে দিতে হবে। একই ভাবে পোকার জন্য মেটাসুড, নোভাকর্ন, ক্যালথিন নামক কীটনাশক ঔষধের যেকোন একটির বিশ ফোটা এক লিটার পানির সাথে মিশিয়ে মাসে একবার গাছে স্প্রে করে সুফল পাওয়া যেতে পারে।