নিতাই চন্দ্র রায়
অর্থনৈতি সমীক্ষা ২০১২ অনুসারে, দেশের উৎপাদিত মোট খাদ্যশস্যের ৫০ শতাংশ বোরো , ৩৬ শতাংশ আমন ৭ শতাংশ আউশ, ৪ শতাংশ ভূট্টা এবং ৩শতাংশ আসে গম থেকে। এজন্য দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বোরো ধানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বোরো ধানের উৎপাদনের ওপর চালের দাম , সরকারি গুদামে আভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ ও আমদানি নির্ভর করে। এবছর অকাল বন্যা ও পাহাড়ী ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকার ৬টি জেলার প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এ ছাড়া এপ্রিলের প্রথম দিকে অতিবৃষ্টির কারণে বিলএলাকা ও নিম্মাঞ্চলের বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৮ টি জেলায় ব্লাষ্ট রোগের কারণে দেড় হাজার একর বোরো ধান নষ্ট হয়ে যায়। এসব কারণে এবছর বোরো মৌসুমে সরকারি হিসেবে ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন এবং বেসরকারি হিসেবে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মেট্রিক টন চালের ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। এজন্য চলতি বোরো মৌসুমের শুরু থেকেই হু হু করে বাড়তে থাকে চালের দাম। সারা দেশের হাট-বাজারে বর্তমানে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই মোটা চালের সর্বোচ্চ দাম।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের( টিসিবি) হিসেবে, গত এক মাসে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর এক বছরের ব্যধানে এ বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পৃথিবীর অন্যান্য চাল উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মোটা চালের দাম সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৩৪ দশমিক ৪৩ টাকা, পাকিস্তানে ৩৮ দশমিক ৫৪ টাকা, থাইল্যান্ডে ৩৭ দশমিক ৮১ টাকা এবং ভিয়েতনামে ৩৩ দশমিক ৬২ টাকা। সে হিসেবে বাংলাদেশে মোটা চালের দাম পাকিস্তান থেকে ৬ দশমিক ৪৬ টাকা ও ভারতের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৭ টাকা বেশি।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের দিকে দেশে চালের মূল্য হঠাৎ করে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ টাকায়। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি ক্ষেত্রে ভ্রান্ত নীতি গ্রহণের ফলে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক নন ইউরিয়া সারের দাম হ্রাস ও সেচে ভর্তুকি প্রদানের কারণে ধানের বাম্পার ফলনের জন্য চালের দাম হ্রাস পায়। ২০১২ সালে প্রতি কেজি চালের দাম ২৬ টাকায় নেমে আসে। ২০১৪ সালে চালের দাম আবারও বেড়ে ৩০ টাকা এবং ২০১৫ সালে ৩৩ টাকাতে দাঁড়ায় । এরপর ২০১৬ সালে মোটা চালের দাম আবার বেড়ে ৩৪ টাকাতে পৌঁছে। পরপর কয়েক বছর ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে বোরো ধান চাষে কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন । ফলে ২০১৪-২০১৫ বছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ বোরো মৌসুমে প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন চাল কম উৎপাদিত হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এবার গত বছরের চেয়ে কম চাল উৎপাদিত হবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিশ্বে মোট চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ১৩ লাখ মেট্রিক টন। এবার তা কমে দাঁড়াবে ১৭ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন। চালের উৎপাদন কম হওয়ার পূর্বভাসের কারণে গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম থাইল্যান্ডে ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ, ভারতে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং পাকিস্তানে বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ।
বাংলাদেশে প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে শতকরা ১ দশমিক ৩৭ ভাগ হারে এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, নদীভাঙ্গন ও লবণাক্ততার কারণে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে শতকরা ০.৭ভাগ হারে।২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ সময়ে দেশে চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হার ১.০৩ থেকে ১.৩৩ শতাংশ, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১দশমিক ৩৭ শতাংশের চেয়ে কম।এছাড়া ২০১৫ সাল থেকে চাল আমদানির ওপর শতকরা ২৫ ভাগ শুল্ক আরোপের কারণে বিদেশ থেকে চাল আমদানিরও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়।
জানা যায়, চলতি মে মাসে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে যে ১ লাখ টন চাল কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়, তাতে প্রতি কেজি চালের দাম পড়বে ৩৩ টাকা । মূলত থাইল্যান্ড থেকে ওই চাল আসার সম্ভাবনা রয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে ওই চাল বাংলাদেশে পৌঁছবে। এর বাইরে ভিয়েতনামের সঙ্গে বছরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। ভিয়েতনামের চালের দামও প্রতি কেজি ৩৩ টাকার মধ্যে থাকবে। দেশটি থেকে জরুরি ভিত্তিতে আড়াই লাখ টন চাল আনার ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল আলাপ করে এসেছে। খাদ্য অধিদপ্তর চলতি মাসের শুরুতে ৩৪ টাকা কেজি দরে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৮ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করে। কিন্তু ২৫ মে পর্যন্ত চাল সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ২০৯ টন । চালকল মালিকদের একটি বড় অংশ প্রতি কেজি চালে ৩৪ টাকার সঙ্গে আরও ৪ টাকা প্রণোদনা মূল্য হিসেবে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। না হলে তাঁরা সরকারি গুদামে চাল দিতে পারবেন না বলে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। খাদ্য অধিদপ্তরের গুদামে বর্তমানে ২ লাখ ২৪ হাজার টন চাল ও ২ লাখ ৭৫ টন গম রয়েছে। গত বছর একই সময়ে প্রায় ৬ লাখ টন চাল ও ৩ লাখ ৩২ হাজার টন গম ছিল মজুদ ছিল। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, সরকারী গুদামের চালের মজুদ কম থাকার কারণে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও মিল মালিক মোটা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
চালের দাম বেড়ে গেলে নিম্ম আয়ের দরিদ্র্য মানুষের কষ্টের সীমা থাকেনা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে ২০১০ অনুসারে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য ক্রয় বাবাদ। আবার মাসিক মোট খাদ্য বাবদ খরচের ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যশস্য ক্রয়ে। যখন খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায় তখন নিম্ম আয়ের অধিকাংশ পরিবারের পক্ষে প্রয়োজনীয় চাল, ডাল , শাক-সবজি, ফল-মূল ,মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম কেনা সম্ভব হয় না। ভাতের সাথে আলু ভর্তা ,ডাল ও ডিম খেয়েই কোনো রকমে তাদের জীবন ধারণ করতে হয়।এই শ্রেণির মানুষ এমনিতেই পুষ্টিহীনতায় ভোগে। চালের দাম বৃদ্ধি পেলে পুষ্টিহীনতা আরো প্রকট আকার ধারণ করে।দেখা গেছে, চালের উচ্চ মূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে অনেক নিম্ম আয়ের পরিবারগুলুকে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে খরচ একেবারে কমিয়ে ফেলতে হয়। কারো কারো মতে চালের দাম বৃদ্ধিতে দেশের প্রায় ২ কোটিনিম্ম বিত্ত পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তায় মারাত্মক হুমকি তৈরি করবে।এসব পরিবারের দিনের খরচের একটি বড় অংশ চাল কেনা বাবদ ব্যয় হয়।
অকাল বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে এ বছর হাওরের ব্যাপক এলাকার বোরো ধান তলিয়ে গেছে। আউস চাষের সময়ও শেষ হয়ে গেছে। এখন সামনে রয়েছে আমন মৌসুম।আমন মৌসুমে সাধারণ ৫৫ থেকে ৫৬ লাখ হেক্টর জমি থেকে ১ কোটি ৩২ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। আমন মৌসুমে সম্পূরক সেচ, সুষম মাত্রায় সার, সময় মতো পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমন করে ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে বোরো মৌসুমের ঘাটতি পূরণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্ঠা চালাতে হবে। এ ছাড়া খাদ্য ঘাটতি পূরণের আর কোনো সহজ উপায় আমাদের সামনে নেই। খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তনের কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। সেই সাথে গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি নগরীয় কৃষি ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে।বর্তমানে বাংলাদেশে ৪ কোটি লোক নগরে বসবাস করে। ২০২০ সালে ৫০% অর্থাত সাড়ে আট কোটি এবং ২০৫০ সালে শতভাগ অর্থাত ২৭ কোটি লোক নগরে বসবাস করবে।এভাবে নগরবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে বিদ্যমান গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান নগরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবেনা।
বিশ্বে মাথা পিছু বার্ষিক গড় চাল ভোগের পরিমাণ ৫৮ কেজি হলেও বাংলাদেশে মাথাপিছু বার্ষিক চাল ভোগের পরিমাণ ১৬৮ কেজি।জাপানে মাথাপিছু বার্ষিক চাল ভোগের পরিমাণ মাত্র ৭৪ কেজি।চীনে ও ভারতে ৯১ কেজি। ইন্দোনেশিয়ায় ১৫৪ কেজি এবং থাইল্যান্ডে ১০১ কেজি।পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষই বাংলাদেশের মতো এত বিপুল পরিমাণ চাল ভোগ করেনা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের অবশ্যই খাদ্যাভাসের পরিবর্তন করতে হবে। চালের পরিভোগ কমিয়ে বেশি করে শাক-সবজি, ফল-মূল, সামুদ্রিক শৈবাল, মাছ, মাংস , ডিম ও দুধ খেতে হবে।এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা যদি চালের ব্যবহার শতকরা ২৫ ভাগও হ্রাস করতে পারি, তাহলে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়েও বিদেশে প্রতি বছর ৭৫ লাখ মেট্রিক টন চাল রপ্তানি করা যাবে। এতে কম করে হলেও প্রতি বছর শুধু চাল রপ্তানি করে ৩০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব হবে। অতিকষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে ভিয়েতনাম, ভারত বা থাইল্যান্ড হতে আর চাল আমদানি করতে হবে না। চালের পরিবর্তে বেশি করে শাক-সবজি, সামুদ্রিক মাছ, শৈবাল ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করলে দেশের কোটি কোটি মানুষ পুষ্টিহীনতা, অন্ধত্ব ও রক্ত শূণ্যতার হাত থেকে রেহাই পাবে, মেধা শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।সেই সাথে মানুষের কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং নিশ্চিত হবে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা।
লেখকঃ সাবেক মহাব্যবস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
৪৫/১হিন্দু পল্লী , ত্রিশাল
ময়মনসিংহ